স্বপ্ন সবাই দেখে। পূরণ হয় কেবল যোগ্যদেরই। ১৬ বছরের আনসু ফাতি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন কিশোর বয়সেই। আফ্রিকার গিনি-বিসাউর মাঠ থেকে তিনি পৌঁছে গেছেন বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্পে।
বিশ্বের সেরা তারকাদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েছে বিস্ময় বালক আনসু। কেবল নেমে পড়াই নয়, মাঠে ভালো করে পা রাখতে না রাখতেই সে বল জড়িয়ে দেন জালে! দু’মিনিটের মধ্যেই গোল পায় সে। গ্যালারিতে থাকা ৮০,০০০ ক্যাম্প ন্যু ভক্ত রীতিমতো সম্মোহিত হয়ে পড়েন। আনসু মাঠ ছাড়ার সময় তাকে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ দেয় তারা। লা লিগার অভিষেকেই তার এহেন কীর্তিতে অভিভূত ফুটবল বিশ্ব।
বার্সেলোনার জার্সিতে অভিষেকের পর থেকেই ফুটবল বিশ্বের আলোচনায় অন্যতম ইস্যু ফাতি। এই টিনএজ উইঙ্গারকে নিয়ে চলছে মাতামাতি। এসবের মধ্যেই একটি সুসংবাদ পেয়েছেন এই বিস্ময় প্রতিভা। স্পেনের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে তাকে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করতে এখন থেকে কোনো বাধা এই তার। ফলে আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে স্প্যানিশ জার্সিতে দেখা যেতে পারে ফাতিকে। যদিও তার বাবা বলেছেন, তার ছেলে পর্তুগালের হয়ে খেলবে বলেই স্বপ্ন দেখেছিলেন।
মাত্র সাত বছরে স্পেনে প্রথমবার আসা। তারপর নিজের প্রতিভার জোরে বার্সেলোনাক বিখ্যাত যুব অ্যাকাডেমি ‘লা মাসিয়া’য় সুযোগ। বয়স তখন ১০। পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র দেশ থেকে এমন উত্থান সত্যিই রূপকথার জন্ম দেয়। তার দেশের বাচ্চারা এখন দেশের লাল মাটির উপর দিয়ে দৌড়ে ক্রান্তীয় গাছের ফাঁকে ফাঁকে চেঁচিয়ে বলছে ‘আনসু ফাতি, বার্সা খেলোয়াড়’।
ছোটবেলায় আনসুর কোচ মালাম রোমিসিও মিডিয়াকে বলেন, মোজা বা প্লাস্টিকের জুতো পরে ফুটবল খেলার সেই শুরুর দিনগুলোতেও লম্বা ড্রিবলে চমকে দিত আনসু। বার্সেলোনায় ঢুকে পড়েছে প্রিয় শিষ্য। যদি সে এভাবে চালিয়ে যায়, তাহলে একদিন মহান খেলোয়াড় হবে।’
২০০২ সালের ৩১ অক্টোবর জন্ম আনসুর। গিনি-বিসাউ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এক দেশ। সেখানে জন্মানোর পর একটু বড় হতে স্পেনে আসা। তার আগে ছ’বছর বয়সে বাবা বরি ফাতির সঙ্গে পর্তুগালে কাজের খোঁজে আসা। দাদার সূত্রে আবারও পর্তুগালেরও নাগরিক। ছয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে তিনি চলে যান স্পেনে। বেড়ে ওঠেন সেভিয়ায়। নিয়ম অনুসারে, দেশটিতে ১০ বছর থাকার পর নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। প্রক্রিয়া শেষে স্পেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফাতিকে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ছোট বয়স থেকেই নিজের বিস্ময় ফুটবলে প্রভাব ফেলতে শুরু করে আনসু। সতীর্থদের থেকে সে ছিল একেবারেই আলাদা। প্রতিভায় বহু এগিয়ে। তার প্রথম স্প্যানিশ কোচ জর্দি ফিগারোয়া মোরেনো জানান, ‘টেকনিক ও ট্যাকটিক্স, দু’দিক দিয়েই সে ছিল আলাদা। ওই ছোট বয়সে দল হিসেবে খেলার মতো ক্ষমতা সবার থাকে না। ওর সব ছিল।’
তার বাবা জানান, ছেলেকে তিনি বলেছেন সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সকলকে নিয়ে সুখে থাকতে। আর মাঠে নেমে কী করতে হবে, তাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘রোজ আমি তাকে বলি, এটাই তোমার কাজ। যখনই বল পাবে, গোলের দিকে ছুটবে। অন্যকোনো দিকে তাকাবে না।’
দৌড় শুরু করেছে কিশোর আনসু। আর ফুটবল বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখছে আনসু ফাতিকে। জীবনটাই যার রূপকথা।
কিন্তু ফাতির জীবন রূপকথার হলেও সেটা আফ্রিকার জন্য মোটেই ভালো কিছু নয়। কারণ, ইউরোপের কাছে আরও একটি রত্ন হারালো মহাদেশটি। রাশিয়া বিশ্বকাপ শেষে ইউরোপের কাছে ফুটবল প্রতিভা হারানোর প্রসঙ্গ উঠেছিল। যেটা তোলেন হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান অধ্যাপক চুকু অনউইমুচিলি।
তিনি বলেছেন, বিশ্বকাপ শেষে রাশিয়া অনেক দেশের চেয়ে বেশি শিক্ষা দিয়েছে আফ্রিকাকেই। তাই ইউরোপের কাছে ফুটবল প্রতিভা হারানোর কারণও খুঁজতে বলেন তিনি।
কারণ, ফ্রান্সের বিশ্বজয়ী ২৩ জনের দলে ১৫জনেরই শিকড় আফ্রিকার। সেমিফাইনালিস্ট বেলজিয়ামের ২৩ জনের ৯ জন। শুধু এই দুটি দেশই নয়, সেমিফাইনাল খেলা ইংল্যান্ড দলেও ছিল আফ্রিকান প্রতিনিধিত্ব। ডেলে আলি (নাইজেরিয়া) ও দানি ওয়েলব্যাক (ঘানা)। ফ্রান্স দলের তিন আফ্রিকান তারকা কন্তে, এমবাপে ও পগবা
২০১৭ অনূর্ধ্ব-২০ ফিফা বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। ওই দলের অন্তত ছয়জন খেলোয়াড় ছিলেন যারা শুধু নাইজেরিয়ার হয়েই খেলতে পারতেন।
এটা অবশ্য নতুন বিষয় না। আফ্রিকার ফুটবলার হারানোর গল্পটা অর্ধ শতকেরও বেশি সময় পেছনের। ৮০ বছর আগে, ১৯৩৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের রক্ষণ আগলেছেন সেনেগালের ডিফেন্ডার রাউল ডায়গনে। ফরাসি জার্সিতে ১৮ ম্যাচ খেলা রাউল ডায়গনে পরে স্বাধীন সেনেগালের প্রথম কোচ হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে তার অধীনেই প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে ফ্রান্সকে হারায় সেনেগাল। যার দরুন ন্যাশনাল হিরো হয়ে গিয়েছিলেন রাউল।
কয়েক দশক ধরেই আফ্রিকান সংযোগের অন্যান্য খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপে তাদের পদচিহ্ন তৈরি করেছেন। যেমন ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের জার্সিতে খেলে সুপারস্টার হয়ে যান মরক্কোর জুস্ত ফোঁতেন। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে একই পথে হেঁটেছেন পর্তুগালের হয়ে খেলা মোজাম্বিকের ইউসেবিও। আর ১৯৯৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ফ্রান্স দলের প্রধান নিউক্লিয়াস তো ছিলেন আলজেরিয়ান জিনেদিন জিদানই। এ রকম আরও অনেকেই আছেন।এখন প্রশ্ন, আফ্রিকান দেশগুলো কি এই চক্র ভাঙতে পারবে?