ঈদুল ফিতর। ঈদ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘আউদ’ থেকে। যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। মানে, যে আনন্দ ফিরে আসে বারংবার। আর ‘ফিতর’ মানে, ভেঙে ফেলা। ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে দীর্ঘ এক মাস রোজা পালনের ধারাবাহিকতা ভেঙে যায় বলে একে এ নামে অভিহিত করা হয়।
ইসলাম ধর্মের বৃহত্তর উৎসব এটি। টানা এক মাস সিয়াম সাধনার পর ফিরে আসে এ উৎসব, এ আনন্দ। এ আহ্লাদ আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিনিময়ে। এ আনন্দ আসে তাদের জন্য, যারা পুরো রমজান মাসজুড়ে কামনা-প্রবৃত্তির রিপুগুলোকে ধ্বংস করে মুত্তাকীদের কাতারে পৌঁছাবার সৌভাগ্য লাভ করেন। এ উৎসব আসে কদর রজনীর একটি রাত ইবাদত করে হাজার মাসের সমান ইবাদত হাসিলের খুশীতে। এই ঈদ-উৎসব আজ কড়া নাড়ছে আমাদের দ্বারে দ্বারে। আজ আমরা উৎসবের মুখোমুখি। কিন্তু যে জন্য উৎসবের আয়োজন, তা কি আদৌ সাধন করতে পেরেছি আমরা? এই প্রশ্ন যে হৃদয়ে জাগবে না, সে হৃদয় আস্ত মৃত। যে মন আত্মোপলব্ধির রমজানকে ভুলে গিয়ে আহ্লাদে মত্ত হয়ে গেছে, সে হৃদয় পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগা।
প্রিয়নবী (সা.) এমনটাই বলেছেন: ‘ঐ ব্যক্তি কতই না হতভাগ্য, যে কিনা রমজান পেল, অথচ ক্ষমা আদায় করতে পারল না। রমজানেই যদি সে ক্ষমা লাভ করতে না পারে, তবে কখন করবে?’ (তাবরানী)। ঈদের আগমন সিয়াম সাধনার মাসে ক্ষমাপ্রাপ্তির আনন্দ থেকে। এক হাদিসে তেমনটিই বলা হয়েছে– ‘আল্লাহ তায়ালা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মধ্যে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, হে ফেরেশতারা, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে? ফেরেশতারা বলেন, হে প্রভু, পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতঃপর দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। সুতরাং আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম! আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের মাফ করে দেব’ (বায়হাকি)।
ঈদুল ফিতর একাধারে একটি ইবাদত ও আনন্দোৎসব। দুটোর সম্মিলন। ঈদের দিনে রয়েছে কতিপয় সুনির্দিষ্ট ইবাদত। তন্মধ্যে ঈদের নামাজ, সদকাতুল ফিতর আদায়, খোতবা শ্রবণসহ আরো কতিপয় সুন্নত ও মুস্তাহাব কার্যাদি উল্লেখযোগ্য। ইবাদতের পাশাপাশি বিনোদন, উৎসবের মাধ্যমও এটি ৷ এই উৎসব প্রমাণ করে ইসলাম ধর্ম স্রেফ কোনো রসহীন জীবনব্যবস্থার নাম নয়। ইসলাম বিনোদনকে নিষিদ্ধ করে না; নিষিদ্ধ করে বিনোদনের নামে প্রচলিত সকল অশ্লীলতাকে। বরং বিনোদন প্রমোট করতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের ব্যবস্থা করেছেন।
যেমনটি দেখা যায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই হাদিস থেকে: ‘প্রতিটি জাতির আনন্দ-উৎসব আছে। আর আমাদের আনন্দ-উৎসব হলো দুই ঈদ’ (বুখারি)। সুস্থ বিনোদন সে ইসলাম ধর্মের বাঁধা নয়, তা নিশ্চিতকরণে অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রীড়ারত হাবশি বাচ্চাদের উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘ছেলেরা, খেলে যাও! ইহুদিরা জানুক যে আমাদের দ্বীনে প্রশস্ততা আছে। আমাকে প্রশস্ত দ্বিনে হানিফসহ প্রেরণ করা হয়েছে’ (বুখারি ও মুসলিম)। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশার্থে মূলত দুই ঈদের প্রচলন।
ঈদুল ফিতরের দিনে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত ও দায়িত্ব হলো সদকাতুল ফিতর আদায়। নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী প্রত্যেক স্বাধীন মুসলমানের সদকাতুল ফিতর প্রদান অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। সদকাতুল ফিতর অভাবী, নিঃস্ব মানুষের ঈদকে আরো আনন্দময় করে তুলে। সাধারণত সদকাতুল ফিতর আদায় করা হয় ঈদের দিন জামাতের আগে আগে। তবে আগের দিনগুলোতেও এটি আদায় করা যায়। আগে দিলেই ভালো হয়। কেননা এতে গরীব-দুঃখীরা ঈদ পূর্বকালীন জরুরী পণ্যসামগ্রী ক্রয়ের সুযোগ পাবেন। সদকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে– যার যতটুকু সামর্থ্য, তিনি যেন সেই পর্যায়ের সদকাতুল ফিতর আদায় করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক পাঁচটি পর্যায়ে ঘোষণা করা হয়েছে এবারের সদকাতুল ফিতর। যাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো, তারা যেন উর্ধ্বস্তর অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করেন। এতে সমাজের গরীবশ্রেণী আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
ঈদ আসে মুসলমানদের ভালবাসা ও সম্প্রীতির দিবস হিসেবে। এ দিন মুসলমানগণ ভুলে যান পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত, ভেদাভেদের নিষ্ঠুরতা। সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একীভূত হন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে। কে ধনী, কে গরীব– নেই কোনো শ্রেণী ভেদাভেদ। সবাই পরস্পর ভাই। সেকথাই সুন্দররূপে প্রস্ফুটিত হয়েছে জাতীয় কবির দু-লাইনে:
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
হাতে হাত মেলানোর ঈদ এসে পড়েছে আমাদের সামনে। করোনা সংক্রমণের এ পরিস্থিতিতে হয়ত সবার সাথে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মেলানোটা সম্ভব হবে না। আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ঈদ পালন করতে হবে। উচিত হবে, যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। যাতে আমাদের দ্বারা আমাদেরই কোনো ভাই, কিংবা কোনো ভাই দ্বারা আমাদের কেউ আক্রান্ত না হই। তুলনামূলকভাবে এবছর ঈদ-আনন্দে ভাটা পড়বে অনেকটাই। যেসকল ঈদ জামাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে নামাজ পড়তে পারবেন। তারপরও যদি কেউ স্বাস্থ্যঝুঁকির আশংকায় ঈদ জামাতে অংশ নিতে না পারেন, সেক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান হলো– ‘ঈদের জামাত ছুটে গেলে অন্য কোনো স্থানে যাওয়া যদি সম্ভব হয়, তাহলে সেখানে গিয়েই ঈদের জামাতে শরীক হবে। আর যদি কোনো ওজরের কারণে অন্য জামাতে শরীক হতে না পারে, তাহলে চার রাকাত চাশতের নামাজ আদায় করে নেবে। তবে তা ঈদের নামায বলে বিবেচিত হবে না। হবে চাশতের নামাযই’ (দুররে মুখতার: খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৭৯৫)।
ঈদের সুন্নত ও মুস্তাহাবসমূহ
(১) মেসওয়াক করা সুন্নত। (২) গোসল করা সুন্নত। (৩) সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত। (৪) কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত। বিজোড় সংখ্যায় যেকোনো মিষ্টিদ্রব্য খাওয়া উত্তম; খেজুর অতি উত্তম। (৫) ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া উত্তম। এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা মুস্তাহাব। (৬) ঈদগাহে যাওয়ার পথে নিচু স্বরে তাকবির (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ) পড়া সুন্নত। (৭) সাধ্যমত উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। (৮) নামাজের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করা সুন্নত। (দাতা ও গ্রহীতার সুবিধার্থে রমজানেও প্রদান করা যায়)। (৯) ঈদের দিন চেহারায় খুশির ভাব প্রকাশ করা ও কারো সঙ্গে দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলা মুস্তাহাব। (১০) আনন্দ-অভিবাদন বিনিময় করা মুস্তাহাব। (ফাতোয়ায়ে শামি: ১/৫৫৬-৫৫৭-৫৫৮, হেদায়া: ২/৭১, বোখারি : ১/১৩০, ইবনে মাজাহ: ৯২)।
ঈদের নামাজের নিয়ম
সারা বছরে দুই ঈদের নামাজ আসে মাত্র দু’বার। কম আদায় হবার কারণে অনেকে ভুলে যান ছয় তাকবির বিশিষ্ট এ নামাজটি। আবার জানাজার নামাজে একাধিক তাকবির থাকায় অনেকে ঈদের নামাজের সাথে জানাজার নামাজকে গুলিয়ে ফেলেন। ভুল করে বসেন ঈদ জামাতে গিয়ে। তাই ঈদের নামাজের পদ্ধতিটা ভালোভাবে মনে রাখতে হবে। ঈদ জামাত কীভাবে আদায় করবেন, তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
‘মনে মনে নির্দিষ্ট করতে হবে যে আমি এ ঈদের নামাজ কিবলামুখী হয়ে এই ইমাম সাহেবের পেছনে অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি। ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবির ওয়াজিব। প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমা ও ‘ছানা’র পর তিন তাকবির। দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর রুকুতে যাওয়ার আগে তিন তাকবির। এ তাকবিরগুলো বলার সময় ইমাম মুকতাদি সবাইকে হাত উঠাতে হবে। তৃতীয় তাকবির ছাড়া প্রতি তাকবিরের পর হাত ছেড়ে দিতে হবে। কেউ যদি এ তাকবিরগুলো না পায়, তাহলে সে রুকুতে থাকা অবস্থায় আদায় করে নেবে। কারো পূর্ণ এক রাকাত ছুটে গেলে সে দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর তাকবিরগুলো আদায় করে নেবে। কেরাতের আগে আদায় করারও সুযোগ রয়েছে। নামাজ শেষে খুতবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা নামাজির জন্য ওয়াজিব’ (ফাতোয়ায়ে শামি: খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৫৫৯-৫৬০)।
পরিশেষে, প্রত্যাশা থাকবে, আমরা সকলেই যেন ঈদের নিয়ম ও স্বাস্থ্যবিধিসমূহ মেনে ঈদ পালন করি। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।