চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

উন্নয়ন হোক পরিবেশবান্ধব

৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৭৪ সাল থেকে সমগ্র পৃথিবীতে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। ১৯৭২ সালের ৫ জুন জাতিসংঘের উদ্যোগে স্টকহেমে মানব পরিবেশ বিষয়ক সম্মেলন (UN conference on Human Environment) শুরু হয়েছিল, সেদিনটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই দিনে পরিবেশ সুরক্ষায় বৈশ্বিক কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন এবং বিভিন্ন দেশকে উৎসাহিত ও কারিগরি সহায়তা প্রদানকল্পে ইউনেপ (United Nations Environment Program) প্রতিষ্ঠা করে জাতিসংঘ। পৃথিবীতে জাতিসংঘ স্বীকৃত যত দিবস রয়েছে, উদযাপন পরিধির দিক থেকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস খুবই জনপ্রিয়।

এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস এর প্রতিপাদ্য ‘Go Wild for Life’। বাংলায় এর ভাবানুবাদ করা হয়েছে, ‘বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ, বাঁচায় প্রকৃতি, বাঁচায় পরিবেশ’। প্রতিপাদ্যের সঙ্গে একটি স্লোগান জুড়ে দিয়েছে জাতিসংঘ, তা হচ্ছে বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য কঠোর হস্তে দমন।

অবৈধ বাণিজ্যের কারণে পৃথিবীতে অনেক বণ্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। হাতি, গন্ডার, গরিলা, বাঘ, সামুদ্রিক কচ্ছপের মত বিভিন্ন প্রাণীর হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ও চামড়া মূল্যবান হওয়ায় চোরাচালানের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগ্রাসী চোরাচালানের কারণে আফ্রিকান দেশ ক্যামেরুনে কালো প্রজাতির গন্ডার ২০১১ সালে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আফিকান কয়েকটি দেশে (গাম্বিয়া, বুরকিনা ফাসো, বেনিন ও টোগো) হনুমানসদৃশ গ্রেট এপস বলে বিশেষ প্রজাতির গরিলা বিলুপ্তির পথে। সাপের বিষ মূল্যবান হওয়ায় অনেক দেশে সাপ ও সাপের বিষ চোরাচালানের শিকার হচ্ছে।

এছাড়া শুধু প্রাণীই নয়, বনের অন্যান্য সম্পদ যেমন: বৃক্ষ, ফুল – ইত্যাদিও এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক দেশের বনজ সম্পদ পাচারকারীরা আরেক দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পেটেন্ট করিয়ে নিচ্ছে। যেমন: নেপালের অনেক বিশেষ ফুল যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট করে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদ প্রকৃতি ও প্রতিবেশ তথা পরিবেশের অংশ। বনে বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ বনজ সম্পদকে বনদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু অসাধুদের বিধ্বংসী ও লোভী কার্যক্রমে একদিকে বন্যপ্রাণীও বিলুপ্ত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে বনজ সম্পদ। বনজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ায় বনজীবীদের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রকৃতি ও পরিবেশ, প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে জাতিসংঘ বর্তমানে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। ১৫ বছরব্যাপী (২০১৬-২০৩০) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজিতে জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি লক্ষমাত্রার মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে ৪টি (৬, ১৩, ১৪, ১৫) এবং পরোক্ষভাবে ৭টি (৩, ৭, ৮, ৯, ১১, ১৬ ও ১৭) পরিবেশ সংশ্লিষ্ট।

এসডিজির ১৫ নং লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, ‘প্রকৃতি ব্যবস্থাপনার টেকসই ব্যবহারকে উৎসাহ ও সুরক্ষা প্রদান, বনসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও মরুময়তা প্রতিরোধ, বনজ সম্পদের সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করা’। এর অধীন বেশ কয়েকটি অর্জনযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা (টার্গেট) নির্ধারণ করা হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে:

১৫.২: ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সব রকম বন ও বনজ সম্পদের সংরক্ষন, বন ধ্বংসের কার্যকলাপ বন্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত বনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নতুন বনায়ন সৃষ্টি করতে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা

১৫.৭: সংরক্ষিত উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের চোরাচালান ও পাচার রোধকল্পে এর চাহিদা ও যোগান বন্ধ করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ

১৫.৯: ২০২০ সালের মধ্যে রাষ্ট্রের সব স্থানীয় ও জাতীয় নীতি, উন্নয়ন প্রক্রিয়া, দারিদ্র দূরীকরণ কর্মকৌশল ও নিরীক্ষায় প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করা

এছাড়া আরও তিনটি অর্জনযোগ্য লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়ন সবদেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) কয়েকটি লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ সফল হয়ে সুনাম কুড়িয়েছে, এসডিজি অর্জন করার মাধ্যমে উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার। কিন্তু সেক্ষেত্রে আগ্রাসী ও বিধ্বংসী উন্নয়ন নীতি থেকে সরে আসতে হবে। তথাকথিত ভুল উন্নয়নের চেয়ে পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্য যেন অগ্রাধিকার পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

সরকার পরিবেশকে উপেক্ষা করছে, এটা অধিকাংশ উন্নয়ন নীতিতে পরিস্কার। সদ্যঘোষিত বাজেটে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ একেবারে নীচের দিকে। উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়সহ বরাদ্দ মাত্র ১,০৩৩ কোটি টাকা। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সর্বমোট বরাদ্দের চাইতেও অনেক একক প্রকল্পের বরাদ্দ অনেক বেশি। তার চাইতেও দুঃখজনক হচ্ছে, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের এমন অনেক প্রকল্পে আর্থিক সংস্থান করা হয়েছে, যেসব প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

যেমন: সুন্দরবন এর মত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের নিকটবর্তী রামপালে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে বন, বন্য প্রাণী ও সুন্দরবনের জলাশয়গুলোর কী ক্ষতি হবে, সেটা নতুন করে বলার কিছু নাই। কিন্তু যে সময়ে উন্নত দেশগুলো পরিবেশ ও জলবায়ুর সুরক্ষায় কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসছে, সে মুহূর্তে দেশে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পরিবেশ ধ্বংসেরই নামান্তর।

উপরন্তু, নিজ দেশের বায়ূ দূষণ নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশ সুরক্ষায় ভারত ও চীনের মত প্রভাবশালী দেশগুলো কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার নীতি গ্রহণ করেছে। বায়ুদূষণ ঠেকাতে চীন সরকার বেইজিংয়ে ৩ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে ভারত ও চীন বিপুল পরিমাণ কয়লা উৎপাদন করে, এগুলো ব্যবহারে তারা বাংলাদেশ ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোকে বেছে নিয়েছে।

বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব বিকল্প জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। আমাদের পরিকল্পনা প্রয়োজন আগামী প্রজন্মবান্ধব। বর্তমানের উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করতে আগামী প্রজন্মের জন্য দূষিত দেশ রেখে যাওয়ার নীতি থেকে সরে আসা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আদেশ জারি করেন, যা দু’দফায় সংশোধনের পর ৭৪ সালে আইন আকারে পাস হয়। এছাড়া সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে ১৮.ক অনুচ্ছেদে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে। এর আলোকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ পাস হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে অনুমতি ব্যতিত যে কোনো বন্যপ্রাণী শিকার বা উদ্ভিদ সংগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ আইনের বাস্তবায়ন আশাব্যঞ্জক নয়। যে কারণে ঢাকার রাজপথেও বিভিন্ন অতিথি পাখি বিক্রি করতে দেখা যায়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বন্যপ্রাণী পাচার ও ধরা পড়ার খবর প্রায়শই পাওয়া যায়। সম্প্রতি সুন্দরবন এলাকায় প্রায় ৪ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ধরা পড়ে, এর মধ্যে মুনিয়া পাখিই আড়াই হাজারের বলে খবর পাওয়া যায়। এতগুলো পাখি চোরাকারবারীরা ধরল, কর্তৃপক্ষ টেরও পায়নি?

এ আইনের দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে, বিদেশী উদ্ভিদ তথা গাছ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের গ্রাম-শহর সর্বত্র বর্তমানে বিদেশী গাছে ভরে গেছে। ইপিল ইপিল, ইউক্যলিপটাসসহ বিভিন্ন বিদেশী প্রজাতির উদ্ভিদ ও গাছ আমাদের পরিবেশ উপযোগী নয়। এসব বিদেশী গাছ রোধ করায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ হতাশাজনক। সামাজিক বনায়নের নামেই মূলত বিদেশী গাছের চারা লাগানোর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। এই ক্ষতিকর সামাজিক বনায়নে এবং দেশের সব নার্সারিতে দেশি জাতের গাছের চারা উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।

এটা সত্য, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বনাঞ্চল রয়েছে। এক সময়ে সুবিশাল ভাওয়াল গড় বলে পরিচিত সুবিশাল শালবন বিলুপ্তপ্রায়। অধিকাংশ স্থানে জনবসতি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সামান্য কিছু অংশ এখনও দখলবাজ ভূমিদস্যুদের লোভনীয় দৃষ্টির মধ্যে টিকে রয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচী (ইউনেপ) এর মতে, ‘পৃথিবীতে বন ধ্বংসের ধারাবাহিক কার্যক্রম জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য ২০ভাগ দায়ী’। বৃক্ষ যত বাড়বে ততই ক্ষতিকর কার্বনের প্রভাব কমবে। কারণ বৃক্ষ যেমন অক্সিজেন দেয় তেমনি কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয়। এ কার্বন আমাদের জন্য বিষের মত ক্ষতিকর। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের যত প্রভাব বাড়বে ততই বায়ু মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়ে পড়বে, ততই উষ্ণায়ন বাড়বে।

আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য পরিবেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনসমূহের কঠিন প্রয়োগ করতে হবে। যেসব কারণে পরিবেশ দূষিত হয় সেসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পরিবেশ আদালত সক্রিয় করতে হবে। পাশাপাশি জীববৈচিত্র সুরক্ষায় বন্যপ্রাণী বিষয়ক আইনকে শক্তিশালী করা দরকার। বন্যপ্রাণী শিকার ও উদ্ভিদ সংগ্রহ নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ দরকার। তদুপরি, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হওয়া দরকার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)