টেলিভিশনের মাধ্যমে তখন আমি কৃষকদের নতুন নতুন কথা শোনাচ্ছি। আমি তাদের বোঝাতাম, বাপ-দাদার আমলের প্র্যাকটিস ছেড়ে বেরিয়ে এসো। যে ধান চাষ করছো তা দিয়ে তোমার পরিবারের খাদ্যের চাহিদা মেটে না। সন্তান বাড়ছে, আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। জমির আইল বাড়ছে, বাড়ছে ফ্র্যাগমেন্টেশন অব ল্যান্ড। দেশিয় যে বীজ তুমি জমিতে লাগাচ্ছো এতে ধান কম হচ্ছে, তোমার চাহিদা মিটছে না। তাই তোমার উচিত সরকারি বীজ লাগানো। সরকারের কর্মকর্তারা এসে যে বীজের কথা বলেছে ওই বীজ লাগাও।
জবাবে তারা বলতো ওই বীজের ধান আমরা খাই না, ওটা রাবার ভাত। বলতাম, চালের পাশাপাশি গমের আবাদ করতে হবে। বলতো, না না গম কেন আমরা খাব? আমরা কি পাকিস্তানি! তখন দরিদ্র মানুষের খাবার ছিল গমের রুটি। বলতাম ভুট্টা লাগাতে, বলতো পাকিস্তানি জুলফিকার আলী ভুট্টোর নামের এই জিনিস আমরা কেন লাগাবো? এই ছিল তখনকার কৃষকদের সামগ্রিক অবস্থা। বাড়ির সামনে সবজি লাগানোর কথাও বলেছিলাম তাদের।
সেই সময় ঈশ্বরদীর কালিকাপুর নামে একটা জায়গা ছিল, সেখানে কৃষি কর্মকর্তারা বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় সবজির বাগান করার একটি মডেল তৈরি করেছিলেন। বাড়ির সামনে বিশ ফুট বাই বিশ ফুট যদি কোনো জায়গা থাকে, তাহলে বেড করে সবজি লাগিয়ে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সবজি পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে বিদেশি একটি সংস্থা এসে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এই মডেল ছড়িয়ে দেয় টেলিভিশনের মাধ্যমে। ঘরের পাশের যে লাউয়ের মাচা তা চলে এলো ধানখেতের আইল কিংবা পুকুরের ঢালে। মাইলের পর মাইল তখন সবজি চাষ হচ্ছে।
তবুও দীর্ঘদিনের অভ্যাস কৃষকরা ছাড়তে চাইতো না। ৫০০ জনকে বললে ৫ জন প্রয়োগ করতো। যেই ৫ জন শুনতো তারা যেদিন লাউ বা ধানের বীজ বপন করতো, তখন বাকি কৃষকদের এনে দেখানো হতো।
কুমিল্লা বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে একটা গ্রামে কৃত্রিম সেচের ব্যবস্থা করেন এইচওয়াইভি ধান লাগানোর জন্য। ওই যন্ত্র স্থাপনের পর পানি যখন উঠলো, তখন গ্রামের মানুষ ভয়ে পালিয়ে গেলো।
একজন টেলিভিশন ব্রডকাস্টার
শুরুর দিক আমি খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে কাজ করেছি? এতগুলো যন্ত্রপাতি দেখে মানুষ ভয় পেত আবার নতুন জ্ঞানের কথা বলতে গেলে তারা তেড়ে আসতো। প্রতিনিয়ত তাদের অনেক ধরনের মোটিভেশন দিতে হতো। তখন আমি দেখলাম টেলিভিশন এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে মানুষকে শিক্ষিত করা যায়। গান, নাটক কিংবা উন্নয়ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করা যায়। কিন্তু টেলিভিশনে মাতৃভাষা বাংলার প্রমিত রূপের বাইরে কোনো ভাষায় কথা বলা যেত না। তখনকার টেলিভিশনে কোনো বিশেষ জেলার ক্যারেক্টার থাকলেও সেই জেলার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারতো না। এরকম কোনো ক্যারেক্টার রাখতে হলে পাণ্ডুলিপি প্রথমে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হতো। তারা যদি অনুমোদন দিতো, তাহলেই কেবল ঐ চরিত্রে আঞ্চলিক সংলাপ ব্যবহার করা যেত। আর এখন শত শত পর্বের নাটকও আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত হচ্ছে।
১৯৮০ সালের দিকে প্রমিত বাংলার বাইরে কথা বলা ছিলো বিশাল অপরাধ। অনুষ্ঠান শুরু করার পর এক-দুই বছর কেটে গেলো। আমি লক্ষ করলাম, আমার কথা গ্রামের সাধারণ কৃষক বুঝতে পারছে না। কারণ আমি তো তার সাথে প্রমিত বাংলায় কথা বলছি। ফলে সেই কৃষক কতগুলো জায়গায় শংকিত হয়ে আছে। এক হচ্ছে, শহর থেকে যাওয়া বেশ কিছু মানুষ। তাদের পরনে আবার শার্ট-প্যান্ট। গ্রামের মানুষ তখন কালে ভদ্রে শার্ট-প্যান্ট পরতো। ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গিই ছিল তাদের সম্বল। তার উপর আবার আমাদের হাতে থাকতো অনেক যন্ত্রপাতি।
কেউ যদি কথা বলতেও চাইতো, তাহলেও আমার কথা ঠিকমতো বুঝতে পারতো না। আমাকে বলতে হতো, আপনি কেন এই চাষটি করবেন? এই চাষটি করলে আপনার ভাগ্যের এই উন্নতি হবে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো, মাঝে মাঝে বলতো, আমি তো এই চাষ করি না।
বছর দুয়েক যাওয়ার পর আমার জার্নালিস্টিক অ্যাপ্রোচে পরিবর্তন আনলাম। উন্নয়ন সাংবাদিকতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম। আমি চিন্তা করলাম বাংলা ভাষাতেই কথা বলবো কিন্তু পরিবর্তন করতে হবে। কীরকম পরিবর্তন? এমন একটি কথ্য ভাষা তৈরি করবো, যেটা সবজায়গার মানুষই বুঝবে। সেটা বরিশাল, চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালীই হোক। তো ঐ চাষের কথাই এরপর আমি তাকে এভাবে বললাম: ‘গতবার আপনি যেটা করসিলেন, আর এইবার এটা করসেন। এই দুইটার মধ্যে তফাৎটা কি পাইসেন? গতবারের তে এবার বেশি হইসে না কম হইসে?’
যখন এই ভাষায় কথা বলা শুরু করলাম, কৃষকের ভেতর থেকে সব গড়গড় করে বের হওয়া শুরু করলো। কারণ এটা তার ভাষা। সে বলতে থাকলো, ‘গতবার করসিলাম, গতবারের তে এবার একটু ভালোই মনে হইসে। ওই সাব ভালোই কইসে, আমারটা ভালো হইসে। আমারটা দেইখা আশেপাশের জনও লাগাইসে। তাদেরটাও ভালো হইসে।’
টেলিভিশন প্রমিত বাংলা ব্যবহারের পক্ষে। কিন্তু টেলিভিশনের কিছু কিছু অনুষ্ঠান থাকে টার্গেট অরিয়েন্টেড। এগ্রিকালচার সেরকম একটা অনুষ্ঠান। যারা দেখে তারা বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ। সেখানে ফোকাস গ্রামের মানুষ। আর যদি শহুরে দর্শক দেখে তাহলে সেটা অনুষ্ঠানের ক্রেডিবিলিটি, এটাই প্লাস পয়েন্ট। যাদের জন্য অনুষ্ঠান তারা যদি আমার অনুষ্ঠান না-ই বোঝে তাহলেতো অনুষ্ঠান ব্যর্থ। অডিয়েন্স ঠিক রাখার জন্য তাই প্রমিত বাংলার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এইসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে।
কাউকে জিজ্ঞাসা না করে এরকম একটা ভাষার অনুষ্ঠান আমরা প্রচার করে দিলাম, পুরো টেলিভিশনে শোরগোল বেঁধে গেল। একজন উপস্থাপক কীভাবে এই ভাষায় কথা বলে? সে সময়কার কর্তাব্যক্তি যারা ছিলেন তারা বেশ চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তাদের সাপোর্টেই এই জিনিস প্রচার করা গেছে।
ভাষার মাধ্যমে তাদের দুঃখ-বেদনা-আনন্দ বের করে নিয়ে আসা গেল। দেখা গেল তারা ক্রমশ আন্তরিক হচ্ছে। নিজের মতো করে কথা বলছে। প্রথম দিকে আমাকে অনেক বেশি কথা বলতে হতো। ২৫ মিনিটের অনুষ্ঠানে ১০ মিনিটই হয়তো আমাকে দেখা যাচ্ছে। কারণ আমি তাকে কনভিন্স করে নতুন প্রযুক্তির কথা বোঝাচ্ছি। জীবনমানের উন্নয়নের কথা বোঝাচ্ছি। এ কারণে আমাকে বেশি দেখানো হচ্ছে।
কৃষকের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম কৃষক মাঠে কাদার মধ্যে আর আমি মাঠের আইলের উপরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। টেলিভিশনে যখন দেখছি, তখন তার আর আমার মধ্যে পার্থক্য অনেক। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল এই দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। পরের সপ্তাহে আইলের উপর ডেকে পাশাপাশি বসে দুজন কথা বলছি। দূরত্ব কমেছে, সম্পর্ক আন্তরিক হয়েছে। কিন্তু এতে আরেক কৃষক মনে করতে পারে আমার কৃষক ভাইয়ের সময় নষ্ট হচ্ছে। পরের অনুষ্ঠানে আমি কাদার উপর দিয়ে তার কাছে চলে গেছি। কাদা, শব্দের খেলা এগুলোর মাধ্যমে নস্টালজিক করে তুলেছি। ক্যামেরা জুম ইন করে নির্দিষ্ট বস্তুর কাছে যাওয়া। ক্যামেরা আর আমি দুজন যাচ্ছি, এর মানে দর্শককে আমি তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। উপস্থাপক বিষয়ের কাছে চলে যাচ্ছে, আভিজাত্য ভেঙে যাচ্ছে। কৃষক নিজেকে মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করছে, তার সময় নষ্ট হচ্ছে না।
মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্য এবার পোশাকের দিকে গেলাম। যদিও টেলিভিশন গ্ল্যামার কিংবা জৌলুসের জায়গা। তারপরও টার্গেট অডিয়েন্সের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আমার এই জায়গা ভাঙতে হবে। যাদের সাথে কথা বলছি তারা ছেঁড়া কাপড় পরা, আর আমি যদি একেক সপ্তাহে একেক পোশাক পরে যাই তাহলে আমি তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারবো না। তারা আমাকে আপন ভাববে না। আমার টার্গেট টেলিভিশনকে এডুকেশন আর ডেভেলপমেন্টের টুলস হিসেবে ব্যবহার করা। আমাকে তাহলে একটাই কাপড় ব্যবহার করতে হবে যেটা তার মনে গেঁথে থাকবে। আমাকে গ্ল্যামারাস হওয়ার লোভ সংবরণ করতে হবে। একটি কাপড় পরবো, সেটা হবে পাইলট শার্ট। ১৯৮০’র দশকে সেই শার্ট অনেক জনপ্রিয় ছিল। হাতের উপরে, আস্তিনের উপরে ফ্ল্যাপ থাকে, পকেটে ঢাকনা থাকে। এই শার্ট দারোয়ানরাও পরতো, কিংবা পুলিশরা। এই ধরনের শার্টে একটা আউটডোর ভাব থাকে। এই শার্টটি বিশেষ দর্জি দিয়ে বানানো হলো। প্রথমে ছিল বিস্কুট রঙের, পরে কালারে পরিবর্তন আনা হলো। পকেটে কলম নিলাম, স্কুলের শিক্ষকের মতো। চোখে চশমা পরা হলো কারণ তখনকার গ্রামীণ পরিবেশ কলম আর চশমাকে বিশেষভাবে মূল্য দেওয়া হতো। এই বেশ নিতো শিক্ষক কিংবা মসজিদের ইমামরা। কৃষকরা যেন আমাকে শিক্ষিত মনে করে। আমার কথা যদি তারা আমলে না নেয়, তাহলে কি সম্প্রসারণের কাজ হবে? এরপর সবুজ শার্ট পরার সিদ্ধান্ত নিলাম, সবুজ ধানক্ষেতের কথা ভেবে। কৃষকের সঙ্গে আরো একাত্ম হওয়ার জন্য।
প্রথম দিকে ক্যামেরায় আমি ফোকাসড। ৫ বছর পর যখন আমি ফিডব্যাক নিয়ে অনুষ্ঠান করতে গেলাম, ফোকাস করা হলো কৃষককে, তার ফেসে ক্যামেরা ঘুরে যেত। ফ্ল্যাপের মধ্য দিয়ে ওভার দ্য শোল্ডার শটে কৃষকের মুখ। তারা তাদের উন্নয়নের কথা বলছে। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বীজে তাদের ফলন বেশি হচ্ছে। তারা মাছ চাষ করছে। সবজির ভালো ফলন পাচ্ছে। সর্বোপরি তাদের আয় বেড়েছে। এ কারণে তাদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এভাবেই চলেছে উন্নয়ন সাংবাদিকতা। ৩০ বছর পর এখন ওই সবুজ শার্ট পরে যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তখন দূরের কৃষক আমাকে দেখলেই ডাক দেয়, জানায় তাদের উন্নয়ন কিংবা সমস্যার কথা।
সাধারণ মানুষ কিছু পেশার মানুষকে ভয় পায়; যেমন চোর, ডাকাত, পুলিশ। আর ভয় পায় সাংবাদিককে। সাংবাদিককে তার ভয় পাওয়ার কথা ছিল না। বরং সাংবাদিকের কাছে তার সবকিছু প্রাণ খুলে বলার কথা। কিন্তু আমরা আমাদের কারণে এই প্লাটফর্মটা হারিয়ে ফেলছি। প্লাটফর্ম হারাচ্ছি এই কারণে, আমরা আমাদের কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছি, আমাদের ক্যামেরা বা মাইক্রোফোনকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছি। এ কারণে মানুষ স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে না। তাদের সামনে মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এভাবে একটু একটু করে এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে।
আসলে এটাই উন্নয়ন সাংবাদিকতা। যে দেশে খাদ্যের নিরাপত্তা ছিল না, সে দেশে টেলিভিশন আর পত্রপত্রিকার মাধ্যমে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেছে। হাজার মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটেছে। পোলট্রি শিল্প এখন বিশাল এক শিল্প। বছর জুড়ে নানা ধরনের শাক-সবজি খেতে পারছে মানুষ। এগুলো সম্ভব হয়েছে কৃষিবিদ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সরকার সর্বোপরি কৃষকের আন্তরিক ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে। মিডিয়ার একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি তাদের একটু সাহায্য করছি। তাহলে এই সাংবাদিকতাই কি শুধু উন্নয়ন সাংবাদিকতা? তা কি শুধুই কৃষিকেন্দ্রিক?
আসলে এমনটি নয়। আমাদের সবকিছুর মধ্যেই উন্নয়ন সাংবাদিকতা নিহিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশৃঙ্খল রাজনীতি সবকিছুর মধ্যেই উন্নয়ন সাংবাদিকতা হতে পারে। আমাদের মেধা কিংবা সাংবাদিকতার দক্ষতা দিয়ে এগুলোর মধ্যে থেকে উন্নয়ন সাংবাদিকতাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। গোটা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালেই কেবল সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। ১৯৮০ সাল থেকে মানুষকে বলে এসেছি, কৃষি মানেই কেবল ধান আর পাট চাষ নয় কিংবা কৃষক মানেই গ্রামের সাধারণ মানুষ নয়। কৃষি হবে ইন্টিগ্রেটেড। যেটা দিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে।(চলবে…)