ছাত্রলীগ দিয়ে শুরু হওয়া শুদ্ধি অভিযান যুবলীগ হয়ে আওয়ামী লীগে যায় কিনা, এই আতঙ্ক যখন নেতাদের মধ্যে ভর করছে তখন অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বললেন: উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ অর্থ কোথায় যায়, তা খুঁজে বের করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে একথা বললেও ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া দুর্নীতিবাজ নেতারা যা বোঝার তা বুঝে গেছেন। এতদিন দল এবং সরকারকে ব্যবহার করে দুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলেও এখন যে আর তা করা যাবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত।
এখন প্রধানমন্ত্রীর এই প্রশ্নের জবাব কি দিতে পারবেন আওয়ামী লীগের নেতারা? কোথায় যায় উন্নয়নের জন্য দেয়া বরাদ্দের টাকা? তৃণমূল থেকে শুরু করে দলের হাইকমান্ড জানে এ টাকা কোথায় যায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে কোন ডিপার্টমেন্টকে, কোন ব্যক্তিকে কত টাকা পার্সেন্ট হিসেবে দিতে হয়, এটা হাইকমান্ডসহ গোয়েন্দা সংস্থার অজানা থাকার কথা নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে দেশের মানুষের ধারণা অনেক নেতা এই পার্সেন্টের অংশীদার হয়েছেন। অথচ এমনটা কখনোই হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু যা হওয়ার কথা নয়, তাই হয়েছে।
এসব কারণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন: দুর্নীতিবাজ যদি নিজের দলেরও হয়, তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। জঙ্গিবাদের মতো দুর্নীতির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চলবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি আমরা দেখেছি। বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রপ্রধানরা এখনও যখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ব্যর্থতার দিকে যাচ্ছেন, তখন এক্ষেত্রে সফল বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশকে রোল মডেল বলা হলেও খুব একটা বেশি বলা হবে না। বরং এটাই সত্যি।
এখন সেই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া যুদ্ধেও বাংলাদেশ সফল হবে বলে আশা করি। ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ এ বিষয়ে আশাবাদী করেছে। কারণ, আওয়ামী লীগের যে নেতারা এতদিন ব্রিফকেস আর প্যাকেটে বিশ্বাসী ছিলেন, তারাও এখন বলতে গেলে ‘রাম রাম’ শুরু করেছেন। এছাড়া যে তাদের আর কোনো উপায় নেই।
যুবলীগ চেয়ারম্যান শুরুতে তাদের কণ্ঠস্বর হলেও পরে সুর পাল্টাতে বাধ্য হয়েছেন। এর অন্যতম কারণ হলো- দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত আর শেখ হাসিনার কঠোর মনোভাব। তিনি হয়তো প্রথমে ভেবেছিলেন, শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথার কথা বলেছেন! অথচ যুবলীগের মতো একটা দলের চেয়ারম্যান হিসেবে আর দশজনের চেয়ে এ বিষয়টা তার আগে বোঝা দরকার ছিল। কিন্তু ‘স্বার্থের শ্যাম’ ঠিক রাখতে গিয়ে তিনি ‘আঙ্গুল চোষা’ টাইপ শব্দেরও অবতারণা করেছেন। যুবলীগের ব্যানারে কিভাবে এতদিন মাফিয়াগিরি ও ক্যাসিনো বাণিজ্য চলল, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে অবশ্য সেই জবাব তিনি এখনও দেননি!
উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ কোথায় যায়, সেই তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে হয়তো অবশ্যই আছে। আর সেই কারণে তিনি খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে মনে হয়। এরপরও এখানে বিশ্বব্যাংকের একটা ডেটা উল্লেখ করছি। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, বাংলাদেশের সড়ক নির্মাণে ভারত, চীন, ইউরোপের চেয়েও বেশি ব্যয় হচ্ছে। তখন তারা বলেছিল, ভারতে চার লেন সড়ক নির্মাণে গড়ে খরচ হচ্ছে ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার। চীনে খরচ ১৩ থেকে ১৬ লাখ ডলার, ইউরোপে খরচ হচ্ছে ২৫ থেকে ৩৫ লাখ ডলার। আর ঢাকা-মাওয়া চার লেন সড়কের প্রতি কিলোমিটার খরচ হচ্ছে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৭০ লাখ ডলার। রংপুর-হাটিকুমরুল সড়কে খরচ হচ্ছে প্রতি কিলোমিটারে ৬৬ লাখ ডলার।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, তুলনামূলক কম খরচ পড়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন সড়কে। সেটিও ইউরোপের খরচের সমান অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ২৫ লাখ ডলার। আর অস্বাভাবিক বাড়তি খরচের কারণ হিসেবে তারা দুর্নীতির বিষয়টিকেই সামনে এনেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুর্নীতি কারা করছে? নিশ্চয়ই ক্ষমতার বাইরে থাকা কারও পক্ষে এক্ষেত্রে দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। সব প্রকল্পেই সরকারের সাথে সম্পৃক্ত কিছু সুবিধাভোগী এই মহোৎসব করে যাচ্ছে। আর দুর্নীতি যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীনদের অজানা, তাও নয়।
এ কারণেই প্রবাসীদের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছেন: দুর্নীতিবাজ যদি নিজের দলেরও হয়, তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। ইতোমধ্যেই যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নাম ভাঙানো জিকে শামীম, সংসদ সদস্য নুরুন্নবী শাওন, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি-সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে।
এখন যাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তারা নিশ্চয়ই একা এমন কাণ্ড করতে পারেননি। তাদের সাথে সরকারি কর্মকর্তাসহ ক্ষমতার বলয়ের চক্র নিশ্চয়ই ছিল। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা জরুরি। এটা ঠিক যে, একজন মানুষের ত্যাগে যে কোটি মানুষের উপকৃত হতে পারে, তার উদাহরণ বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে এই চক্র ভোগ আর লুটপাটের নগ্ন উল্লাসে মেতেছে। এমনকি অবৈধ ক্যাসিনোতেও দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলিয়ে রেখেছে অপরাধীরা।
এই অভিযানের মাধ্যমে লুটেরাদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পুনরুদ্ধার হোক। কারণ, বঙ্গবন্ধু সবসময়ই লুটেরাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, কখনোই তাদের সহায়ক শক্তি ছিলেন না। তাই কোনো লুটেরা, দুর্নীতিবাজ যেন বঙ্গবন্ধুকে সাইনবোর্ড বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। আর চলমান অভিযানকে কুচক্রিমহল যেন কোনোভাবেই পক্ষপাতিত্বমূলক বা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে না পারে, সেই বিষয়ও নিশ্চিত করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)