রাজধানী ঢাকার একটি আবাসিক এলাকা হচ্ছে উত্তরা। এখানে বসবাসকারীদের অধিকাংশই বিত্তবান বা উচ্চ মধ্যবিত্ত। উত্তরা মডেল টাউন একসময় বিল-ঝিল, ডোবা-নালা আর ধান খেতে ছিল পরিপূর্ণ। তুরাগ নদীর পাশে উত্তরা মডেল টাউনটির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। থানার কার্যক্রম চলে দুই ভাগে-উত্তরা পূর্ব থানা, উত্তরা পশ্চিম থানা। আবাসিক এলাকা হিসেবে এখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় দালান, বিল্ডিং ইমারত। এলাকার সড়ক ও লেনগুলো বেশ প্রশস্ত। উত্তরা মডেল টাউনটি বিশটি সেক্টরে বিভক্ত। প্রায় প্রতিটি সেক্টরের সাথেই রয়েছে পার্ক ও খেলার মাঠ। সেখানে শিশু-কিশোররা খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের মানসিক উৎকর্ষ সাধনে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। পার্ক ও মাঠ গুলোর সংলগ্ন শারীরিক ব্যায়াম ও হাঁটার সুবিধা রয়েছে। উত্তরা মডেল টাউনে আছে বড় বড় শপিং মল, শপিং কমপ্লেক্স, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, ক্লিনিক। আছে রেস্টুরেন্ট ও ফাস্ট ফুডের দোকান, বিউটি পার্লার।
এলাকায় সবচাইতে বেশি আছে কিন্ডার গার্টেন যা ব্যক্তি মালিকানা স্কুল। এরকম স্কুল বর্তমানে দেশের সর্বত্র চলছে বাণিজ্যিকহারে। এই বাণিজ্য উত্তরায় আরো বেশি রমরমা। স্কুলগুলো গড়ে উঠেছে উত্তরার অলিতে-গলিতে, ভবনের ফ্ল্যাটে, গ্যারাজে। নিজস্ব মালিকানা হওয়ায় ইচ্ছামত এইসব স্কুল খুলে নিয়ে বসা যায়। আবার ইচ্ছামত বন্ধও করে দেয়া যায়।
এখানে কাজী নজরুল ইসলামের উদ্দীপনামূলক কবিতা “থাকব না কো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগত টাকে”- বৃথা। এখানে বাইরের জগৎ দেখার মতো সুযোগ শিক্ষার্থীদের নেই। বড় গাছ, নীল আকাশের নীচে খোলা সবুজ মাঠ স্কুলের চারপাশে এখানে নেই।
একটি বাস্তব উদাহরণ- রাজধানী ঢাকা শহরে পড়ানোর জন্য গ্রাম থেকে নিকট আত্মীয় এক বালককে এনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে (প্রতিষ্ঠানটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে শুরু করে পরে বন্ধ হয়ে যায়) ভর্তি করা হল। শ্রেণিতে প্রথম হয়ে সে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। ওই শ্রেণিতে পাশের হার শতভাগ এবং ছাত্রসংখ্যা তিনজন। ছেলেটি একটু বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে টিকতে না পেরে এখন প্যারা মেডিকেলে অধ্যয়ন করছে।
যে স্কুলে সে ভর্তি হয়েছিল ওইসব বিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামতো চলে শিক্ষক নিয়োগ কিংবা ছাঁটাই। এমনও জানা যায় গ্রাম থেকে আসা শিক্ষিত বেকার যুবক ছয় সাত মাস ধরে শিক্ষকতা নামক চাকরিটি করছেন আর আশায় আশায় প্রহর গুনছেন; বেতন পেলেই ঘড়ভাড়াসহ যাবতীয় ঋণ পরিশোধ করবে। অবশেষে দেখা গেল বেতন না দিয়েই তাকে চাকরি থেকে ছাটাই করা হলো। উপরন্তু নানান কায়দা-কৌশলে তার নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের অভিসন্ধিও করা হয় কখনো কখনো। দেখা যায়, শূন্যপদে বসানো হলো ইন্টারমিডিয়েট পাশ মধ্য বয়সী কোনও মহিলা যার অলস দুপুর কাটছিল না। ভদ্রমহিলার ধমক শুনে শিশুরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
এইসব স্কুলে অভিভাবকদের চলে তোষামোদ সুলভ আচরণ। সর্বোপরি, শিক্ষকরা এখানে শোষিত। দেশে ভালো মানের শিক্ষার্থী তৈরি করতে হলে এইসব কথিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া জরুরী।
উত্তরার সেক্টরগুলোর ভেতরে যেসব লেক রয়েছে, তা আধা অথবা একেবারেই শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। লেকের পাড়ে ফুটপাতে চলে আরেক বাণিজ্য। তবে লেক সংলগ্ন ফুলের নার্সারিগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। কিন্তু ফুটপাতে বা রাস্তায় বাণিজ্যের কারণে পথচারীদের হাঁটায় বিঘ্ন ঘটে। যার প্রভাব বড় রাস্তা বা মেইন রোড পর্যন্ত চলতে থাকে।
উত্তরার মতো একটি এলাকায় সরকারি কোন কলেজ নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের বাসে চড়ে অন্যত্র কলেজ করতে হয়। দেশে শিক্ষা ও সংস্কৃতি এগিয়ে চলছে ধাপে ধাপে। শিক্ষা ও অনুশীলনের অন্যতম মাধ্যম বই। তাই পাঠ্যবই ছাড়াও শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশে গ্রন্থাগার কিংবা লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করে পড়া দরকার। আলোকিত মানুষ গড়ার অভিপ্রায়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিই এলাকার বইপ্রেমীদের একমাত্র ভরসা।
উচ্চবিত্ত ছাড়াও উত্তরায় কিছু সংখ্যক নিম্ন আয়ের লোক বাস করেন। বিশেষ করে গার্মেন্টস কর্মী। গ্রাম থেকে আসা নারী-পুরুষ পরিবারের অভাব ঘোচাতে আপনজন দের ছেড়ে শহরমুখী হয়েছেন কাজের সন্ধানে। সময় আর আর্থিক সংকটের কারণে ঘন ঘন আপনজনের কাছে ছুটে যাওয়া সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বিনোদন। এই বিনোদনের একটি অংশ হতে পারে হলে বসে সিনেমা দেখা। আশির দশকে গার্মেন্টস কর্মী বা শ্রমিকদের হলে বসে সিনেমা দেখার উৎসাহ ছিল প্রবল। গার্মেন্টস শিল্প প্রসারে চলচ্চিত্রের অবদান অনস্বীকার্য। শাবানা-আলমগীরের মত অভিনেতাদের সুনিপুণ অভিনয় দেখে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি অনেকের পক্ষে নিজেকে বদলানোরও সম্ভব হয়েছে। উত্তরার মতো জনবহুল এলাকায় সিনেমা দেখার জন্য যেতে হয় উত্তরার বাইরে।
সিনেমা হলের পাশাপাশি শিশু কিশোরদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণ করাও প্রয়োজন। শিশু কিশোররা সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখে যেমন আনন্দ পাবে তেমনি ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা বাড়বে। এরকম অনেককিছুই দরকার উত্তরায়। উত্তর সিটি কর্পোরেশন কতোটা কী দেখে আমরা জানি না। আনিসুল হক বেঁচে থাকলে হয়তো পরিবর্তনটা আমরা বুঝতে পারতাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)