চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

উত্তম গান: চ্যানেল আই’র স্মরণীয় অনুষ্ঠান

উপমহাদেশ জুড়ে অত্যন্ত খ্যাতিমান, জনপ্রিয় বা অনেক মানুষের স্বপ্নপুরুষ, কিংবদন্তি- যেভাবে ইচ্ছে যাকে চিহ্নিত করা যায়, তিনি হলেন রুপালি পর্দার মানুষ উত্তম কুমার। তাকে ভালোবাসেননি এমন মানুষ দুর্লভ। বর্তমান প্রজন্মেও মানুষের সামনে তিনি নেই। কিন্তু কেউ তাকে ভোলেনি। কোথাও কোন কারণে তার কথা উচ্চারিত হলে, তার কোন সিনেমার ছবি দেখা গেলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন, একঝলক হলেও তাকিয়ে দেখেন। সেই স্বপ্নমানব উত্তমকে নিয়ে টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’ মনমুগ্ধকর একটি অনুষ্ঠান প্রচার করল গত শুক্রবার। অনুষ্ঠানটি এতটাই ভালো হয়েছে যে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছেন অনেক টিভি দর্শক। টিভিতে এমন ভালো মানুষের মনকে দোলা দেয় এমন অনুষ্ঠানের বড় আকাল চলছে। তার মধ্যে এ অনুষ্ঠানটি যেন অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে।

অনুষ্ঠানের নামটিই ছিল উত্তম কুমারকে ঘিরে ‘উত্তম গান’। উত্তমের প্রয়াণ দিবস ছিল গত শুক্রবার। সেই দিনটি স্মরণেই অনুষ্ঠানের আয়োজন। অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং করা হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে। তবে পর্দায় দেখে মনে হয়েছে ‘লাইভ সম্প্রচার’ এর মতো। একঝাক দর্শক ছিলেন মঞ্চের সামনে। তবে ব্যক্তিক্রম ছিল কিছুটা, সেই দর্শকদের প্রায় সবাই ছিলেন নানাভাবে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তি। টিভির ছোট্ট একটি গানের অনুষ্ঠানে এত গুণী-মানী ব্যক্তির সমাবেশ খুব একটা দেখা যায় না। এ অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক, সাংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব মাহবুব জামিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, অভিনেতা আবুল হায়াত, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী রাজনীতিক নাজমুল হুদা ও বিবিসি বাংলার প্রধান সাবির মোস্তফা।

অনুষ্ঠানের অতিথিদের ব্যাপারে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল সাদা পোশাক। পুরুষ অতিথিদের পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা এবং মহিলা অতিথিরা পরেছিলেন সাদা শাড়ি। উভয় পোশাকেই কারুকাজ ছিল। শুধু এতেই শেষ নয়, পুরো মঞ্চই ছিল সাদায় সাদায় সাদাময়। এক কথায় অনুষ্ঠানের পুরো পরিবেশটিই সাজানো হয়েছিল মনোরম করে। টেলিভিশনের পর্দায় অনুষ্ঠানটি দেখতে দেখতে আবেগাপ্লুত হয়ে দর্শক নিজেই যেন ‘সাদা মনের মানুষ’ হয়ে উঠেছিলেন। এটাও আমাদের টিভি মিডিয়ার গড়পড়তা অনুষ্ঠানের ভিড়ে খুব একটা দেখা যায় না।

মনকাড়া, স্মরণীয় এবং স্মৃতি জাগানিয়া একঝাক গানের মাঝে বিজ্ঞ দর্শক-শ্রোতার পাশাপাশি উত্তম গান অনুষ্ঠানের আকর্ষণ ছিল আরও কিছু বিষয়। কথার জাদুসহ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সব্যসাচী কথাসাহিত্যিক-কবি সৈয়দ শামসুল হক। চলচ্চিত্রে উত্তম গেয়েছেন এমন অসংখ্য গানের মধ্য থেকে বাছাই করা কয়েকটি গানে বর্তমান এবং আগের প্রজন্মের কয়েকজন শিল্পী কণ্ঠ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, রফিকুল আলম, ফেরদৌস আরা, কনক চাঁপা, রিজিয়া পারভীন, মনির খান, কোনাল, ইমরান ও ঝিলিক। তারাও সাদা পোশাকে ছিলেন। এসব কিছু ছাপিয়ে গেছেন উত্তমের স্বর্ণযুগের নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। তিনি উপস্থিত ছিলেন তার সম্পূর্ণ আবেগাপ্লুত অনুভূতি নিয়ে। তার কিছু কথা সবাইকে, উপস্থিত দর্শক যেমন তেমনি টিভি পর্দার সামনে বসে যারা উপভোগ করেছেন তাদেরও, অনির্বচনীয় আনন্দ দিয়েছে, নষ্টালজিয়ার উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। পুরো অনুষ্ঠান ভরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তার স্বভাবজাত টুকরো মিষ্টিভাষার কথোপকথনে। সুপ্রিয়া ও সৈয়দ হকের মুখোমুখি টুকরো কথামালা ‘উত্তম গান’র আরেকটি ভালোলাগা বিষয় ছিল বললে ভুল বলা হবে না। শুধু তারা দুজনই নয়, অনুষ্ঠানে বেশ কিছু বিষয় যোগ করেছেন অনুষ্ঠানের বিজ্ঞ দর্শকরাও। তাদের কথার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের উত্তম পর্ব সম্পর্কে কিছু কথা বেরিয়ে এসেছে। সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন উত্তমের অনেক ছবির নায়িকা। তার কথার মধ্যে, উত্তমের জন্য এখনও তার মন কেমন করে সেই ভাবটি ফুটে উঠেছিল। তবে সুপ্রিয়াকে আরও কিছু কথার মুন্সিয়ানা দিয়ে উত্তমের কথা বলতে যেন জাগিয়ে তুলেছিলেন সৈয়দ হক।

আর দর্শকরা যা যোগ করেছেন তাও কম যায় না। বর্ষীয়ান রাজনীতিক মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যৌবনে মাথাভর্তি চুল ছিল, সে চুল কিভাবে উত্তমের মতো আচড়ানো যায় তা নিয়ে অনেক ভাবতেন বলে জানালেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকেরও ছিল সুচিত্রার জন্য ‘এক ধরনের উদাস উদাস ভাব’, তাও জানিয়ে দিতে ভোলেননি। এমনভাবে সবাই উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে তাদের মনে গোপন কথাগুলো তুলে ধরেছেন অনুষ্ঠানে। সব মিলিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মনে অন্যরকম এক আবেগ তৈরি করেছিল ‘উত্তম গান’।

এমন একটি সুন্দর অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার কৃতিত্ব যদিও চ্যানেল আই’র, তবুও এমন একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা যিনি মাথা থেকে নামিয়েছেন সিংহভাগ কৃতিত্ব আসলে তারই। সেজন্য অশেষ ধন্যবাদ পাবেন টিভি এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। তিনি উত্তম গান অনুষ্ঠান শুরু করে তার উপস্থাপনার ভার তুলে দিয়েছেন সৈয়দ হকের হাতে। বাংলাদেশে টিভি মাধ্যমে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভিন্নমাত্রা যোগ করে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন হাতেগোনা যে কয়েকজন সৃজনশীল পুরুষ তাদের মধ্যে শাইখ সিরাজ জায়গা করে নিয়েছেন নিজ প্রতিভার গুণেই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ফজলে লোহানী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি এখন নিজ গৌরবেই বিরাজমান শাইখ সিরাজ। তবে উল্লিখিত বরণীয় ব্যক্তিরা তাদের টিভি সম্পর্কিত সৃষ্টিকর্মে শুধু বিনোদনকেই বড় করেছেন। সে ক্ষেত্রে শাইখ সিরাজ সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও সঙ্গী করেছেন টিভি অনুষ্ঠানে। তার পরিকল্পিত-পরিচালিত ‘মাটি ও মানুষ’ সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান একদিকে সামাজিক অন্যদিকে উন্নয়ন দায়বদ্ধতাকে পূর্ণ করেছে। তার বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান যেমন কৃষি বাজেট-কৃষকের বাজেট, কৃষকের ঈদ আনন্দ-বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ টিভি উপস্থাপনা বললে অত্যুক্তি হবে না মনে করি।

উত্তম গান দেখে মুগ্ধ হয়ে এর ভেতরের কথা কিছু জানতে ফোন করেছিলাম অনুষ্ঠানের স্রষ্টা শাইখ সিরাজকে। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী কথাবার্তায়। আগ্রহ নিয়ে আমার প্রশ্নের জবাবে কিছু তথ্য জানালেন। কেন তিনি এমন একটি অনুষ্ঠান করলেন? বললেন, প্রথমত চলচ্চিত্রের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, দ্বিতীয় উত্তম কুমারের প্রতি ভালোবাসাই কাজ করেছে এমন অনুষ্ঠানের পেছনে। বললেন, ছোটবেলা থেকে সিনেমার পাগল ছিলাম, ভালোবাসতাম নায়ক উত্তমকেও। সেটাই মূল প্রেরণা। যারা একসময় উত্তম যুগের ছবি দেখে দেখে উত্তমকে স্বপ্নপুরুষ মনে করতেন, তাদের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতেই এবার উত্তমের প্রয়াণ দিবসে এই আয়োজন চিন্তা মাথায় ঢোকে। চলচ্চিত্র সম্পর্কিত আরও অনুষ্ঠানও তিনি করেছেন আগে। এটা তারই ধারাবাহিকতা।

পুরো অনুষ্ঠানটি সাদাময় করার বিষয়টিও তার পরিকল্পিত বলে জানালেন শাইখ সিরাজ। এজন্য অতিথিদের সঙ্গে নিজে কথা বলে রাজি করিয়েছেন সাদা পোশাক পরে আসতে। বিষয়টি সব অতিথিই পজিটিভভাবে নিয়েছেন। তাদের ভালো লেগেছে।

ভালো কিছু করতে হলে চিন্তাভাবনাকেও মুক্ত করে দিতে হয়। শাইখ সিরাজ তাই করেছেন। মুক্তচিন্তা এবং ভালো কিছু করার মানসিকতাই তাকে অনেক ভালো অনুষ্ঠান করার সুযোগ এনে দিয়েছে। এভাবে শাইখ সিরাজ এবং চ্যানেল আই মুক্তচিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাবেন, উত্তম গান দেখে সেটা আরও ভালোভাবে মনে হয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)