ইতিকাফ আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো অবস্থান করা, আবদ্ধ হওয়া বা আটকে রাখা। শরিয়তের পরিভাষায়, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্ধারিত সময় পর্যন্ত নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার নামই ইতিকাফ। আর ইতিকাফকারীকে বলা হয় ‘মুতাকিফ’।
ইতিকাফের মৌলিক দু’টি দিক হলো নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকার মাধ্যমে আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং সেখানে অন্যান্য সময়ের বৈধ কার্যসহ কতিপয় কার্যাবলী থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, “আর যতক্ষণ তোমরা মসজিদে অবস্থান করো, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে আল্লাহ পাক তাঁর আয়াতসমূহ মানুষের জন্য বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া লাভ করতে পারে” (সূরা বাকারা ১২৫)।
ইতিকাফ একটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে যখন স্রষ্টার কোন বান্দা তাঁর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যায়, তখন সে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে। রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করা ‘সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ আলাল কিফায়াহ’ অর্থাৎ মহল্লাবাসীর কেউ একজন ইতিকাফ করলে অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যাবে। নয়তো সবাই দায়ী থাকবে। তবে যিনি আদায় করবেন কেবল তিনিই সওয়াবের অংশীদার হবেন।
এই আমলটি সুন্নাত হওয়ার কারণ হলো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবদ্দশার অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত পবিত্র রমজানের শেষ দশকগুলোতে টানা ইতিকাফ করতেন। এমনকি একবছর কোনো একটি কারণে নবিজি ইতিকাফ আদায় করতে না পারায়, তিনি পরের বছরেই রমজানের দুই দশক ইতিকাফ করে তা আদায় করে দিয়েছেন।
এভাবে তাগিদ সহকারে আদায়ের দরুন ইতিকাফ করাটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ সাব্যস্ত হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, “নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজীবন রমজানের শেষ দশকগুলোতে ইতিকাফ করেছেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর বিবিগণও ইতিকাফ করতেন” (বুখারি ও মুসলিম)।
সাধারণতঃ ইতিকাফ তিন ধরনের হয়ে থাকে। সুন্নাত, ওয়াজিব ও নফল। ওপরে বর্ণিত রমজান মাসের ইতিকাফটি সুন্নাত; এধরনের ইতিকাফ ২০ রমজান সূর্যাস্তের পর থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়া পর্যন্ত করতে হয়; নির্ধারিত সময়ের কম হলে তাতে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ আদায় হবে না। আর যদি কেউ ইতকাফের মান্নত করে, তবেঁ সেই মান্নত পূর্ণ করা তার জন্য ওয়াজিব; এধরনের ইতিকাফে কমপক্ষে একদিন পূর্ণ করা বাধ্যতামূলক।
এছাড়া বছরের অন্য যেকোনো সময়ে অল্পক্ষণের জন্যে হলেও নফল ইতিকাফ করা যায়। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু মসজিদে এলাকার ইতিকাফকারী পাওয়া না গেলে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে লোক ভাড়া করে এনে ইতিকাফ করানো হয়। এভাবে ইতিকাফ করালে ঐ এলাকাবাসী মোটেও দায়মুক্ত হবে না।
ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য হলো শবে কদরপ্রাপ্তি। যেহেতু প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলিতে শবে কদর অনুসন্ধান করতে বলেছেন, তাই শেষ দশকে ইতিকাফে অবস্থান করার মাধ্যমে পবিত্র কদর রজনী তালাশের তাগাদা দেয়া হয়েছে। এজন্য যতজনের সম্ভব হয়, ততজনেরই মসজিদে ইতিকাফ করা উচিত। এতে কদর রজনী ইবাদত ব্যতীত অতিবাহিত হওয়ার আশংকা ক্ষীণ হয়।
পুরুষদের জন্য ইতিকাফের স্থান মসজিদ, আর নারীদের জন্য উপযুক্ত তাদের বাসস্থান। মসজিদে গিয়ে ইতিকাফ করা নারীদের জন্য মাকরুহ। তারা ঘরের কোনো একটি কক্ষে নিজেদের আবদ্ধ রাখবেন এবং প্রয়োজন ব্যতীত সেই কক্ষ থেকে বের হবেন না। খুব দরকারে ঐ কক্ষে কেউ এলে তার সাথে কথা বলতে বাঁধা নেই। কিন্তু অহেতুক কথা বলে ইতিকাফের পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না।
আর যদি ইতিকাফের কক্ষটি শয়নকক্ষ হয় এবং তাতে অন্যকেউ কিংবা স্বামী শয়ন করে, এতে অসুবিধা নেই। তবেঁ স্বামীর সাথে কোনোরূপ কামসুলভ আচরণ ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ; এর দ্বারা ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। শুধু নারীর জন্যই নয়; এগুলো পুরুষের জন্যও ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ।
মনে রাখতে হবে, ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদে অবস্থান করাটাই ইবাদত। তা সত্ত্বেও এসময় অধিকহারে নফল ইবাদতে মগ্ন থাকা উচিত। বিশেষ করে কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামায, দোয়া-দরুদ পাঠ, জিকির-আজকার পড়া ইতিকাফকারীর নৈতিক কর্তব্য। এছাড়া কোরআনের অনুবাদ-তাফসীর, হাদিস ও ফেকাহর কিতাবাদি চর্চা করা যেতে পারে। শবে কদর প্রাপ্তিই যেহেতু ইতিকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য, তাই সার্বক্ষণিক ইবাদত করার মাধ্যমে একে অর্জন করে নিতে হবে।