গত বেশ কয়েক মাস ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নানাভাবে ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন, সিরিয়া সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততায় তিনি বিরক্ত। কিন্তু ইদলিবে সরকার-বিদ্রোহী সংঘাত বন্ধ করতে বলে নতুন করে মার্কিন পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিলেন তিনি।
গত এপ্রিলে ট্রাম্প সিরিয়া থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের কথা বলছিলেন। আর গত সপ্তাহেই দেশটিতে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সারাতে ২৩ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ বাতিল করে দেন।
অথচ সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ইদলিব প্রদেশে সিরীয় সরকারের সমর্থক রাশিয়া-ইরানের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে হঠাৎই আবার টুইট করে বসলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
টুইটবার্তায় ট্রাম্প সিরিয়ার সরকারের পাশাপাশি রুশ ও ইরানি সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন:
‘ইদলিব প্রদেশে বেপরোয়াভাবে হামলা চালানো একেবারেই উচিত হবে না সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের। রুশ এবং ইরানিরা যদি এই সম্ভাব্য মানবিক ট্র্যাজেডিতে অংশ নেয় তবে তা হবে মানবিকতার দিক থেকে এক চরম ভুল। লাখো মানুষ এতে মারা পড়তে পারে। এমনটা হতে দেবেন না!’
President Bashar al-Assad of Syria must not recklessly attack Idlib Province. The Russians and Iranians would be making a grave humanitarian mistake to take part in this potential human tragedy. Hundreds of thousands of people could be killed. Don’t let that happen!
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) September 3, 2018
এর পরেই তিনি হুঁশিয়ারির ভাষায় যোগ করেন, এ ধরনের হামলা চালানো হলে পুরো বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র ‘খুবই, খুবই ক্ষেপে যাবে’।
অবশ্য ট্রাম্পের এই হুঁশিয়ারিকে আমলে না নিয়ে শুক্রবার হামলার বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে রাশিয়া ও ইরান।
তুর্কি সরকার মূলত বিরোধী পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে। আর রাশিয়া ও ইরান পক্ষ নিচ্ছে সিরিয়া সরকারের।
বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিবে প্রায় ৩০ লাখ লোকের বসবাস হওয়ায় সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বহু সাধারণ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। তাই বৈঠকে এরদোগান বলেন, ইদলিবে রক্তের বন্যা বয়ে যাক – তুরস্ক তা চায় না।
কিন্তু ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি পাল্টা যুক্তিতে দাবি করেন, সিরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে ইদলিবে অভিযানের বিকল্প নেই।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে ‘অর্থহীন’ উল্লেখ করে বলেন, নিজ দেশের কোনো অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার অধিকার সিরীয় বাহিনীর আছে। তাই যুদ্ধবিরতির কোনো মানে হয় না।
‘সন্ত্রাসীদের ওপর হামলা ঠেকাতে সাধারণ জনগণের সুরক্ষাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইতোমধ্যে শনিবার রাশিয়া ইদলিবে নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে বলেও জানিয়েছে বিবিসি।
ট্রাম্পের হুমকিতে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত বদলায়নি। কিন্তু টুইটবার্তাটি কি ইঙ্গিত করে? এটিও কি ট্রাম্পের হুটহাট কথাবার্তার মতোই হুট করে পোস্ট করা একটি টুইট? নাকি সিরিয়া ইস্যুতে কৌশল বদলাচ্ছে তার সরকার?
নতুন করে সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বক্তব্য এর আগে সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলা নিয়ে তার দু’দফা প্রতিক্রিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় ট্রাম্প বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে নিহত শিশুদের মর্মান্তিক ছবি দেখে আবেগাপ্লুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বলেছিলেন, পূর্বসূরি বারাক ওবামার চেয়ে ভালো ব্যবস্থা নিয়ে দেখাবেন তিনি।
ওবামা তার শাসনামলে সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও পরে সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। এ নিয়ে তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
তো দু’বারই ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলার পরিসর সীমিত করে আনা হয়েছিল। এবং সিরিয়া ইস্যুতে ‘রাসায়নিক অস্ত্র’ ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক বড় একটি আলোচনার বিষয়। ইদলিবকে পুনর্দখলে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হলে যুক্তরাষ্ট্র ‘খুব কঠোর’ পদক্ষেপ নেবে বলেও বারবার সতর্ক করেছে।
এর আগে মানবতামূলক কারণ দেখিয়ে মার্কিন অভিযানের পরিধি সীমিত করলেও এবারের হুঁশিয়ারি এমনটাও নির্দেশ করতে পারে যে, আগে সিরিয়া থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার কথা বললেও আসলে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ইস্যুতে বাম হাত ঢুকিয়ে রাখার কথাও ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে এখানে মার্কিন প্রশাসনের কৌশলের আরও অনেকগুলো দিক আছে বলে ধারণা সিরিয়া বিশ্লেষকদের অনেকের।
ট্রাম্প প্রশাসনের উভয় সংকট
মধ্যপ্রাচ্য সামরিক বিশ্লেষক নিকোলাস হেরাসের ভাষায়, ‘ইদলিব সংকট ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য জটিল একটি উভয় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এ ইস্যুতে প্রশাসনের প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করবে নতুন সিরিয়া নীতির সাফল্য বা ব্যর্থতা।’
উভয় সংকটের একদিকে আছে ইদলিবের অধিবাসী প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। এদের এক-তৃতীয়াংশ সিরিয়ার অন্যান্য যুদ্ধ কবলিত এলাকা থেকে পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তাই নৈতিক দিক থেকে ইদলিবে হামলায় সমর্থন দেয়া যায় না।
ইদলিবের কয়েকটি বিদ্রোহী বাহিনীকে সমর্থন দেয়া তুরস্কের ভয়, ব্যাপক পরিসরে পরিচালিত অভিযানের ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর ঢল তুর্কি সীমান্তের দিকে ছুটে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপও এই শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে হবে, এই ভয় পাচ্ছে।
উভয় সংকটের অন্য দিক হলো, ইদলিব সশস্ত্র সরকারবিরোধী পক্ষের বিশাল ঘাঁটি। ওই বিদ্রোহীদের মাঝে অনেকগুলো দলের সঙ্গে আল কায়েদার সম্পর্ক আছে বলেও মনে করা হয়। রাশিয়া এই ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসী’দের নির্মূল করতে সরকারের সঙ্গে মিলে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এদের নির্মূল চায় যুক্তরাষ্ট্রও।
সরকার ও বিদ্রোহীদের যুদ্ধে রুশ বিমান-শক্তি সিরিয়া সরকারের বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র নিকোলাস হেরাসের মতে, ট্রাম্পের সতর্কবার্তা হলো যুদ্ধে তুরস্কের হাত মজবুত করার একটা চেষ্টা।
আইএসের ভয় দেখিয়ে বোঝানো হচ্ছে ট্রাম্পকে?
শুধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট নয়, তার প্রশাসনের কয়েকজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাও সিরিয়ায় অনির্দিষ্টকালের জন্য মার্কিন সেনা রেখে দেয়ার কথা বলছেন। এর উদ্দেশ্য শুধু সিরিয়ায় কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পরাজয় নিশ্চিত করা নয়, বরং একই সঙ্গে সিরিয়াকে স্থিতিশীল করার জন্য একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠনে সাহায্য করা এবং ইরানের আধিপত্য হঠানো।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনই প্রথম জানুয়ারিতে এই কৌশলের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তখন সেনা সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার ঘোষণা দিলে ওই কৌশলের সেখানেই ইতি ঘটে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়াকে শুধু আইএস’কে হারানোর দিক দিয়ে বিচার করছেন; তাই তার হিসেবে সিরিয়ায় থাকার আর কোনো প্রয়োজন নেই বলে তিনি মনে করেন বলে মন্তব্য করেছেন মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সিরিয়া সংকট বিষয়ক অনানুষ্ঠানিক সংলাপ প্রধান র্যান্ডা স্লিম।
স্লিমের মতে, সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারাই ট্রাম্পকে বুঝিয়েছেন সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আসলে শেষ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র যদি এত দ্রুত সেনা ফিরিয়ে নেয় তবে দলটি আবারও ফিরে আসার সুযোগ পাবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা যে সিরিয়ায় বাড়তির দিকে, তারই প্রমাণ দিয়েছেন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তার বিভাগে রাষ্ট্রদূত জেমস জেফরিকে প্রধান করে নতুন সিরিয়া টিম গঠন করে। জেফরিও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সিরিয়া থেকে সরে আসার কোনো তাড়াহুড়ো নেই তাদের।
রাশিয়া-আসাদ জোটের আসন্ন সম্ভাব্য বিজয়ের পথে মার্কিন কৌশল কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে সেটা এখন দেখার বিষয়।
কিন্তু এত সব বিশ্লেষণের পরও ইদলিব নিয়ে মার্কিন প্রশাসন আসলে কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বিবিসি’র পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিনিধি বারবারা প্লেট আশার। কারণ ট্রাম্পের মন বদলায় মিনিটে মিনিটে।