সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় আয়োজন সরস্বতী পূজার দিন ঢাকা সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ হওয়ায় যখন আন্দোলন চলছে, তখন নির্বাচন কমিশনের সচিব বলছেন ভিন্ন কথা! ইসি সচিবের মতে, নির্বাচন ও পূজা দুটোই ‘পবিত্র’ কাজ হওয়ায় একসঙ্গে অনুষ্ঠানে কোনো সমস্যা হবে না।
তিনি আরও বলেন: নির্বাচন ও পূজা একসঙ্গে হবে, এটি সাংঘর্ষিক হবে না। আদালতের আদেশ সবাইকে মানতে হবে। রংপুরের ভোটও পূজার সময়ে হয়েছে। এবারও তা হতে কোনো অসুবিধা নেই। পূজা উৎসবের আমেজে হবে; একই সঙ্গে ভোটও হবে৷
কমিশন পূজার দিনে ভোটের দিন হওয়ার নজির হিসেবে দুর্গাপূজার দিনে রংপুর উপনির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার কথা উল্লেখ করলেন৷ সেটা সম্পন্ন হওয়ায় এবার সরস্বতী পূজার দিনে ভোটগ্রহণ হতে চলল ঢাকার দুই সিটিতে৷ এখন তর্কের খাতিরে যদি বলা হয়, ঈদ বা মুসলমানদের বড় ধর্মীয় উৎসবের দিন কি কোনো ভোট হয়? নির্বাচন কমিশন কি পারবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ভোটের তারিখ নির্ধারন করে বলতে ঈদ ও ভোট দুটিই পবিত্র? পারবে না। একথা যদিও তর্কের খাতিরে বলা, ঈদের দিন ভোটগ্রহণ কোনোভাবেই যৌক্তিক না। ঠিক একইভাবে পূজার দিনেও ভোটগ্রহণ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। এ কারণেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের তারিখ বদলের দাবী উঠছে৷ বিক্ষোভ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও শাহবাগে৷ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন অনেকেই।
সরস্বতী পূজার দিনটিকেই কেন সিটি নির্বাচনের দিন ধার্য করে অহেতুক এই বিতর্কের অবতারণা করলো নির্বাচন কমিশন? নির্বাচন কমিশন কি এই তারিখটি জেনে করেছে না না জেনে করেছে? না জেনে হয়ে থাকলে এখন তো জানা হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আবেদন-নিবেদনের কোনো মূল্য নেই। এমনটা না জেনে হয়ে থাকলে তো জানার সঙ্গে সঙ্গে ভোটের তারিখ পরিবর্তন হতো।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় সরস্বতী পূজো হয়৷ একই স্থানে পূজা ও ভোট কেন্দ্র কিভাবে হতে পারে? আর যে সকল হিন্দু কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রিজাইডিং ও পোলিংসহ ভোটের দায়িত্ব পালন করবে তারা কি পুজোয় অংশ নিতে পারবে? সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী যেখানে নিজেও বলছে সরস্বতী পূজার দিনে সিটি নির্বাচন দুঃখজনক৷ এমনকি নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা, তখন নির্বাচন কমিশন এমন পবিত্র বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছে কেন?
৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছে ডাকসু ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারাও নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করার আহ্বান জানায়৷ এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও তারিখ পুনঃবিবেচনা করার কথা বলছে।
ডাকসু এজিএস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, নির্বাচনের তারিখ যদি পরিবর্তন করা না হয় শুধুমাত্র বিবৃতি, স্মারকলিপি দেয়া বা মানবন্ধন করা নয়, আন্দোলনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করা হবে। প্রয়োজনে রাজু ভাস্কর্য থেকে মানববন্ধন নিয়ে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা৷
এত আন্দোলন বিক্ষোভের মুখেও অনড় নির্বাচন কমিশন৷ পূজার দিন যেহেতু বদলানো সম্ভব নয় তাই নির্বাচনের দিনটা বদলে দিলে কি কোনো সমস্যা হতো? রোজার মাসে বা ঈদের দিন যদি নির্বাচন না হতে পারে তবে পূজার দিনে কেন? এই প্রশ্নটা নির্বাচন কমিশনকে করাটাই যৌক্তিক। কারণ, নির্বাচন কমিশনের কাজ ভোটারদের নির্বাচন বিমুখ করা নয়। যেখানে ভোটাররা ক্ষুব্ধ, প্রার্থীরা বিব্রত ও দুঃখিত সেখানে ইসি কেন অনড়? নির্বাচন কমিশনের এমন অবস্থান প্রিয়া সাহাদের নালিশের আরও ক্ষেত্র তৈরি করবে।
অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ নিয়েই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল৷ ১৯৭২ সালের ৭ জুন, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। আজ বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তবু কেন বারবার ক্ষুণ্ণ হয় এই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)