সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণী থেকে স্নাতক পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। বৈশ্বিক বাস্তবতার নিরীখে এই উদ্দ্যোগ অপরিহার্য। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় দক্ষ করে তুলতে না পারলে এর পরিণতি যে ভালো হবে না, তা হলফ করে বলা যায়। কেবল আন্তর্জাতিক যোগাযোগ,ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভালো চাকরির জন্য ইংরেজি ভাষা জানতে হবে এমন নয়।
বরং একজন শিক্ষার্থীকে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন তথা জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে হলে ইংরেজি শেখার বিকল্প নেই। অন্ততঃ এই দিক বিবেচনা করলেও ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। সুতরাং শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় সরকারের চলমান প্রচেষ্ঠা কতটুকু সফল হচ্ছে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে এই বিষয়টির প্রতি সরকারের উপলব্ধি ও বাস্তবায়নের উদ্দ্যোগ প্রশংসনীয় বলতে হবে।
যদিও একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে ইংরেজি ভাষাকে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা’র মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস নেন। এই শ্রেণীভুক্ত শিক্ষিত কিছু মানুষের পাল্লায় পড়েই তৎকালীণ এরশাদ সরকারের অতিরিক্ত আবেগের কবলে পড়ে ইংরেজি শিক্ষা ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়। যার ফল মোটেও ভালো হয়নি।
যা হোক, মূল আলোচনায় আসা যাক। বর্তমানে আমাদের দেশে ‘কমিউনিকেটিভ এ্যাপ্রোচ’ এর মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার সিস্টেম চালু রয়েছে। দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ‘লিটারেচার ও গ্রামার-ট্রান্সলেশন’ পদ্ধতির বদলে কমিউনিকেটিভ পদ্ধতির মাধ্যমে পাঠদান শুরুর দিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে এক মহা বিব্রতকর অবস্থায় ঠেলে দেয়। সবচেয়ে বিপদের সম্মুখীন হোন ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক।
তবে, স্বল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রাণলয় ও বৃটিশ কাউন্সিলের যৌথ উদ্দ্যোগে পরিচালিত দেশ ব্যাপী প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিষয়টিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে কিছুটা হলেও বোধগম্য করে তুলে। তারপর বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্রাক’র অধীনে ‘পেইস’ প্রকল্পের মাধ্যমে তা অধিকতর শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করে। এসব প্রশিক্ষণের সুবিধা পেয়েছে কেবল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
ব্রাক ও বৃটিশ কাউন্সিল এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সীমিত কিংবা গুটিয়ে নেওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্ববধানে সেসিপ’র আওতায় টিকিউআই সিপিডি ইত্যাদি প্রকল্প স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে । এসব প্রশিক্ষণের পরিকল্পণা,কার্যকারিতা, তদারকি ও আউটপুট নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। তবে, কমিউনিকেটিভ পদ্ধতিটি এখন আর ভূতুরে ভয় সৃষ্টি করেনা। না শিক্ষকের ক্ষেত্রে, না শিক্ষার্থীর কাছে ।
এত উদ্দ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রশ্ন হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থে ইংরেজি ভাষা কতটুকু শিখছে ? একজন শিক্ষার্থী সফলতার সাথে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে কি ? কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই ! প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা অতিক্রম করে শিক্ষার্থীর চারটি শুদ্ধ বাক্য ইংরেজিতে লিখতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যাবেনা। বরং কিছু ক্ষেত্রে এমন অনেকের কাছে ‘ভয়ানক ইংরেজি’র মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়েই আবারো প্রশ্ন করতে হয়, এই ভয়াবহ অবস্থার দায় কার? চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও তার ইংরেজি ভাষা শিক্ষকদের । এই দায় অস্বীকার করা কঠিন। অভিযোগ কেবল শিক্ষক’র চাপিয়ে দিলেই সব কিছু শেষ হয়ে যাবেনা। এখানে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীণস্থ প্রকল্প বাস্তবায়ঙ্কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর দায় অনেকটাই বর্তায়। কারণ, এরা কখনো তদারকি করেনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি ভাষার ক্লাস কিভাবে নেওয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার কোন খোঁজখবর নেওয়া হয়না।
দেখা যায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করার সময় নব লব্ধ জ্ঞান কাজে না লাগিয়ে, পুরনো পদ্ধতিতেই ক্লাস চালিয়ে নেন। ইংরেজি ক্লাসে হরদম বাংলা বলে ইংরেজির মত একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষার ক্লাস করে যান নিয়মিত । প্রাথমক ও মাধ্যমিক উভয় ক্ষেত্রেই এটাই ইংরেজি শিক্ষার প্রকৃত চিত্র।
দেখা যায়, শিক্ষক ইংরেজি ক্লাসে টেক্সট বই থেকে কোন একটা লেসন পড়াচ্ছেন আর তার বাংলা অর্থ বলে যাচ্ছেন। এভাবে লেসনটি ‘পাঠ করা’ শেষ হলে আলাদা আলাদা শব্দের বাংলা উচ্চারণসহ তার অর্থ বলে দিচ্ছেন। হোম টাস্ক হিসেবে এই লেসন কিংবা নতুন কোন একটি লেসন দেওয়া হচ্ছে তার লাইন টু লাইন অর্থ সহ শিখে আসার জন্য। মজার ব্যাপার হলো, ইংরেজি স্যার সারা ক্লাস জুড়ে টেক্সট বই’র বাইরে একটি ইংরেজি শব্ধও উচ্চারণ করেননা ! সব স্কুলের বেলায় এই চিত্র সঠিক নয়।
তবে, দেশের অধিকাংশ বিশেষকরে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার এই গল্প নিত্য দিনের চিত্র। শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, এমন কোন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ইচ্ছা করলে এই বিষয়ে সরেজমিন রিপোর্ট করতে পারেন। বলাবাহুল্য, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়না। যদিও সম্প্রতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের সিস্টেম চালু হয়েছে। তবে সব বিষয়ে নয়। অধিকাংশ স্কুলে যারা বিভিন্ন শ্রেণীতে ইংরেজি পড়ান এবং বয়সে একটু প্রবীণ তাদের বেশির ভাগের স্নাতক ডিগ্রিতে ইংরেজি বিষয় নেই।
অবশ্য সদ্য নিয়োগ প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রি নিয়েই শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করতে হয়। তবে, ইংরেজি ক্লাসে বাংলা বলায় নবীণ-প্রবীণ সবাওই একই কাতারে। ফলশ্রুতিতে যা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বিষয়ের কিছু নির্দ্রিষ্ট আইটেম মুখস্থ করা ছাড়া ইংরেজি লেখা বা বলার সুযোগ পায়না। কিন্তু, ক্লাসরুম হতে পারতো ইংরেজি ভাষা প্র্যাকটিস করার সবচেয়ে নির্ভয় ও উত্তম স্থান। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইংরেজি শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা প্রশাসনের উচিত এ দিকটায় অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া। শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয়ে ভালো নম্বর অর্জন করা আর ব্যবহারিক ইংরেজির জ্ঞান অর্জন করা এক কথা নয়। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যতো এটাই ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)