রাঙামাটি থেকে: সেদিন একের পর এক যখন পাহাড় ধসে পড়ছে; চারদিক পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে-সেই অবস্থায় প্রাণে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছিলেন অসংখ্য আতঙ্কিত মানুষ। মৃত্যুঝড় পেরিয়ে জীবনযুদ্ধে বিজয়ী সেইসব মানুষ মেতে উঠেছে ঈদের আনন্দে। সেই রঙিন আনন্দে রঙিন হয়ে উঠেছে রাঙামাটির অাশ্রয়কেন্দ্রগুলোও।
সোমবার প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সরবরাহ করা সেমাই, পাউরুটি আর জুস- দিয়েই পাহাড় ধসে দুর্গত মানুষের ঈদ আনন্দের শুরু। ত্রাণের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে পরিবার-সন্তানদের নিয়ে দিনটা আলাদা ভাবে কাটে আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষগুলোর।
বেলা গড়িয়ে যখন দুপুর তখন যেনো এই মানুষগুলোর সামনে ঈদের আমেজ নিয়ে হাজির হয় পোলাও, মুরগি, ডিমের কোরমা, কোমল পানীয় এবং আপেলে ভর্তি জলপাই রঙের আর্মি জিপ।
খাবার আসার আগেই দুই মেয়েকে ঈদের সাজে সাজাচ্ছিলেন ওদের মা সাথী বেগম। ত্রাণের জামা আর মায়ের ব্যাগে থাকা ফেসপাউডার, লিপস্টিকে সেজেই খুশি ওরা। সাথীর দুই মেয়ের মতো কম বয়সী মেয়েরা সবাই যার যার সাধ্যমত সেজেগুজে বাধ্য মেয়ের মত দাঁড়িয়ে গেলো খাবার নেয়ার লাইনে।
রঙিন বেশে লাইনে দাঁড়ানো শাকিলা, রুমানাদের দেখলে মনে হয় আশ্রয় কেন্দ্র নয় বিশাল একটা পরিবারের সবাই সুশৃঙ্খল ভাবে খাবার নিচ্ছে।
খাবার সরবরাহে সাহায্য করা স্বেচ্ছাসেবকরা লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের ‘ঈদ মোবারক’ জানিয়ে হাসি হাসি মুখে শুরু করে খাবার বিতরণ। পোলাওয়ের গন্ধে ততক্ষণে লাইনের একেবারে শেষে দাঁড়ানো মানুষটির মুখেও হাসি। তাদের এমন দুর্দিনের ঈদে প্রশাসনের কর্তারা আনন্দ ভাগাভাগি করতে আসেন এই কেন্দ্রে। রাঙামাটি সরকারি কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে এই ছিল ঈদের এমন চিত্র।
সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আসবেন বলে ঝাড়ু দেয়া হচ্ছিল টেলিভিশন কেন্দ্রের অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে। রুমে-রুমে সেনা সদস্যরা গিয়ে বলে আসেন জুতা, বিছানা গুছিয়ে রাখার কথা। এতো কিছুর মাঝেই নিচতলায় সিঁড়ির নিচের ফাঁকা জায়গায় ছোট্ট মারিয়াকে মুখে তুলে সেমাই খাইয়ে দিচ্ছিলেন ওর বাবা রাশেদুল।
ঈদ উপলক্ষে ত্রাণের কাপড় বিতরণ করা হলেও শিশুকে দেখা যায় পুরানো পোশাকে। কারণ ত্রাণে পাওয়া পোশাক ওদের মাপে হয়নি। ঈদে দেয়া প্রিন্টের সুতি কাপড় পরেননি কয়েকজন নারী।
তবে সন্তানদের নিয়ে বেচে থাকা এবং ঈদ করার সুযোগ পেয়েই খুশি তারা। আর সেই খুশি আর বেশি প্রকাশিত হয় উন্নতমানের খাবারে। প্রতিদিন দুপুরে খিচুরি খাওয়া এই মানুষগুলোর মুখে ঈদের হাসি ফোটায় বড় বড় ডেকচিতে আসা মিক্সড ভেজিটেলব, ডিম, মুরগি, পানীয় এবং ফল।
ঈদে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আজ ভালো খাবার দেয়া হবে এটা আগেই জেনে গিয়েছিলো একটু ভালো খাবারের প্রত্যাশায় থাকা মানুষ।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর কয়েক হাজার মানুষের জন্য ভোর বেলা থেকেই খাবার রান্না শুরু হয়। বাবুর্চিদের তদারকিতে ব্যস্ত সময় কাটে সেনা সদস্যদের। তবুও এই অসহায় মানুষগুলোকে ঈদে ভালো খাবার দিতে পেরে সেনারাও আনন্দিত।
আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বিলি শেষে স্বেচ্ছাসেবিকদের সঙ্গে নিয়ে খেতে বসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। মাঝ দুপুরের একটু পরেই কলেজের আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার বিতরণ পরিদর্শনে আসেন এলাকার গণ্যমান্য সরকারি, বেসরকারি কর্ম কর্তারা।
গত ১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের ঘটনায় ৬ সেনাসদস্যসহ ১২০ জন নিহত হয়। সবমিলিয়ে রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই পাঁচ জেলায় ১৫৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে সরকার।