হঠাৎ উদয় হলো এক আশ্চর্য দানবের। নাম তার আইএস। কী বীভৎস তার আবির্ভাব। কীভাবে গলাকাটা সহ নানারূপ আদিম হত্যাকাণ্ডের ভয়াল নৃশংস পাষণ্ডতার ভিডিও ওরা ছাড়লো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে। ইরাক-সিরিয়ার বিশাল অঞ্চলে ওরা প্রতিষ্ঠা করলো ‘খিলাফত’। ওদের প্রতিপক্ষের নারীসমাজকে ‘ভোগ্য পণ্যে’ পরিণত করে এক ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ ওরা প্রতিষ্ঠা করলো। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে উগ্র-উন্মাদ-ঘোর লাগা একদল মানব-মানবী ওদের সাথে যুক্ত হতে ব্যাকুল হয়ে পড়লো। মধ্যপ্রাচ্যের একদল নারী ওই ‘আইএস জ্বিহাদীদের’ সঙ্গে কয়েকমাস ধরে বসবাস করে গর্ভে ‘জ্বিহাদী সন্তান’ ধারণের গর্ব নিয়ে ঘরে ফিরে গেলো। হাজার বছরের ঐতিহ্যকে বেশ কয়েকটি স্থানে ওরা উড়িয়ে গুঁড়িয়ে দিলো তোপের দাগে।
হঠাৎ দানব-উদয়ের রহস্য কী? হিসাব শুরুতে অনেকেরই মিলছিলোনা। তারপর তথ্যের পর তথ্য যুক্ত হয়ে সত্য ভেদ হতে থাকলো। ইরাক-শার্দুল সাদ্দাম উৎখাতের পর বিশাল সাদ্দাম বাহিনী নিয়ে গড়ে তোলা হলো আইএস। ওদের অস্ত্র-শস্ত্র-সম্পদের মূল যোগদানদার কারা? এ প্রশ্নেই মিলে গেলো আসল জবাব। উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্য এবং তার তেলসম্পদকে কব্জায় রাখা। উদ্দেশ্য সিরিয়ার শাসক বাশার সরকারকে সমূলে উৎখাত করা। মধ্যপ্রাচ্যের ধনীদেশগুলো এই প্রকল্পে যুক্ত হলো মার্কিনী সিআইএ-র সঙ্গে। আইএস-এর প্রবল দাপটে একদিকে হৈ হৈ উল্লাস, অন্যদিকে শংকা আর কাঁপুনি। একদিন জানা গেলো ইরাকের বিশাল বিশাল তেলক্ষেত্র আইএস দাপটের এলাকায়, পাশ্চাত্যে তাদের স্বল্পমূল্যে তেল বিক্রিও চলছে ধুন্ধুমার। সেই অর্থে চলছে আইএস এর নারকীয় দুঃস্বপ্নের রাজত্ব। উদ্দেশ্য আর বিধেয় সমীকরণটি মিলছিলো, চলছিলো ভালোই। বাশার সরকারকে আইএস এবং অন্যবিধ সশস্ত্র গ্রুপ দ্বারা সাঁড়াশি চাপে শ্বাসরুদ্ধ করে নিঃশেষ করার কাজটি এগিয়ে চলছিলো জোর গতিবেগে।
বাশার সরকারকে চূর্ণবিচূর্ণ করার মার্কিনী-ইসরাইলী প্রকল্প হচ্ছে সেখানকার সর্বশেষ স্বাধীনচেতা অস্তিত্বকেও নিমূর্ল করে দেয়া। সাম্প্রতিককালে ইসরাইল প্রবল নাকানি চুবানি খেয়েছে যে লেবাননী হিজবুল্লাহ বাহিনীর হাতে, সেই হিজবুল্লা বাহিনী একদিকে সিরিয়া অন্যদিকে ইরানের বিশেষ সমর্থনপুষ্ট। এক ঢিলে অনেক পাখি মরবে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য হবে অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র। আইএস জন্মের পশ্চাতে এভাবেই গোপন ইসরাইলী উদ্দেশ্যেরও সন্ধান মিলেছে।
এদিকে উপরে উপরে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মহান রক্ষক’ মার্কিনী শাসকেরা ‘আইএস’ দমনে বোমা বর্ষণ করতে থাকলো হাজারে হাজারে। কিন্তু বোমাগুলো ভারি দুষ্টু। ওরা কেন যেন আইএস টার্গেট মিস করে বাশার সরকারের প্রতিষ্ঠানের দিকে পিছলে যেতে থাকে। মার্কিনী বোমা বাড়ে, আইএসও গর্দানে গতরে বড় হতে থাকে।
অবশ্য ক্রিয়া ডেকে আনে বিপরীত শক্তিকে। এই আইএস বিশাল দানবে পরিণত হয়ে খোদ রাশিয়ার বিপুল অঞ্চলকে গ্রাস করার ছক কষছিলো। দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে ছিলো সোভিয়েত কাঠামো, সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙ্গন-উত্তর রুশ ভল্লুক। সে ভল্লুক জেগে উঠে দেখে তার তাল্লুক, তার মুল্লুক হায়রে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। সোভিয়েত যুগের মতো সে আর আমল পায়না। অতএব পুতিন সরকারের আদলে রুশ ভল্লুকটি নড়ে চড়ে বসলো। ঠান্ডা মাথায় ভাবলো। তারপর এই সেদিন ‘গরম’ দিলো মধ্যপ্রাচ্যকে। জানান দিলো বাকী পৃথিবীকে। রুশ ভল্লুককে হিসাবে নিতেই হবে বিশ্ব মাতব্বরদের।
মার্কিনী পররাষ্ট্র মাতব্বর কেরি মিয়া জানালো, বাশার সরকারকে উৎখাত করতেই হবে আগে। রুশ ভল্লুক বললো, নো, নো, নো, তা হবে না। বাশার সরকারকে রক্ষা করাই হবে মূল কাজ।
রুশ ভল্লুক বুঝি কালক্রমে সোভিয়েত ভল্লুকের চেয়েও বেশি সেয়ানা। ওবামাদের বললো, চলো আমরা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো কোয়ালিশন গঠণ করে আইএস বিতাড়ন করি। ঠিক আছে, ওটা গড়তে দেরি হবে? দেখি আমি কী করতে পারি। যেই কথা অমনি উড়াল দিলো রুশ আকাশভল্লুক। আইএস-এর স্থাপনার মেরুদ- গুঁড়িয়ে দিলো আটচল্লিশ ঘণ্টাতেই। ওবামাকেন্দ্রিক পাশ্চাত্যের অনেকে হৈ চৈ করে উঠলো। আইএস নয় বাশারবিরোধী অন্য বিরোধীদলের ঘাঁটির উপর রুশ ভল্লুক বোমা ছুঁড়ছে… ইত্যাদি। ততোক্ষণে পৃথিবী জেনে ফেললো বাশার সরকারের সিরিয়া, ইরাক ও ইরান সরকার প্লাস লেবালনের হিজবুল্লা ২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে গোপনে গোপনে গড়ে তুলেছে এক বিশেষ মৈত্রী জোট। যার সাথে যুক্ত হতে চাচ্ছে গণচীন, ওদিকে রণক্ষেত্রে সব ফেলে পালাচ্ছে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ আইএস।
রুশ ভল্লুকের উদ্দেশ্য আর বিধেয়তে কতটুকু ফারাক সেটা তাদের হিসাবের ব্যাপার। আমরা দেখছি মধ্যপ্রাচ্যে এতোকালের মার্কিনী দাপটের চ্যালেঞ্জ হিসাবে রুশ ও তার মিত্রজোটের প্রবল উপস্থিতি। পলায়নপর আইএস দানবের উর্ধশ্বাস দৌড়। মধ্যপ্রাচ্যে এরপর ঘটনা কোন দিকে ধাবিত হবে জানিনা। তবে আপাতত: পৃথিবী জুড়ে প্রধান হিরো রুশ প্রেসিডেন্ট মিস্টার পুতিন। ‘যেমন ওল, তেমন বাঘা তেঁতুল’ বাংলা প্রবচনটি বেশ সুখ দিচ্ছে এদেশের ছোট বড় সাধারণকে। অবশ্য ওলের প্রতিক্রিয়া থামাতে এটা উপযুক্ত তেঁতুল কিনা, সেটা নিয়ে কেউ কেউ সন্দিহানও বটে!
ওদিকে এতোকালের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারত পড়েছে শাঁখের করাতে। এদিকে গেলেও কাটে, ওধারে গেলেও কাটে। ওদেশের উত্তর প্রান্তরে ঘটেছে এক রোমহর্ষক ঘটনা। আমাদের দেশের যেমন মসজিদের মাইক থেকে জামায়াতীরা রণযুদ্ধের মাতম তোলে, ভারতেও মন্দির থেকে গুজব ছড়ানো হলো, অমুক মুসলমানের ঘরের ফ্রিজে ‘গোমাংস’ আছে। ওই উত্তর প্রদেশে গোহত্যা নিষিদ্ধ। এই সুযোগ নিয়ে এমনি গুজবের মাতমে হিন্দু গ্রামবাসীদের প্রবল উত্তেজিত করে ওই মুসলমান গৃহকর্তা মোহাম্মদ আখলাখকে গণপিটুনীতে নির্মমভাবে হত্যার কাহিনী পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়লো। এমন নৃশংসতা, এমন বর্বরতা, এমন হৃদয়হীনতার খবরের উৎস হবে সাংবিধানিকভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারত, দ্রুত উন্নয়নকামী ভারত এটা স্মার্ট ‘বিশ্ব উদার’ মোদির সাথে নাকি যায় না!
অতএব চলছে সেখানে দ্বিমুখী খেলা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ‘ভদ্দরনোকী’ ভেক ধরে অরুণ জেটলি মার্কা কায়দায় ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্র দূষিত হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে। ওদিকে মাঠে ময়দানে ভারতের শাসকদলের পালের নানাবিধ গোদাগোষ্ঠী ‘গো-মাতার’ প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষার্থে পৃথিবীর সকল গোভক্ষককে নিমেষে তরবারিতে মস্তকচ্যূত করার মতো শোর তুলেছে।
এটারও উদ্দেশ্য রয়েছে, ভারতের বিহারে আসন্ন নির্বাচনী যুদ্ধ। সেখানে শাসকদলের জোটের বিরুদ্ধে ‘ধর্মনিরপেক্ষ জোট’ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে। এমনি বিহারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের মধ্যে ‘গো-বধ’ প্রশ্নে হিন্দুত্বের যোশ তুলে হিন্দু সাধারণ ভোটারের মাথা ‘গরম’ করে দেয়ার ঠান্ডা মাথার ‘অমিত শাহী’ কারবার চলছে সুকৌশলে। বিহারের নির্বাচনে মোদি বাহিনীর বিজয়ের এই হচ্ছে রোড ম্যাপ। ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ‘মোদী-অমিত শাহ’ জুটি এবার বিহারের বিধানসভা নির্বাচনেও বাজিমাত করতে পারে এই নোংরা-হিংস্র-নির্মম-নৃশংস সাম্প্রদায়িক খেলা খেলে। উদ্দেশ্য আর বিধেয়তে ফারাক হবার পরিস্থিতি যে দেখছিনা। গোটা ঘটনায় আসল এবং প্রধান পালের গোদা মোদি মহোদয় চুপ থেকে যে একেবারে ‘মৌন মনমোহন’কেও ছাড়িয়ে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত হয়ে এবার স্বদেশে আসি। এখানে অনেকটা বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর ‘নিরাপত্তার’ কারণে স্থগিত করে দিলো খোদ অস্ট্রেলিয়া। এর পর পরই অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে সন্ত্রাসী গোলাগুলিতে দু’জন নিহত হলো। তবুও অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ‘অটুট ও চমৎকার’ বিরাজ করতে থাকলো। ওখানে কোথাও কোন ‘অ্যালার্ট সিগন্যাল’ পড়লোনা কোন দেশের কোন নাগরিকের জন্যই।
তারপর হঠাৎ? বাংলাদেশের কূটনৈতিক পাড়ায় এক ইতালীয় নাগরিক মোটরসাইকেলবাহী দুর্বৃত্তের গুলিতে প্রাণ হারালো। পরদিন রংপুরের নিভৃত বিশেষ ঘাস জন্মাবার সাধনায় নিবেদিত একজন জাপানী মানুষকে মোটরসাইকেলযোগে একই কায়দায় হত্যা করা হলো। ওদিকে বিশেষ ওয়েবসাইটযোগে পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া হলো আইএস এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সমগ্র পৃথিবী জানলো বাংলাদেশ ‘অনিরাপদ’।
মার্কিনী ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলায় দশজন নিহত হলেও সেদেশ ‘নিরাপদ’। অস্ট্রেলিয়াও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েও ‘নিরাপদ’। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘নারী ক্রিকেট’ দলও তাদের বাংলাদেশ সফল বাতিল করলো।
হঠাৎ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি এমন ‘অস্থিতিশীল’ করে দেয়ার উদ্দেশ্য কী? একাত্তরের চট্টগ্রাম-টেরর সাকাচৌ আর ফরিদপুরের পামর ‘বীর মুজাহিদ’ যুদ্ধাপরাধের দায়ে এখন চূড়ান্ত শাস্তির বিশেষ পর্যায়ে। ধনে-জনে-দাপটে যুদ্ধাপরাধী চক্র পৃথিবী জুড়ে এখন দাপাচ্ছে। বাংলাদেশে এমন বিপাকে বেকায়দায় ব্যাকফুটে থাকাটা তারা সহ্য করতে পারছেনা। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতএব এই বিদেশি হত্যাকাণ্ড।
২০১৩-১৪ তে ওরা সর্বোচ্চ সাধ্যে আঘাত করেছিলো বিশ দলীয় জোটের আড়ালে। ২০১৫ তে ওরা আগুনে বোমা ব্যবহার করে নৃশংসতার নব অধ্যায়ে ‘আগুনসন্ত্রাসী’র পরিচিতি পেয়েছে। দু’টি প্রবল আঘাতেই ওরা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। অমন পরাজয় না মেনে নেবার আদর্শিক এবং জাগতিক উগ্রতা ওদের যথেষ্ট পরিমাণেই আছে।
ওদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশ এবং পৃথিবী আতংঙ্কিত হয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপদ এবং বিনিয়োগবান্ধব ভাবমূর্তি বিঘ্নিত হয়েছে। এমনি আঘাত নানাভাবে নানারূপে ওরা হানবেই।
প্রশ্ন হচ্ছে ওদের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হবে কিনা? ওদের আসল বিধেয় পূরণ হবে কিনা?
এই প্রশ্নে বাংলাদেশ এক নবপর্বে উন্নীত হলো। অচিরেই একদিকে অন্যতম প্রধান দুই যুদ্ধাপরাধীর চূড়ান্ত শাস্তি নিশ্চিতকরণের আয়োজন চলবে। অন্যদিকে ওদের জোটের আড়ালে চলবে নব নব অভাবনীয় আঘাত। উদ্দেশ্য এবং বিধেয়কে এক সমীকরণে নিয়ে আসার জন্য ওরা চালাবে মরণপণ আঘাত। আইএস এর মতো আত্মঘাতী বাহিনী গড়ে সেটা দিয়ে মুজাহিদের ভাষায় ‘যুদ্ধাপরাধ-ফুদ্ধাপরাধ’ নিমেষে ‘উড়িয়ে দেয়া’ হবে যে করেই হোক।