৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ৮৫ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রীর জন্য আওয়ামী লীগ জোট সরকারের টানা দুই মেয়াদে এটি টানা দশম আর ব্যক্তিগতভাবে দ্বাদশ বাজেট।
নির্বাচনী বছর, তাই বাজেট তৈরিতে নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে কর বসানোর ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন বলে আগেই জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সে অর্থে ব্যক্তিগত কর থেকে করপোরেট কর প্রায় অপরিবর্তিত থাকছে বলে ধরে নেয়া যায়। যা ব্যক্তি পর্যায় ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সুখবর বলা যেতে পারে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থ বছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৭.৮%। বাজেটে রাজস্ব আয়ের সম্ভাব্য আকার ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি, ভ্যাট থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি, আয়কর থেকে ১ লাখ ২০০ কোটি আর শুল্ক থেকে আয় হতে পারে সাড়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা যতই ধার্য করা হোক না কেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা (জিডিপি’র ৪ দশমিক ৯ শতাংশ) দাঁড়াবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এই ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস থেকে ৫৪ হাজার ৬৭ কোটি টাকা (জিডিপি’র ২ দশমিক ১ শতাংশ) এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা (জিডিপি’র ২ দশমিক ৮ শতাংশ) সংগ্রহ করা হবে। নিশ্চিত করে এটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫.৬%, যা প্রায় নিশ্চিত করে সেইমাত্রায় জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। সামগ্রিক এই অবস্থার বাইরেও প্রতি বাজেটের ন্যায় এ বাজেটেও কিছু পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে। বিদেশি মোবাইল, আমদানি করা ইউপিএস, আমদানি করা আইপিএস, আমদানি করা বাইসাইকেল, এনার্জি ড্রিংক, সিগারেট, বিড়ি, জর্দা-গুল, সিরামিক, রিকন্ডিশন্ড গাড়ি, পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের দামও বাড়ছে। বাড়বে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের খরচ। এছাড়া শেভিং ক্রিম, সুগন্ধযুক্ত বাথ সল্ট এবং অন্যান্য গোসল সামগ্রী, ঘরের দুর্গন্ধ দূরীকরণে ব্যবহৃত সুগন্ধি সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রীর দাম বাড়বে এবারের বাজেটে। পেট্রোলিয়াম জেলি, কাগজের বিদেশি মণ্ড, বিদেশি অ্যালুমিনিয়ামের দামও বাড়বে।
ভার্চুয়াল ও ডিজিটাল খাত যেমন- ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব ইত্যাদির বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের উপর করারোপের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে বাজেটে। হেলিকপ্টার সেবার উপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আবাসন, খাদ্য বা পানীয় সরবরাহকালে হোটেল বা রেঁস্তোরায় মদ জাতীয় পানীয় সরবরাহে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। ফিলামেন্ট ল্যাম্পের ব্যবহার কমানোর জন্য ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। মুদ্রিত লিফলেট, ব্রোসিয়ার, প্রিন্টেড পোস্ট কার্ড, প্রিন্টিংস কার্ড, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি আমদানিতে শুল্ক-কর বৃদ্ধি করা হবে। এতে দাম বাড়বে সেসব পণ্য ও সেবার দাম। এছাড়া সম্প্রতি উদীয়মান বাজার হিসেবে চিহ্নিত অনলাইন বা ই-কমার্স খাতে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর ঘোষণা এসেছে, যা নেতিবাচক বলে বিবেচিত হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরে সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে। এরপরই রয়েছে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ, যা খুবই ইতিবাচক। এবারের বাজেটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, দেশিয় উৎপাদন ও প্রযুক্তির প্রতি বিশেষ ছাড় দেবার প্রবণতা। যেমন, দেশিয়ভাবে তৈরি মোবাইল ফোনের দাম কমবে, কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানী মোবাইলের দাম বাড়বে। এভাবে দেশীয় মোটর সাইকেল, হাইব্রিড গাড়ি গাড়ির দাম কমানোর প্রস্তাব এসেছে বাজেটে। কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তদের জন্য ঋণ আবেদন ফি ২০০ টাকায় সীমিত রাখা এবং মেয়াদ পূর্তিতে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কোন চার্জ আদায় করা যাবে না বলেও ঘোষণা এসেছে। এগুলো নিঃসন্দেহে আমদানী নির্ভর প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসে দেশে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
নানা অনিয়মে গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজার। মূলত পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ায় দেশের আর্থিক খাত সংকটে পড়ে। তাই এ খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে প্রচলিত আইন সংস্কারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারির কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, যা ইতিবাচক বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। তবে তা নির্ভর করছে ভবিষ্যতে প্রকৃত বাস্তবায়নের উপরে।
বলা যায়, এবারের বাজেট মানবিক। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত ভাতার বাইরে বৈশাখী ও বিজয় ভাতা নামে দুটি বিশেষ ভাতা যুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে ১০ লাখ। মাতৃত্বকালীন এবং দুগ্ধদানকারী গরীব কর্মজীবি মায়েদের ভাতা ৩০০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হাসপাতালগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা করার নির্দেশনার পাশাপাশি সেবা না দিলে অতিরিক্ত করারোপের ঘোষণা এসেছে। দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির জন্য রয়েছে বিশেষ বরাদ্দ। মরণব্যাধী ক্যান্সারের ওষুধের দাম কমছে। এছাড়াও প্রস্তাবিত বাজেটে ওষুধের কাঁচামাল, পোল্ট্রি সামগ্রী, স্থানীয় ফেব্রিক, স্টার্চ, ফ্রিজ, মুদ্রণ সামগ্রী, জিপি শিট, সিআই শিট, ব্লেড, চশমার ফ্রেম, দেশীয় মোটর সাইকেল, হাইব্রিড গাড়ি, টায়ার টিউব, দেশীয় সেলুলার ফোন, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, কর্নফ্লাওয়ার, বিদেশি কলম, কেক-বিস্কুটের দাম কমছে।
অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। তবে সম্প্রতি একটি জিনিস লক্ষ্য করা যায় যে, জাতীয় বাজেটের আকার প্রতি বছর বাড়লেও বাস্তবায়নের হার ক্রমান্বয়ে কমছে। কোনো কোনো সময় সে হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে থাকছে। এসবের মধ্যে জনকল্যাণমূলক ও প্রান্তিক বিভিন্ন খাতে বাস্তবায়ন অনেক সময় ৫০ শতাংশের নীচেও থাকে, কখনওবা অব্যবহৃত থাকে কিছু পরিকল্পিত বরাদ্দ, যা আসলে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা বলে আমাদের ধারণা। সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে বাজেট বাস্তবায়নে সরকার সক্রিয় হবে, এই আমাদের আশাবাদ।