প্রেস অফিস থেকে দেওয়া ১৮০০ নম্বরে ডায়াল করে কোড নম্বরটা দিতেই কেউ একজন স্বাগত জানালেন। নাম এবং কোন মিডিয়ার হয়ে প্রেস কনফারেন্সটা কাভার করছি – তথ্যটা জেনে নিলেন স্বাগত জানানোর ফাঁকেই। ‘তোমাকে কিছুটা সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে। ঠিক নয়টা বাজে আমরা আমাদের প্রেসকনফারেন্স শুরু করবো’- বলেই হোল্ডে রেখে দিলেন ফোনটা। প্রেস কনফারেন্সটা যে ঠিক নয়টায় শুরু হবে সেটা আগেই জানানো হয়েছিলো। অপেক্ষার সময়টার জন্য অবশ্য একটা মিউজিকের বরাদ্দও ছিলো।
কানাডার হাউজ অব কমন্সের প্রধান বিরোধী দল এনডিপি’র দুই নেতা টেলিফোন প্রেস কনফারেন্স কনফারেন্স করবেন- এই তথ্য জানিয়ে এনডিপির প্রেস অফিস আগেরদিনই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। কনফারেন্সে অংশ নেওয়ার নির্ধারিত নম্বর এবং ডেজিগনেটেড একটা কোড নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছিলো। ‘টেলিফোনে প্রেস কনফারেন্স’ – শব্দগুলোই আমাকে কনফারেন্সটার ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী এবং আগ্রহী করে তোলে।
পশ্চিমের কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড এখন ভিডিও কনফারেন্স, টেলি কনফারেন্স করেই অফিসের কাজকর্ম সারে। গুরুত্বপূর্ণ মিটিংগুলোও এখন এইভাবে হয়ে যায়। কনফারেন্সে যোগ দিতে বা মাসিক-সাপ্তাহিক কনফারেন্সের জন্য কর্মীদের হেড অফিসে ডেকে পাঠায় না। তবে কোনো রাজনৈতিক দল সাংবাদিকদের নিয়ে টেলিফোনে প্রেস কনফারেন্স করে- এই তথ্যটা আমার কাছে নতুন। নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের কৌতূহল থেকেই প্রেস কনফারেন্সটা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়।
প্রেস কনফারেন্সের বক্তা এনডিপির ইথিকস বিষয়ক ক্রিটিক শার্লি এঙ্গাস আর লেবার ক্রিটিক আলেক্সান্ডার বউলিরিস। দুজন দলের মুল নেতা নন- তবু নির্বাচনের আগে তাদের প্রেস কনফারেন্সের ব্যাপারে মিডিয়ার আগ্রহ আছে। আগ্রহের কারণে তারা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন অপর বিরোধী দল লিবারেল পার্টির নেতা জাস্টিন ট্রুডোর একটি বক্তব্যের সমালোচনা করার জন্য। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে জনমত জরিপে এনডিপি এগিয়ে থেকেছে, এমনকি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করছে বলেও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে সেই পরিস্থিতি খানিকটা পাল্টে গেছে। লিবারেল পার্টি এনডিপিকে পেছনে ফেলে জনসমর্থনে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় জাস্টিন ট্রডোর বিরুদ্ধে ডাকা সংবাদ সম্মেলন মিডিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হয়।
শুরুতেই পার্টির একজন প্রেস কর্মকর্তা জানিয়ে দেন, আধা ঘন্টার এই প্রেস ব্রিফিং এ পার্টির দুই নেতা বক্তব্য দেবেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নও নেওয়া হবে। তবে কারো কাছ থেকেই দুটোর বেশি প্রশ্ন নেওয়া হবে না। ঠিক নয়টা বাজতেই ইথিকস ক্রিটিক শার্লি এঙ্গাস বক্তব্য শুরু করেন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই দুই নেতা তাদের বক্তব্যটা পড়ে শেষ করেন।
লিবারেল পার্টি নেতা জাস্টিন ট্রুডো আগের দিন এক বক্তৃতায় বলেছেন, অধিকাংশ ছোটো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকই ‘ছোটো শিল্প প্রতিষ্ঠানের’ নামে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়। জাস্টিন ট্রুডোর এই বক্তব্যের সমালোচনা করে ইথিকস বিষয়ক ক্রিটিক শার্লি এঙ্গাস বলেন, ছোটো শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতি জাস্টিন ট্রুডোর অপমানসূচক মন্তব্য প্রমাণ করে তিনি আসলে ক্ষুদ্র শিল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, জাস্টিন ট্রুডো যখন লিবারেল পার্টির ইয়ুথ ক্রিটিক ছিলেন, তখন তিনি ছাত্রদের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেও প্রতি বক্তৃতার জন্য ১৫ হাজার ডলার করে পারিশ্রমিক নিতেন। আর আমি ছাত্রদের কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করে একটি কফি মগ বা কলমের বাইরে কিছু নেই না।
তিনি বলেন, জাস্টিন ট্রুডোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- তার এই অতিরিক্ত আয়ের ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য তিনি ক্ষুদ্র কোনো কোম্পানি তৈরি করে নিয়েছেন কী না। যদিও জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, তার পেশাগত সব কাজই নিয়ম মাফিক পরিচালিত হয়, তবু প্রশ্ন থেকে যায়, মি. ট্রুডো ক্ষুদ্র কোনো কোম্পানি বানিয়ে তার মাধ্যমে নিজের বাড়তি আয়ের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন কী না। মূলত এই হলো সংক্ষেপে প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য। এনডিপি এখন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির চেয়েও অপর বিরোধী দল লিবারেল পার্টি প্রতি তাদের আক্রমন শাণিত করছে এই বার্তাটিই জানিয়ে দেওয়া হলো প্রেস কনফারেন্সে।
এনডিপির দুই নেতার বক্তব্যের পর শুরু হয় প্রশ্ন পর্ব। টরন্টো স্টার আর দ্যা কানাডীয়ান প্রেস এর রিপোর্টারের প্রশ্ন এবং উত্তরের পর হাফিংটন পোষ্টের রিপোর্টারকে থামিয়ে দেয় প্রেস অফিসের কর্মকর্তা। ওই রিপোর্টার আসলে তৃতীয় প্রশ্ন করার চেষ্টা করছিলেন। সাড়ে ৯টা বাজার সাথে সাথে ‘নো মোর কোশ্চেন’ বলে প্রেস কনফারেন্সের সমাপ্তি ঘোষণা করেন প্রেস কর্মকর্তা।
এই আধা ঘন্টা ধরে এই কনফারেন্সটা চলে টেলিফোনেই। এনডিপির এই দুই নেতা রাজধানী শহর অটোয়ায় বসেই তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। অটোয়া, মন্ট্রিয়ল, টরন্টোসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকেই প্রধান প্রধান মিডিয়ার প্রতিনিধিরা টেলিফোনেই এই কনফারেন্সে যুক্ত হয়েছেন, এনডিপি নেতাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং প্রশ্নও করেছেন। ভৌগলিক অবস্থান এবং দূরত্বের কারণেই কানাডার প্রতিটি শহরের সাংবাদিকদের এই ধরণের প্রেস কনফারেন্সে যোগ দেওয়া কঠিন। আধা ঘন্টার এই প্রেস কনফারেন্সে অটোয়ায় বসবাসরত সাংবাদিকদের যোগ দেওয়াটাও কতোটা সম্ভব ছিলো সেটাও ভাববার বিষয়। আধা ঘন্টার প্রেস কনফারেন্স কাভার করার জন্য ২ ঘন্টা রাস্তায় কাটানো নিশ্চয় বুদ্ধির কোনো কাজ নয়। ফলে টেলিফোন প্রেস কনফারেন্স সাংবাদিকদের সেই সময়টাকে বাঁচিয়ে দেয়। যেমন আমি নিজেও উইকএন্ডের সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়েই সেলফোন থেকে এনডিপি নেতার প্রেস কনফারেন্স কাভার করে ফেলেছি।
প্রেস কনফারেন্সের কাঠামোটাও বেশ ভাবিয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে ত্রিশ মিনিটের কনফারেন্স ত্রিশ মিনিটেই শেষ করতে পারা, তাও আবার রাজনৈতিক দলের প্রেস কনফারেন্স! পার্টি নেতা নিজে নন- প্রেস কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্ন নেওয়া না নেওয়া নিয়ন্ত্রণ করছেন- এই দৃশ্যটা অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কল্পনাই করা যায় না। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রেস কনফারেন্সের জন্য টেলিফোন প্রেসকনফারেন্স বা ভিডিও কনফারেন্স চালুর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা যেতে পারে। এক ঘণ্টার একটি প্রেসকনফারেন্স কাভার করতে সাংবাদিকদের তিন চার ঘণ্টা রাস্তায় কাটাতে হয়- এমন তথ্য হরহামেশাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাওয়া যায়। প্রেস কনফারেন্স এর এই বিকল্প ব্যবস্থাটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনকে সহজতর করে দেবে।
আমরা জানি, ঢাকায় অনেক মেধাবী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আছেন। হয়তো তাঁরা ইতিমধ্যে টেলিফোন বা অনলাইনে প্রেস কনফারেন্স বা মিটিং করার মতো প্রযুক্তিগত অবকাঠামো করেই রেখেছেন। বাংলাদেশেও ‘ডিজিটাল প্রেস কনফারেন্স’ শুরু হউক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)