‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ উপন্যাসটাকে আসলে এক কথায় প্রকাশ সম্ভব নয়। এটা একাধারে বয়ে চলা জীবনের গল্প। একজন বাঙালি বালিকার রঙিন স্বপ্নের গল্প। একজন বাঙালি বিধবা বধূর গল্প। দেশভাগের গল্প না কি বেঁচে থাকার জন্য অধিকার আদায়ের গল্প। একদিকে আটপৌড়ে সভ্যতা অপরদিকে আধুনিক সভ্যতার বৈপরীত্য। আছে প্রকৃতির নিখুঁত বয়ান পাশাপাশি আছে প্রযুক্তির দৌরাত্ম। এমন আরও অনেক অভিধা দেয়া যায় ছোট কলেবরের এই উপন্যাসটাকে।
এটা নিছকই শুধু একটা ভাতের হোটেলের গল্প যে নয় সেটা হলফ করে বলা যায়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে নিজের কন্যাকে রক্ষা করার জন্য এক পিতা তার কন্যাকে বিয়ে দেন দূরের দেশে। সেখানে মাতাল স্বামীর সাথে শুরু হয় তার নতুন জীবন। সেটা এক প্রকার সংগ্রামেরই জীবন। পাশাপাশি বাংলাদেশে চলে স্বাধীনতার সংগ্রাম। একাত্তরের যুদ্ধে কন্যা হারায় তার আত্মীয় পরিজনদের। অন্যদিকে মারা যায় তার স্বামীও। বাংলাদেশ যেমন যুদ্ধের পর ক্ষত বিক্ষত অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করছে তেমনি ইন্দুবালাও জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
এভাবেই এগিয়ে চলেছে গল্প। জীবন সংগ্রামের পথে সে চুপ করে থাকলেও তার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে ফেলে আসা খুলনার কোলাপোতা গ্রামে। সেখানকার গ্রামের প্রকৃতি, বাড়ির উঠোন, শৈশব কৈশোরের খেলার সাথী মনিরুল, নিজের ভাই, বাবা, মা, ঠাম্মা সবাইকে তিনি মনেমনে বহন করে চলেন। ঠাম্মা ছিলেন সকল আবদারের কেন্দ্রবিন্দু। ঠাম্মার কাছে শোনা পূর্ব পুরুষদের গল্প সবকিছুরই মূর্ত প্রতীক যেন ইন্দুবালা। ইন্দুবালা যেন একটা জলজ্যান্ত ইতিহাস। দেশ ভাগ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গের বাম আন্দোলন কোন কিছুর সাথে জড়িত না থেকেও ইন্দুবালা সবকিছুরই সাক্ষী হয়ে থাকেন।
লেখক নামকরণের স্বার্থকতা রক্ষা করতেই এই উপন্যাসের অনুচ্ছেদগুলোর নামকরণ করেছেন খাবারের এক একটা পদের নামে। ইন্দুবালা হোটেলে দুপুরের এবং রাতের খাবারের মেন্যু লেখা থাকে একটা বোর্ডে চক দিয়ে। সেই বোর্ডে এক এক সময় এক একটা মেন্যু যোগ হয়। কখনও আগে থেকেই যোগ করা মেন্যু হঠাৎ বদলে যায়। প্রত্যেকটা মেন্যুই ইন্দুবালার মনের গহীনে বহন করে চলা কোন গল্পের উপকরণ। আর সেখান থেকেই একটা করে নাম নিয়ে অনুচ্ছেদগুলো সাজানো হয়েছে। মোট আটটা অনুচ্ছেদ আছে এই উপন্যাসে- কুমড়ো ফুলের বড়া, বিউলির ডাল, ছ্যাঁচড়া, আমতেল, মালপোয়া, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল, চন্দ্রপুলি এবং কচু বাটা।
উপন্যাসের প্রথম লাইন- জানালার কাছে বসন্তের নরম রোদে সার দিয়ে সাজানো আছে কাঁচের বড় বড় বয়াম। এর থেকেই বুঝা যায় এই উপন্যাসে খাদ্যের বিভিন্ন পদের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কিন্তু লেখক অত্যন্ত সুনিপুনভাবে প্রত্যেকটা খাদ্যের পেছনের গল্প বলেছেন পরম মমতায়। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল চালু হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক ছিলো একজন বিহারী মহিলা মাছ বিক্রেতা যার নাম লছমী। যিনি এক দুপুরে মাছ বিক্রি শেষ করে ফেরার সময় বিধস্ত ইন্দুবালাকে দাওয়ায় বসে থাকতে দেখে বলেন আজকে তিনি তাদের বাসায় খাবেন। সাথে দেন আট আনা পয়সা। সেই আট আনা পয়সা আঁচলে বেঁধে শুরু হয় ইন্দুবালা ভাতের হোটেলর যাত্রা। এরপর সেটা চলতেই থাকে।
মাছ বিক্রেতা লছমী পরেরদিন ফিরে আসে আরও তিনজনকে নিয়ে। এইভাবে আস্তে আস্তে বাজারের সবাই এসে খাওয়া শুরু করে ইন্দুবালার নিচের ঘরে। এরপর একদিন উড়িষ্যা থেকে এসে জুটে চালচুলোহীন ধনঞ্জয়। এরপর থেকে ইন্দুবালার সব কাজের সহযোগী এই ধনঞ্জয়। দেশে ইন্দুবালার এই বয়সী একটা ভাই ছিলো। তাই ধনঞ্জয়কে নিজের ছোট ভাই গুণে স্নেহ করেন। এই উপন্যাসের ভাষা আমাদের খুব পরিচিত। আবহমানকাল ধরে চলে আসে গ্রামের ভাষা। বিশেষকরে লেখক বেশকিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যেগুলো শুধুমাত্র গ্রামের মানুষেরাই ব্যবহার করেন। পাশাপাশি আছে গ্রাম বাংলার মিথ এবং মূল্যবোধের কথাও।
প্রথম অনুচ্ছেদ কুমড়ো ফুলের বড়াতে ইন্দুবালার ঠাকুমার উক্তিতে বলা হয়েছে – “দুপুরের অতিথি হলো মেঘ না চাইতে জল। তাকে পেট পুরে না খাওয়ালে গেরস্থের অমঙ্গল হবে। মাঠ ভরা ধান হবে না। গোলা ভরা ফসল উঠবে না। মা লক্ষ্মী বিরূপ হবেন। ভিটে মাটি ছাড়া করবেন।” বিউলির ডালে বলা হয়েছে ছন্নছাড়া কিছু যুবক যুবতীর কথা যারা শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। দেখেন একটা দেশের স্বপ্ন যেখানে মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পারবে। এটা করতে যেয়ে সরকারের রোষানলে পড়েন তারা। তাদেরই একজনের সাথে এক রাত্রে কাকতালীয়ভাবে সাক্ষাৎ হয় ইন্দুবালার। এরপর থেকে তারা মোটামুটি নিয়ম করেই প্রতি রাত্রে এসে খেয়ে যেতেন। ইন্দুবালার ভাষায় – “অতিথির কোন ধর্ম হয় না। বর্ণ হয় না। জাত, গোত্র কিচ্ছু না। অতিথি হয় ঈশ্বর।” ছ্যাঁচড়া অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে – “তাঁর কাছে মানুষ মানে ছিল জীব। তিনি পেটভরে ভাত খাইয়ে জীব প্রেম করতেন।”
ইন্দুবালার জন্মভুমি কোলাপোতা গ্রামের বিশদ বিবরণ আছে এই উপন্যাসে। যেটা আসলে বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রামেরই প্রতিচ্ছবি। লেখকের ভাষায়, “কোলাপোতা গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে ছলেছে কপোতাক্ষ। এছাড়া চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খাল বিল পুকুর। সবুজ জংলা ঝোপের পাশে সন্ধ্যামণি ফুল। হেলেঞ্চার লতা। উঠানের কোন ঘেঁষে কাঠ চাঁপা। পঞ্চমুখী জবা। সদরের মুখটায় শিউলি। সাদা আঁচলের মতো পড়ে থাকে ফুলগুলো। উঠোনের মাঝখানে বড় তুলসী মঞ্চ।” গ্রাম বাংলার বর্ষাকালের রূপও উঠে এসেছে – “এই সময় তো কপোতাক্ষের একুল-ওকুল ভাসে। গভীর রাতে জলের আওয়াজ যেন দোর পর্যন্ত এসে কলকল করে কত কথা শুনিয়ে যায়।”
গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতেই একটা জলাধার থাকে। ইন্দুবালার ঠাম্মার ভাষায় – “পুকুর হলো গেরস্থের লক্ষ্মী। মাছটা, শাকটা, জলটা তা থেকে যেমন পাওয়া যায় ঠিক তেমনি চাপড়া ষষ্ঠীতে কাঁঠাল পাতায় সিন্নি ভাসাতে। ইতু পুজোয় ঘট বিসর্জন দিতে। বাস্তু পুজোয় জল পুজো করতে। বিয়েতে জল সইতে একটা নিজের পুকুর থাকবে না তাও কী করে হয়?” গ্রামীন লোকাচারের এক অফুরন্ত সম্ভার ছোট পরিসরের এই উপন্যাস। এখানে কিছু শব্দ এসেছে যেগুলো সভ্যতার ধাক্কায় এখন প্রায় পরিত্যাক্ত যেমন – বিচালি, ভেলি গুড়, চাটনি, কিলোটাক, বারকোষ, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ইত্যাদি। ঠাম্মার কথামতো ইন্দুবালা আগলে রেখেছিলেন সবকিছু। কারণ সবকিছুর প্রতিই বড় মায়া তার। একেবারে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে করিয়ে রাখা ক্ষয়ে যাওয়া নারকেলের ঝাঁটা থেকে পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি। কারণ ঠাম্মা বলতেন – “আগাছাটাও তো দরকারি।”
কচুবাটা তৈরির জন্য দরকার হয় মানকচু তবে যে সে মানকচু হলে চলবে না। ঠাম্মার বাতলে দিয়েছিলেন ভালো মানকচু চেনার উপায় – “চারপাশ থেকে ছড়ার মতো পাতা যার বেরিয়েছে। ফুলের মতো হয়ে আছে গাছ। সে জানবি গরভবর্তী। মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছে সন্তানকে। তার মধ্যে টইটুম্বুর দুধ। গোড়ায় ডেউ পিঁপড়েগুলোকে দেখেছিস? লোভীর মতো কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
ইন্দুবালার স্মৃতিচারণের একটা বিশাল অংশজুড়ে আছে শৈশব কৈশোরের খেলার সাথী মনিরুলের কথা। মনিরুলের কাছে লেখা এক চিঠিতে তার কলকাতা আসার পথের বর্ণনা এবং কোলাপোতা গ্রামের প্রতি তার টানটা বুঝতে পারা যায়। ট্রেন ভ্রমণ বিষয়ে ইন্দুবালা লিখেছে – “জানিস মনিরুল সে যে কি ভীষণ বস্তু তোকে না বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের সেই বাঁশ গাছে দোল খাওয়ার মতো। তুই নিশ্চয়ই এতোদিনে ঢাকায় পড়তে চলে গিয়েছিস? অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে তোর? অনেক নতুন বন্ধু হয়েছে? আমার কথা মনে পড়ে আর? বোসদের পুকুর। খানার ধারের ল্যাঙড়া…। গাজনের মাঠ…। কপোতাক্ষের ঘাট আমি কিছুই ভুলিনি মনিরুল। এখনও কি নানি সন্ধ্যে হলে বিষাদসিন্ধু পড়েন? তুই কি এখনও রাতের আঁধারে বাঁশি বাজাস? লন্ঠনের আলোয় পড়িস নক্সীকাথার মাঠ? ঢাকাতে কি তোর দেখা হলো আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীনের সাথে? আমার যে সব কথা…সব কিছু বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে মনিরুল…। আমি যে তোকে…।” সর্বোপরি মনিরুলের স্মৃতিই এই উপন্যাসের অন্যতম চালিকাশক্তি।
এই উপন্যাসে শ্রেণি ব্যবধান ঘুচিয়ে একজন সামান্য মাছওয়ালী লছমীর সাথে ইন্দুবালার বন্ধুত্বের গল্পও বলা হয়েছে। লেখকের ভাষায় – একজন একা থাকা মানুষই বুঝতে পারে আর একজনের একার লড়াইয়ের মর্ম। ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের যদি কেউ অংশীদার থেকে থাকে তাহলে সে হলো লছমী। তার সেই প্রথম দিনের টাকায় হোটেল শুরু না হলে কোনদিন ইন্দুবালা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন না। রেল গাড়িতে কাটা পরে লছমী মারা যাওয়ার পর সেই লাশ আনতে গেলে থানায় লোকেরা অবাকই হয়েছিলেন। তারা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক কি ধরণের আত্মীয় যদি একটু বলেন দিদি? ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছিলেন একজন বিহারী কি করে বাঙালির বোন হয়? তার উত্তরে তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন – “কেন হতে পারে না? আমার আপনার রক্তের হিসেব কার কাছে লেখা আছে স্যার? রক্তের আত্মীয়ই কি সব?”
মানুষ মারা গেলে না কি ঈশ্বর হয়ে যান। এখনও কাঁচা মাছ আসলে প্রথমে ওই লছমীর ঝুড়িতেই রাখা হয় সব। তারপর সেখান থেকে সব ধুতে যায়। ভাজতে যায়। কিছু কিছু অদ্ভুত সংস্কার ইন্দুবালা আজও মনে মনে মেনে চলেন। এভাবেই ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ হয়ে উঠে মানব প্রেমের এক অমর মহাকাব্য। যেখানে বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।