সখিনা বেগম সবিতার একটি হয়রানি ও প্রতারণার মামলার সাক্ষী ছিল ইয়োগেন, সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ইয়োগেন বিভিন্ন সময় সবিতার কাছে টাকা দাবি করত। ইয়োগেনের মাদকের টাকা থেকে শুরু করে পকেট মানি সবই প্রায় সবিতাকে বহন করতে হতো। বিষয়টা একটা সময় সবিতার কাছে চরম বিরক্তের কারণ হয়ে ওঠে। তাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে ইয়োগেনকে খুন করে সখিনা বেগম সবিতা।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর সবুজবাগ থানার কদমতলার একটি বাসা থেকে ইয়োগেন হেনছি গোন সালভেজ (২২) নামে নটরডেম কলেজের এক ছাত্র খুন হয়।
শনিবার রাতে এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে সবিতা নামের এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র্যাব।
রোববার সন্ধ্যায় কারওয়ান বাজারের র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য দেন র্যাব-৩ এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) মো. এমরানুল হাসান।
যেভাবে খুন হয় ইয়োগেন
এমরানুল হাসান বলেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি সবিতা পুরান ঢাকা থেকে ৪৫০ টাকা দিয়ে কালো ও সবুজ রঙের একটি ব্যাগ এবং ৬৫০ টাকা দিয়ে একটি বটি কিনে এবং ইয়োগেনকে খুন করতে সময় খুঁজতে থাকে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হিরাজির গলির মাথায় ইয়োগেনকে অপেক্ষা করতে বলে সবিতা। এরআগে সবিতা একটি লাচ্ছি কিনে বোরকা পড়ে নেয়, পরে ইয়োগেন আসলে দুজন একসঙ্গে বাসায় ঢুকে।
এরপর ইয়োগেন জুস কিনতে নীচে নামলে সেই সুযোগে লাচ্ছির মধ্যে সবিতা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রাখে। পরে ইয়োগেন বাসায় ঢুকলে তাকে লাচ্ছি খেতে দেয় সবিতা। সেইসঙ্গে সবিতা ইয়োগেনের লাচ্ছি খাওয়াটি গোপনে মোবাইলে ধারণ করে ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে। পরে ইয়োগেন অজ্ঞান হলে তার হাত পা বেঁধে বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে সবিতা।
যেভাবে গ্রেপ্তার হয় সবিতা
র্যাব-৩ এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. এমরানুল হাসান বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় তারা। ওই বাসার সিসি ক্যামেরায় সবিতা ছবিসহ বেশ কিছু ক্লু নিয়ে হত্যাকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে। এক পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিলে সবিতাও বিভিন্ন স্থান পরিবর্তন করে। এক পর্যায়ে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উত্তর মুগদা থেকে সবিতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই ফ্ল্যাটে থাকত ইয়োগেন ও সবিতা
একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে জাফরউল্লাহ রাসেল নামের এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয় সবিতার। ওই ছেলের একটি ফাউন্ডেশন Poor peoples help foundation এ আজীবন রক্তদাতা ও সদস্য হন সবিতা। ওই ফাউন্ডেশনে ইয়োগেন কাজ করত। জাফরউল্লাহ রাসেল ও সবিতা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ত। দুজনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে সবিতা এক পর্যায়ে জানতে পারে জাফরউল্লাহ ফাউন্ডেশনের নাম করে নানান অপকর্ম ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত আছে।
এমরানুল হাসান বলেন, জাফরউল্লাহর নানান অপকর্ম ও প্রতারণা সংক্রান্তে একটি মামলা করে সবিতা। যেহেতু ইয়োগেন ওই ফাউন্ডেশনে চাকরি করত তাই মামলার ছিল সে। আর আইনের ছাত্রী হওয়ায় মামলায় জেতার জন্য ইয়োগেনের সঙ্গে সম্পর্কটা আরো সুদৃঢ় করে সবিতা।
ইয়োগেনের সঙ্গেও জাফরউল্লাহর নানা বিষয়টি বাকবিতণ্ডা চলে, তাই জাফরের বিরুদ্ধে এক হয়েছিল সবিতা ও ইয়োগেন।
জাফরউল্লাহ যেন কখনো সবিতার ও ইয়োগেনের ক্ষতি না করতে পারে তাই একসঙ্গে বাসা ভাড়া করে থাকার পরিকল্পনা করে ইয়োগেন। এবং ভাড়া দুইজনই শেয়ার করে দিবে জানিয়ে সবুজবাগের হিরাঝিল মসজিদের গলিতে একটি বাসা ভাড়া নেয় তারা।
ঘরের শত্রুই যখন বিভীষণ
এক সঙ্গে বাসা নেওয়ার পর সবিতা বুঝতে পারে কি ভুলই না তিনি করেছেন, কারণ ইয়োগেন বাসাসহ অন্যান্য খরচ কোনটাই দিত না। উল্টো ইয়োগেনকে সবিতার খরচ দিতে হতো। এসব থেকে চরম বিরক্ত হয়ে ইয়োগেনকে খুনের পরিকল্পনা করে সবিতা।
ইয়োগেন -সবিতার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি জাফরউল্লাহ রাসেল
একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নবীন বরণ অনুষ্ঠানে র্যাগিং কেন্দ্র করে জাফরউল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হয় সবিতার। আইন বিভাগের সিনিয়র হলেও পরে সুসম্পর্ক হয় সবিতার সঙ্গে তাই তার ফাউন্ডেশনে আজীবন রক্তদাতার নাম লিখিয়ে নেয় এবং এক সঙ্গে কাজ করতে থাকে।
পরে জাফরউল্লাহর কুকীর্তি সবিতার কাছে ধরা পড়লে তাদের মনোমালিন্য হয়, এক পর্যায়ে ইয়োগেনের সঙ্গেও দুরত্ব বাড়ে জাফরউল্লাহর।
জাফরের বিষয়ে জানতে চাইলে এমরানুল হাসান বলেন, মামলার তদন্ত যেহেতু পুলিশ করবে তাই তারাই জাফরসহ তার ফাউন্ডেশনের কি হতো এসব বিষয়গুলো নজরদারি করবে।
কার কী পরিচয়
হত্যার মূলপরিকল্পনাকারী ও হত্যাকারী সখিনা বেগম সবিতা (২৬) একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাস করে জজ কোর্ট শিক্ষানবিশ।
জাফরউল্লাহ রাসেল (৩৩) সবিতার বছরখানেক আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাস করে জজ কোর্টে অনুশীলন করছে।
চট্টগ্রাম জেলার কোতয়ালীর পাথরঘাটা এলাকার ম্যাকলিন গোন সালভেজের ছেলে ইয়োগেন (২২)।
নটরডেম কলেজের ছাত্র ছিলেন ইয়োগেন। তবে নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ায় তাকে বহিষ্কার করা হয়।