সারা দেশে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প গুলো সমাপ্ত এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রেখে যেতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আরও একটা ক্ষমতায় আনার জন্য নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন: মাননীয় স্পিকার আমি আপনার মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি আহ্বান জানাবো, আমরা পদ্মাসেতুসহ যে মেগা প্রজেক্ট গুলো হাতে নিয়েছি এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছি সেগুলো সঠিকভাবে পূরণে; আর একটাবার আমাদের সুযোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণেল প্রতি আহ্বান জানাব। এটা শুধু সম্ভব নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে। তাই জনগণের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাইব।
প্রধানমন্ত্রী দশম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে আবেগভরা বক্তৃতায় জীবননান্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করেন: আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়,ধানসিঁড়ি নদিীটির তীরে…তিনি যোগ করেন…এই সংসদে।
সোমবার রাতে দশম জাতীয় সংসদের ২৩তম ও শেষ অধিবেশনে সংসদ নেতার সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী এসময় বলেন: ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। মাননীয় স্পিকার,২০৪১ সাল পর্যন্ত হয়তো আমি বেঁচে থাকব না, কিন্তু ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা দেশকে কোন পথে পরিচালনা করবে সেটা আমরা ঠিক করে রেখেছি। আগামীর নেতৃত্ব সেই পথ অনুসরণ করে দেশকে সেই চূড়ায় তুলে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের জনগণের উন্নয়ন ভাগ্য উন্নয়নের আমরা সুদূরপ্রসারী ডেল্টাপ্ল্যান তৈরী করে রেখেছি। আগামী ১০০ বছরে বাংলাদেশে কি হবে, কেমন হবে? সে পরিকল্পনাও আমরা নিয়েছি। লক্ষ্য ছাড়া কোন জাতি সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন: উচ্চ প্রবৃদ্ধি, নিম্ন মূল্যস্ফীতি এই আমাদের অর্থনীতি, মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু কন্য বলেন,‘আমাদের দৃঢ় এ অর্থনৈতিক ভারসাম্য গ্রামেও পড়েছে, গ্রাম অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তারা এখন অনেক উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছে। গ্রামে বসবাসকারী মানুষের এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে বলে সংসদকে জানান প্রধানমন্ত্রী’।
যোগ করেন: রূপকল্প দিয়েছিলাম ‘দিন বদলের সনদ’, আজ আমরা দাবি করতে পারি; সেটা করে যাচ্ছি এবং বাস্তবায়নের সঠিক পথে রয়েছি। এসময়ে আমরা গ্রামের মানুষের জীবনের অনেক পরিবর্তন করতে পেরেছি। তারা এখন কাজ করতে পারছে, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের এই দশ বছরে (নবম ও দশম জাতীয় সংসদ) আমরা বাজেটের আকার সাত গুণ বৃদ্ধি করেছি। দেশ জুড়ে আমরা উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। শুধু তাই নয় পুরো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ আমরা নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করেছি। আমাদের কারো কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। আমরা বড় বড় প্রকল্প নিয়েছি, তার একটি হচ্ছে পদ্মাসেতু। সেই পদ্মাসেতু আজ নির্মিত হচ্ছে, যা আজ দৃশ্যমান।
তথ্য-প্রযুক্তিখাতে উন্নয়ন: জাতির পিতার দেখানো পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দেওয়া চেষ্টা করছেন জানিয়ে সংসদকে বলেন, ‘জাতির পিতার আদর্শকে মেনে আমি রাজনীতি করি। তার স্বপ্নকে পূরণ করাই আমার একমাত্র মাত্র কর্তব্য, বলে আমি মনে করি। ডিজিটাল বাংলাদেশ করতে চেয়েছিলাম। সেটা শুনে অনেকেই কটুক্তি করেছিলো সে সময়ে। কিন্তু আমরা সেটা করে দেখিয়েছি।
আমাদের ১০ বছরের রাষ্ট্রপরিচালনায় অনেক ছেলে মেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে, চাকরি করার সুযোগ পেয়েছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে নিজেদের নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের জীবনমান উন্নয়ন করাই আওয়ামী লীগ সরকারের মূল লক্ষ্য জানিয়ে সংসদ নেতা বলেন: আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা যখন বলেছিলাম, অনেকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি। আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবে করে দেখিয়েছি। আমারা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়েছি। সমগ্র দেশের ৯০ শতাংশ জায়গায় ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দিয়েছি। দেশে প্রায় ১৫কোটি মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা বাঙালিরা একটু কথা বলতে পছন্দ করি। অনেকের হাতে দুই-তিনটা মোবাইল থাকে। তাই এতগুলো মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে। সারা বিশ্বে কোথাও এ নজির নেই। কাজেই আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলাম, তা অনেক দূর এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছিল তার মর্যাদা আমরা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি, এ দাবি আমরা করতেই পারি।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় জীবন-মানের উন্নয়ন: প্রযুক্তির উন্নয়নে দেশের মানুষের জীবনমান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সংসদকে এসময় জানান নবম ও দশম জাতীয় সংসদের টানা দুইবারের সংসদ নেতা। বলেন: সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ভিত্তিক শ্রমশক্তির ১৬ শতাংশ বাংলাদেশে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, শুধু বাংলাদেশেই ছয় লাখের বেশি তরুণ-তরুণী আউটসোর্সিং অর্থাৎ দেশে বসেই বিদেশের কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে। এটা ছড়িয়ে পড়েছে ইউনিয়ন পর্যন্ত।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপস বর্তমানে দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে ১ লক্ষেরও বেশি রাইডার যুক্ত হয়েছে। আমরা দেশের জনগণকে কর্মদক্ষ করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন প্রশিক্ষন্ন কর্মশালা ও ট্রেনিংয়ে ব্যবস্থা করছি। তিনি যোগ করেন: মোবাইল ব্যাংকিংয়েও আমরা যথেষ্ট উন্নতি করেছি। সারাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। প্রতিদিন মোবাইল ব্যাংকিংয়েই এক হাজার কোটি টাকারও বেশি লেনদেন। এখন তো কোরবানির গরুও এখন অনলাইনে বিক্রি হয় বলে মন্তব্য করেন সংসদ নেতা।
দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়: শিক্ষার উন্নয়নের প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন:আমরা কাওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কাওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উবিষ্যত এখন উজ্জ্বল। আমাদের সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে জঙ্গীবাদ নির্মূল হয়েছে। আজ মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ অভিযানের কারণে দেশের প্রতিটি পরিবারের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন ভাবে কাজ করছে। আগামীতে ক্ষমতায় আসলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিচ্ছি।
তিনি যোগ করেন: বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তা সামনে অব্যাহত থাকবে। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে যে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, তা ধরে রাখতে তারা আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দেবে।
ক্ষমতায় এলে দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ: আমাদের অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে পারলে ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশের ভেতরে ঢুকতে পারবো। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ আমাদের উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ধরে রেখেছে। এটা ধরে রাখতে প্রয়োজন সরকারের ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে কাজ আমরা হাতে নিয়েছি, সেগুলো আমাদের শেষ করতে হবে। দারিদ্রসীমা কে আমরা আরো নিচে নিয়ে আসব। আমেরিকার দারিদ্র্যের হার ১৮ শতাংশ। আগামীতে ক্ষমতায় আসলে আমরা আমাদের দারিদ্রসীমা ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসবো। এরমধ্য দিয়ে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের ঘোষণা দিতে পারবো ইনশাল্লাহ্।
সংসদের সামনে উন্নয়নের চিত্র: উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অংশ গ্রহণের কথা সংসদকে জানিয়ে সংসদ নেতা তার সমাপনী ভাষণে বলেন:আমাদের যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে আমরা যুক্ত হয়েছি। এজন্য সারাদেশের রাস্তা-ঘাট, পুলের উন্নয়ন আমরা করেছি। আমাদের সময়ে সারা দেশের রেলের একটি ভালো যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা থেকে অতি দ্রুত আমরা চট্টগ্রাম যেতে চাই, আমরা দিনাজপুর যেতে চাই, আমরা ময়মনসিং, পটুয়াখালী, বরিশালসহ দেশের সব জায়গায় যেতে চাই। সেজন্য আমাদের পরিকল্পনা আছে। আশাকরি দ্রুতগতির রেল আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। এর পাশাপাশি নদীপথ গুলো ড্রেজিং করে নদীপথ গুলো সচল করবো।
দশম সংসদে গণতন্ত্রের ভীত মজবুত: বিরোধী দলেকে আমি(প্রধানমন্ত্রী) ধন্যবাদ জানায়। এই পার্লামেন্টে অনেক কিছু আমরা দেখেছি। কি পরিবেশ ছিল? সেটা এই বিরোধী দলের সময় আমরা দেখিনি। এই সংসদে ১৯৩ টি আইন পাস হয়েছে, এটি একটি রেকর্ড। এজন্য বিরোধী দলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি এতটুকু বলব গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হয়েছে, গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে, বিশ্বাস বেড়েছে; গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে যে দেশের উন্নয়ন হয় সেটা আজ প্রমাণিত। সারা দেশের মানুষের উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সুকান্তের ভাষায় বলে যেতে চাই:চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
জনগণের উন্নয়নই শেখ হাসিনার রাজনীতির মূললক্ষ্য জানিয়ে তিনি সংসদকে জানান: আমার বেঁচে থাকার কথা না। আমার বেঁচে থাকাটাই একটা এক্সিডেন্ট। গ্রেনেড হামলা, গুলি অনেক কিছু মোকাবেলা করতে হয়েছে। তারপরও আমি কখনো ভয় করিনি। আমার দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাব। আমি যে কাজ করে যাচ্ছি, এটা তো নিজের স্বার্থে নয়; দেশের মানুষকে একটি ভালো জীবন উপহার দেবার লক্ষ্যে।
সঙ্গে যোগ করেন: যতক্ষণ আছি এই দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাব। এদেশের মানুষকে যেন একটি সুন্দর জীবন পায়, যেই স্বপ্নটা আমার বাবা দেখেছিলেন; সেটা আমি নিশ্চিত করে যেতে চাই। দেশবাসীকে অনুরোধ করব, আপনারা আমাদেরকে ভোট দিন। দেশবাসীকে সেবা করার সুযোগ দিন, এই বাংলাদেশ আর পিছিয়ে থাকবে না।পিতার ভাষায় বলে যেতে চাই, বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।
সংসদের শেষ অধিবেশনে আমি সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিভিন্ন সময় আমি বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছি। আপনার আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন,আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ। আমার সব অর্জন বাংলাদেশের জনগণের, আমার কিছু নয়। আমার আমি বাংলাদেশের জনগণের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পেরেছি, এই সম্মান যেন বজায় থাকে। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, সেই আশা আমি রেখে যাচ্ছি। শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না, আর আমরা সেই সেটা বৃথা যেতে দেবোও না।
২৩তম সংসদই দশম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘আমাদের সময় সরকারের শেষ সময়ে এসে গেছে। এ পার্লামেন্টের এই অধিবেশনটা শেষ অধিবেশন। যদি যুদ্ধ-বিগ্রহ না হয় তাহলে এটাই সংসদের শেষ অধিবেশন’।