চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

উত্তম-আকাশে ডানা মেলা সুপ্রিয়া

বাংলা সিনেমায় মহানায়ক উত্তম কুমারকে ঘিরে যে নায়িকাবৃত্ত, তার প্রথম দুই নাম অবশ্যই সুচিত্রা সেন এবং সুপ্রিয়া দেবী। প্রায় পাশাপাশি উচ্চারিত হতে পারে মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের নামও। তবে এঁদের মধ্যে সুপ্রিয়াই নায়ক উত্তমের পাশাপাশি একান্ত আপন করে পেয়েছিলেন ব্যক্তি উত্তমকে। উত্তম-সুপ্রিয়ার সম্পর্ক একটা সময় বাংলা সিনেমা জগতের হট টপিক ছিল। উত্তমের মৃত্যু সম্ভবত তার মতো করে আর কাউকে নিঃসঙ্গ করেনি। তার পর প্রায় ৩৮ বছর ধরে তিনি উত্তমের স্মৃতি জড়িয়ে ছিলেন। কথায়-বার্তায়, আলাপ-আলোচনায় বারবার তার মুখে ফিরে ফিরে আসত ‘তোমাদের দাদা’র কথা।

সিনেমার জগত ছাড়াও বাস্তবেও সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের এক গভীর সম্পর্ক ছিল। নিজের স্ত্রী এবং বাড়ি ছেড়ে নিজের জীবনের শেষ সতের বছর তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই কাটিয়েছেন। সুপ্রিয়া দেবীও নিজের স্বামীকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে উত্তম কুমারের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। যদিও, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে হয়নি।

সেসময়কার নায়িকা হয়েও সুপ্রিয়া দেবীর জীবন ছিল খোলা পাতার মতো। ভীষণই আধুনিক ছিলেন তিনি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলা ভাষায় লেখা আত্মজীবনী ‘আমার জীবন, আমার উত্তম’ নামক গ্রন্থে। বাঙালি তার আত্মজীবনীতে প্রেম, যৌন জীবন, যৌন প্রবণতা, স্ক্যান্ডেল লুকিয়ে যায়। কিন্তু সুপ্রিয়া দেবী অকুতোভয়, খোলামেলা।‘আমার জীবন, আমার উত্তম’-এ সুপ্রিয়া দেবী তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অত্যন্ত খোলামেলা কথা বলেছেন। এক্কেবারে গলফ খেলোয়ারদের মতো একটা করে শট মারছেন, আর সেটা যে কোথায় গিয়ে পড়ছে কেউ জানে না। বাঙালি মাত হয়ে যাচ্ছে। এমনকী বইটার শেষের দিকে উত্তমকুমারের লেখা অত্যন্ত ব্যক্তিগত চিঠিও রয়েছে। যেখানে উত্তম কুমার অত্যন্ত আদরণীয় বিশেষণে সুপ্রিয়া দেবীকে ডাকছেন। ওই চিঠিতে সু্প্রিয়া দেবীর শরীর, রাতের পোশাক নিয়ে মহানায়কের মতামতসহ অনেক ‘ব্যক্তিগত’ বিষয় রয়েছে। বাঙালি নারীর এমন উচ্চারণ সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ‘নীরা’ হতে চাননি। যাবতীয় ট্যাবু ভেঙ্গেছেন। বেঁচেছেন মাথা উঁচু করে, নিজের পছন্দকে সম্মান দিয়ে।

চ্যানেল আই অনলাইন- উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী
উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী

প্রথাগত ‘নায়িকা’র ইমেজ তিনি ভেঙ্গে ফেলেছেন। বস্তুত তিনি যখন ছায়াছবির জগতে আসেন, তখন নায়িকাদের যে অভিব্যক্তির ধরন ছিল, তারা রোমান্টিক, পেলব ও গীতিকবিতা মুখর হবে। কানন দেবী থেকে সুচিত্রা সেন পর্যন্ত সেই ঐতিহ্যের ধারবাহিকতাই লক্ষ করা গেছে। সেখানে সুপ্রিয়া উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যেন তিনি নিজেই এক ‘লাবণ্য।’

সুপ্রিয়া দেবীর মধ্যে ছিল এশিয় ও ইউরোপিয় সৌন্দর্যর এক আশ্চর্য মেলবন্ধন। যে ‘প্রত্নপ্রতিমা’র ছবি ঋত্বিকের ক্যামেরায় বারবার ধরা পড়েছে, সুপ্রিয়া ছিলেন সেই প্রতিমার আদর্শ উদাহরণ। কেননা, তার মুখের গঠন, চেহারা ছিল, যাকে বলে ‘ঠিক দুর্গা দেবীর মতো’। আর সেই প্রবাদপ্রতিম সৌন্দর্যকে নতুন হাতে এঁকেছিলেন ঋত্বিক। আর কিছু নয়, বারবার সেই আশ্চর্য সাদাকালো কাব্যে ‘নীতা’র বোধন থেকে বিসর্জন পর্যন্ত তাই যেন মিশে গেছে প্রচলিত কাব্যধারার ‘নায়িকা’র সংজ্ঞা। সেই কাব্যধারার রূপ-গন্ধকে নতুন করে পূরণ করেন সুপ্রিয়া দেবী। শুধু তাই নয়, সুপ্রিয়ার সঙ্গে আশ্চর্য মিল ছিল ইউরোপিয় জনপ্রিয় নায়িকাদের।

কেউ কেউ বলতেন, প্রায় সমসাময়িক সোফিয়া লোরেনের সঙ্গে অদ্ভুত মিল ছিল সুপ্রিয়ার। শুধু সোফিয়াই নন, আদর্শ ইতালিয় সুন্দরী বলতে যা বোঝাতো, তার প্রায় সমস্তটাই মিলে যেত সুপ্রিয়ার সঙ্গে। ১৯৩৪ সালে ইতালির রোমে জন্ম নিয়েছিলেন সোফিয়া, আর তার একবছর আগে সুপ্রিয়া জন্মেছিলেন বার্মায়। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই অপূর্ব সুন্দরীর মধ্যে তাই তুলনা চলে এসেছিল স্বাভাবিক নিয়মে। এক ধরনের বলিষ্ঠ, দীপ্ত, অ্যাসার্টিভ ব্যক্তিত্ব সুচিত্রা সেনের মধ্যেও ছিল। মূলধারার ছবিতে কিন্তু সেইরকম ব্যক্তিত্বই একই সময়ে সুপ্রিয়া কীভাবে ভিন্নতার সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন তা বোঝার জন্য আরও নিবিষ্ট নিরীক্ষার প্রয়োজন। সিনেমা জগতে যারা ‘স্টার’, তাদের শুধু অভিনয় করলেই চলে না, এক ধরনের ‘পারসোনা’ বয়ে নিয়ে চলতে হয় যা হয়ে ওঠে এক একটি যুগের প্রতীকের মতো। সুপ্রিয়া দেবী তা পেরেছিলেন। সবাই যা পারেন না।

মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘কোমল গান্ধার’-এর সুপ্রিয়াকে সরিয়ে রেখে যদি বাণিজ্যিক ছবির দিকে তাকানো যায়, তাহলে আমরা দেখি এক স্বতন্ত্র সুপ্রিয়া দেবীকে। অসিত সেনের ‘স্বরলিপি’, অজয় করের ‘শুন বরনারী’, মঙ্গল চক্রবর্তীর ‘তিন অধ্যায়’, উত্তমকুমারের পরিচালনায় ‘বনপলাশীর পদাবলী’, কিংবা হেমচন্দ্র চন্দ্রর ‘নতুন ফসল’, এমনকী ‘দেবদাস’ ছবিতে পারোর পরিবর্তে চন্দ্রমুখী চরিত্রে অভিনয় করেও সুপ্রিয়া প্রমাণ করেছিলেন তার অভিনয়ের ভার্সাটিলিটি। হ্যাঁ, তিনি সহশিল্পী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো কমেডি করতে পারতেন না ঠিকই, কিন্তু অভিজাত সমাজের নারী চরিত্রে তিনি ছিলেন অনবদ্য। উদাহরণ, ‘শুধু একটি বছর’, ‘উত্তরায়ণ’, ‘কাল তুমি আলেয়া’ বা ‘চিরদিনের’। পোশাক এবং হেয়ার স্টাইলেও নতুনত্বের চমক সুপ্রিয়া এনেছেন বারবার। তবে নিশ্চিতভাবেই তাকে সব থেকে ভালো লেগেছে ঘরোয়া মধ্যবিত্ত বাঙালি চেহারায়। যেমন, ‘সুরের পিয়াসী’, ‘অয়নান্ত’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘দুই পৃথিবী’ বা ‘বিষকন্যা’ ছবিগুলোতে।

শুধু অভিব্যক্তি নয়, শরীরি ভাষা ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সুপ্রিয়া দেবীর অনবদ্য। আমরা যদি ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, সনৎ-এর সঙ্গে নীতার সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটক দেবী ও মানবীর সেতুবন্ধনে সুপ্রিয়াকে যে রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাতে সুপ্রিয়া, এবং একমাত্র সুপ্রিয়াই পক্ষেই সম্ভব হয়েছে সনৎ বা অন্য যে কোনও পুরুষের উপস্থিতিকে তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর করে দিতে। এমনকী ‘দাদা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’, এই যে প্রাক শেষ সিকোয়েন্সটি, সেখানে টেলিফটো লেন্সে সুপ্রিয়ার যে দেহাংশ মুদ্রিত আছে, বা ধরা যাক ‘কোমল গান্ধার’-এ অনুসূয়াকে কোপাইয়ের সামনে যেভাবে বর্ণনা করা আছে, সেটা যেন একেবারেই রেঁনেসা যুগের অসাধারণ ইতালিয় চিত্রকর সান্দ্রো বতিচেল্লির আঁকা দীর্ঘগ্রীবা নারীদের অনূকরণ। এবং এই প্রতিরূপ আঁকা ঋত্বিক ঘটকের পক্ষে যেমন সম্ভব, তেমনই এটা অন্য কোনও বাঙালি, যারা সুপ্রিয়ার সমকালীন, যেমন সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেন, মাধবী মুখোপাধ্যায় বা কাবেরী বসু, তাদের পক্ষে করা সম্ভবই ছিল না। বস্তুত উত্তর স্বাধীনতা পর্বে যখন সুপ্রিয়া বাংলা ছায়াছবির পর্দায় এলেন, তার মধ্যে স্বাধীনতা উত্তর স্বপ্নহীন নারীর লাবণ্যহীনতা সহজে ফুটে উঠেছিল।

চ্যানেল আই অনলাইন- সুপ্রিয়া দেবী
সুপ্রিয়া দেবী

অনেকে সুপ্রিয়া দেবীকে লিজ টেলরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। লিজ বা সুপ্রিয়ার বিভিন্ন অভিনয়ে দেখা যায়, তিনি একদিকে তার শরীরকে একটি ভ্রমণ কেন্দ্র ও পুরুষের আহ্লাদের কেন্দ্র হিসাবে ভাবাতে পেরেছেন। আবার অন্যদিকে আতঙ্ক অর্থাৎ ফ্রয়েড যে ফ্রাস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের কথা বলেন, সেভাবেও ভাবাতে পেরেছেন। ১৯৫৯ সালে যখন তিনি ‘আম্রপালি’ করেছিলেন, তখন তার নৃত্য পটিয়সি ভূমিকা দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু একই সঙ্গে, এরকম সাবলীল শরীরের ব্যবহার আর কোনও বাঙালি নায়িকা ৫০ ও ৬০-এর দশক জুড়ে দেখাননি। তিনি দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছেন। তিনি অ্যাগ্রেসিভ অভিনয় করতেন। তাই, তিনি শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যাদীপের শিখা বা বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা নন। বরং একজন স্বাধীন নাগরিক সত্তা। সেই নাগরিক সত্তা তার মুখচ্ছবির মধ্যেও আছে। তিনি সেই অর্থে সংস্কৃত কাব্যের সুন্দরী নন। বরং বাংলার আটপৌড়ে বনলতা সেন। তাকে আমরা সাধারণ শাড়ি ও সাধারণ আঁচল, এর মধ্যেই দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু সেখানেও তিনি যখন, ‘বিলম্বিত লয়’ ছবিতে ‘এক বৈশাখে দেখা হল দু’জনায়’ গেয়ে ওঠেন, তখন বোঝা যায়, বাংলার শহরেও কোথাও কোনও হাসপাতালের সামনে দারুচিনি বৃক্ষ থাকে!

বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী, চলচ্চিত্রে পদচারণা ৫০ এরও অধিক সময়। তিনি অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন। দক্ষ অভিনয়, অনবদ্য কৌশল এবং তার মুন্সিয়ানার জন্য অসংখ্য পদক আর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০১১ সালে তিনি ‘বঙ্গভূষণ’ পুরস্কার অর্জন করেন, যা পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ বেসামরিক উপাধী। ২০১৪ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ভারত সরকার সুপ্রিয়া দেবীকে, ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মশ্রী’ তে ভূষিত করেন।

না, সুপ্রিয়া দেবী তাঁর অভিনয় জীবনের দুই ‘বেঞ্চ মার্ক’ চরিত্র, ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা কিংবা ‘কোমল গান্ধার’ ছবির প্রতিবাদী নাট্যাভিনেত্রী অনসূয়ার জন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। পেয়েছিলেন বিদগ্ধ দর্শকের কাছে যথেষ্ট সম্মান। স্বাধীনতার নির্মম নিয়তিতে শিকড় ছিঁড়ে উদ্বাস্তু হয়ে এপার বাংলায় চলে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত এক তরুণীর আশা-স্বপ্ন, জীবনসংগ্রামের এক অনিবার্য পরিণতি উত্তর বাংলার পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হয়েছিল, ‘দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম’ এই কটি শব্দের হাহাকারে। জাতীয় নাট্য আন্দোলনের অন্যতম আদর্শবান সদস্য হিসেবে অভিনেত্রী অনুসূয়া যেমনভাবে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে মানতে পারেনি, তেমনই মুখর হয়েছিল দলত্যাগী দুই সদস্যদের বিরুদ্ধে।

সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয় জীবনের এই দুটি চরিত্র বাংলা সিনেমায় যেমন আইকনিক চরিত্র হয়ে আছে। তেমনই অভিনেত্রী হিসেবে তিনি নিজেকে বাংলা সিনেমায় এক দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। ছিলেন এবং থাকবেনও।

পুনশ্চ:  পর্দায় রূপকথার ‘রাজকুমার’ যতবার প্রেমে পড়েছেন, ততবারই কূল হারিয়েছে বাঙালি যুবক। ওদিকে সুচিত্রা, এদিকে সুপ্রিয়া। বাঙালির পরিণত প্রেমপত্রের এপাতা যদি ভরে ওঠে একজনের জন্য অনুরাগে, তবে অপর পাতা ফুটে উঠেছে অন্যজনের সংরাগে। ভালো তো একা উত্তমকুমার বাসেননি। প্রতিবার প্রতি প্রেমের মুহূর্তে তাদের ভালোবেসেছেন বাঙালি পুরুষ। দর্পিতা, মানিনী সুচিত্রা যদি বাংলার সিনেমার পদাবলীতে বিদ্যাপতির রাধিকা হন, তবে সুপ্রিয়া দেবী বাংলার বনপলাশীর পদাবলীর পলাশকলি। তিনি সেই অবধারিত প্রণয়পাত্র, যে গ্লাসে চুমুক দিয়ে কলঙ্কিত হতেও দ্বিধা থাকে না। তার কম্পিত অধরেই তো থাকত সেই আহ্বান। তার দ্বিধাজড়িত কণ্ঠেই তো ছিল সেই হাতছানি। বিনা আমন্ত্রণে চোখের কোণে যে অবুঝ হাসি ফুটত তার মর্মোদ্ধারেই তো কেটে যায় কয়েক দশক। ফলে বাঙালির একমাত্র ‘রাজকুমার’ যে তার কাছেই খেই হারাবেন এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!

সামান্য উপকরণেই সেদিন সু্প্রিয়া দেবী দেখিয়ে দিয়েছিলেন কী করে আসামান্য মুহূর্তের জন্ম দিতে হয়। কোনও কথা না বলে স্রেফ চোখের কটাক্ষে কী করে প্রেমের পদ্য লিখতে হয়, তা তার দিকে না তাকিয়ে আমরা বুঝতাম কী করে? উত্তম হতে পারেন সন্ন্যাসী রাজা, কিন্তু আমরা কী করে ভুলি পুরুষতন্ত্রের মুখে তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দেওয়া সুপ্রিয়া দেবীর সেই কঠোর অথচ বিষাদবিধুর মূর্তিটিকে। সেই নেশাচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে যে কী কাকুতি লুকিয়ে ছিল তা বাঙালি দর্শকমাত্রই জানেন। বা লালপাথরের সেই দর্পিতা নারীকে? হাতে চাবুক ওঠে উত্তমকুমারের। আর মুখে হাত চাপা দেন সুপ্রিয়া দেবী। বাঙালি জানে, সে এক মুখ লুকোবার মতো মুহূর্তই বটে। বা মনে করি, ‘শুন বরনারী’র সেই ট্রেনযাত্রা। সে তো এক অপূর্ব লিরিক। ঘরেতে ভ্রমর এলে কীভাবে যে মন গুনগুনিয়ে ওঠে সে তো কণ্ঠে ধরেছিলেন সুমিত্রা সেন। কিন্তু শরীরের প্রতিটি তন্ত্রীতে কীভাবে আনন্দের হিল্লোল ছড়িয়ে যায়, তা কী করে বুঝতাম সুপ্রিয়া দেবী না থাকলে! কী করে বুঝতাম সামান্য ট্রেনের সেটে ক্লোজ-আপে কীভাবে কবিতা লেখা হয়! জহর রায় তখন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে চিত্রনাট্য মেনে বকবক করছেন। আর সুপ্রিয়া দেবী মুখে টেনে এনেছেন গোধূলির আলো। সেই বিষাদ-অনুরাগ-সংরাগে ডুবে থেকে বাঙালি হয়তো ভুলেই গিয়েছিল, যে তারও চলে যাওয়ার সময় এসেছে। গোধূলির মেঘেই তো জড়িয়ে থাকে আলোর সোনা। সে কথা যিনি শোনাতে পারেন তিনিই তো বাঙালির সূর্যশিখা। বাঙালি তার অস্তরাগের ছবি আঁকেনি কোনওদিন। আজও তার হৃদয়ের শাখায় দুলছে রাঙা পলাশকলি। বসন্ত আসতে আরও একটু দেরি। অথচ গত ২৬ জানুয়ারি ২০১৮, সকাল বেলা সুপ্রিয়া দেবী চলে গেলেন! কোনও এক অলৌকিক স্বর্গে বসন্ত আনতেই হয়তো তার যাওয়া। বড় সাধ হয় সে দৃশ্য দেখতে! কিন্তু না, কোনও পরিচালকের পক্ষেই হয়তো ক্যামেরার পেছনে চোখ রেখে সেই দৃশ্য ধরে রাখা সম্ভব নয়! আসলে কিছু মুহূর্ত ধরার থেকে অধরাই থেকে যায় বেশি। আর যেটুকু অধরা, সেই অতৃপ্তির ভেতরেই তো বেঁচে থাকবেন সুপ্রিয়া দেবী!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)