সোমবার দেশের কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে ক্রিকেট নিয়ে দুটি অন্যরকম খবর ছিল। তার একটির শিরোনাম- বিপিএল নিয়ে বাজিতে বাধা দেওয়ায় শিক্ষার্থী খুন। আর দ্বিতীয় খবর- ৩ কাঠা জমি পাচ্ছেন মিরাজ। এবার আসুন খবর দুটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে জেনে নিই। চলমান বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ম্যাচ নিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় জনৈক আবদুর রশীদ জুয়ার আসর বসায়। সেখানে চলমান ম্যচ নিয়ে বাজির আয়োজন করা হয়। স্থানীয় নাসিম নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আগের দিন রোববার সন্ধ্যায় জুয়ার আসরে বাধা দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পরের দিন সোমবার সকালে রশীদ ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে নাসিমকে হত্যা করে।
দ্বিতীয় ঘটনার সারমর্ম হলো- বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার মেহেদি হাসান মিরাজ থাকেন খুলনার খালিশপুরের একটি ভাড়া বাড়িতে। সংবাদমাধ্যমে গত বছর এ খবর প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশ দলের তরুণ এই অলরাউন্ডারের পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণের নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় মিরাজকে তিন কাঠা জমি দিচ্ছে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে খবরে প্রকাশিত মিরাজের বয়ানটাই জানা যাক। মিরাজ বলেন, “গত বিপিএলের শুরুতে আমাকে জানানো হয়েছিল জমি দেওয়া হবে। সেই প্রতিশ্রুতি তারা রেখেছে। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এটির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। আরও আগেই হয়ে যেত, আমি ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সময় বের করতে পারিনি।”
প্রিয় পাঠক, আমরা যে যেভাবেই দেখি না কেন শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট একটি খেলাই। খেলার বাইরে এটি আর কিছু নয়। কিন্তু এই খেলাটিকে আমরা দু:খজনকভাবে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি যেখানে আবেগসর্বস্ব সস্তা এক জাতির লক্ষণই ফুটে ওঠে। ক্রিকেটকে আমরা আবেগের দোসর বানিয়েছি, বাণিজ্যের হাতিয়ার বানিয়েছি, আনন্দকে করেছি পণ্য আর ক্রমাগতভাবে ছুটে চলেছি যুক্তিহীন সস্তা বিনোদনের পুঁজিবাদী ফানুসের পেছনে। প্রশ্নহীন এক সমাজ বিনির্মাণে জেনে না-জেনে, বুঝে না-বুঝে ডুব দিয়েছি ক্রিকেটের বাণিজ্যিক কুয়োয়। আমি খেলা হিসেবে ক্রিকেটের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু ক্রিকেটই একটি জাতির সবকিছু হতে পারে না। এটি খুবই যুক্তিহীন যে, কোনো একটি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ বাংলাদেশ দল জিতে গেলেও প্রধানমন্ত্রী শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান, গণভবনে ডেকে নিয়ে হাতে গাড়ি বাড়ি তুলে দেন।
ক্রিকেট উন্মাদনায় ডুবে থাকা বাঙ্গালি যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে বলে, একমাত্র ক্রিকেটেই সমস্ত বাঙ্গালি এক সুরে কথা বলে, সবাই একাত্ম হয়ে যায়। খুবই খাঁটি কথা। কিন্তু তাতে কী যায় আসে! ক্রিকেটের আফিমে একতাবদ্ধ হয়ে যাওয়া জাতি আর কোন জাতীয় ইস্যুতে একতাবদ্ধ? চাল পেঁয়াজের স্মরণকালের সর্বোচ্চ দামের বিরুদ্ধে তাদের মানববন্ধন কোথায় যারা বিশ্বকাপের দলে কে থাকবে না থাকবে তার দাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় শাহবাগে? রামপালের বিদুৎ কেন্দ্রের প্রতিবাদে সেই তারুণ্য কোথায় যারা মাশরাফির অবসরের ঘোষণা ঠেকাতে স্টেডিয়ামের সামনে বিশাল ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? ক্রিকেট আমাদের সবার, অথচ রামপাল নিয়ে লড়ে যাবে শুধু আনু মুহাম্মদরা! মাশরাফির বিদায়ে চোখের পানি ঝরে, অথচ কাঁটাতারে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশকে মনে করি এটা রাষ্ট্রের বিষয়!
রাষ্ট্রও আমাদেরকে পেয়ে বসেছে। এমন একটি আবেগপ্রবণ প্রশ্নহীন ক্রিকেটসর্বস্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি করতে পারলেই ক্ষমতা চর্চার পথ সুগম হয়। এমন একটি রাষ্ট্রই সেখানে বিনির্মাণ হয় যেখানে তরুণরা রাষ্ট্রের ক্রিটিক্যাল ডিসকোর্স নিয়ে আলোচনা করবে না, রাষ্ট্রের চলমান গতিধারাকে প্রশ্ন করবে না, ক্ষমতা-কাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলবে না। ক্রিকেটেই দিন শুরু, ক্রিকেটেই শেষ!
এই চিত্র বিচ্ছিন্ন নয় বলে আমাদের মিরাজরাও হাঁটে না তাই ভিন্ন কোনো পথে, চলে না ভিন্ন কোনো তরিকায়। প্রিয় এবং অনুজ মেহেদি হাসান মিরাজ, আপনার স্পিন বোলিং দেখে আমি যতটা আনন্দিত হই, আজ আপনার কথাগুলো পড়ে আমি ততটাই বিস্মিত এবং ব্যথিত হয়েছি। আপনার মতো অসংখ্য বাঙ্গালি ভাড়া করা বাড়িতে থাকে। এটা কোনো পাপ নয়। নিজের কষ্টের উপার্জনে সামর্থ্য হলে আপনি একটি বাড়ি করতে পারতেন। আপনি ভালো ক্রিকেট খেলেন এটি আপনার যোগ্যতা। সেই যোগ্যতার বলেই আপনি গাড়ি বাড়ি সব একদিন পাবেন।
কিন্তু আজ যে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিলেন সেটি আপনার অযোগ্যতা। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় দলে খেলা একজন ক্রিকেটারের অর্থনৈতিক অভাবে থাকার কথা নয়। তবুও আপনাকে তিন কাঠা জমি দেওয়া হলো সেই দেশে যেখানে অর্থকষ্ট সইতে না পেরে পঙ্গু কৃষক আত্মহত্যা করে গলায় ফাঁস দিয়ে (দৈনিক যায়যায় দিন, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)। যেই দেশে অভাবের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মাত্র পাঁচ শত টাকার বিনিময়ে দেড় বছরের শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন এক গর্ভধারিণী মা (যুগান্তর, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭)।
সাভারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে টাকা দিতে না পারায় দুই রোগীকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে হাসপতালে আটকে রাখা হয়। এদের একজন মানিকগঞ্জের রাজবানু আবার এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (প্রথম আলো, ২০ নভেম্বর, ২০১৫)! মুক্তিযোদ্ধাদের ইবা কী অবস্থা! ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হকের দিন কাটে রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে (সকালের খবর, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬)। অসহায় মুক্তিযোদ্ধা মরে গেলে কবরের জন্য তিন হাত জমি পায় না যে দেশে, সেখানে রাষ্ট্রের তিন কাঠা জমি বিলিয়ে দেওয়া হয় সামর্থ্যবান এক টগবগে যুবকের হাতে! ক্রিকেটের কাছে পরাজিত সব।
ক্রিকেট নিয়ে জুয়ার আসরে বাধা দেওয়ার কারণে বাড্ডায় ছেলেটিকে মেরে ফেলার ঘটনা আমাদেরকে আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল- ক্রিকেট আজ আর ক্রিকেটের জায়গায় নেই। নিরীহ নির্মল আনন্দদায়ী এই খেলাটির প্রতি আমাদের অতিরিক্ত আবেগ শুধু মনোজগতেই স্বস্তা অনুভূতির চাষ করছে- তা-ই শুধু নয়; বরং এই খেলাকে কেন্দ্র করে কুৎসিত জুয়ারী মানবসমাজ তৈরি হচ্ছে এই দেশে।
আসুন, আমরা শুধু ক্রিকেটটাই খেলি; ক্রিকেট যেন আমাদেরকে নিয়ে না খেলে! বলে রাখা ভালো, এর জন্য ক্রিকেট নিজে দায়ী নয়; দায়ী আমরাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)