চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আসলেই নারীমুক্তি নাকি শুধু আলোড়ন তোলাই লক্ষ্য?

বেগম রোকেয়া তার সময়ে নারী জাগরণের লক্ষ্যে সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থেকে সাহসী লেখা লিখেছেন। লেখার মাধ্যমে এখনো তিনি সমাজকে আলোড়িত করে যাচ্ছেন। বেগম রোকেয়ার মতো সেরকম চিন্তার গভীরতাসহ লেখক আমরা পরে আর পেয়েছি কি?

১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ অর্থাৎ তার সাংগঠনিক সংগ্রামের শতবর্ষ পূর্তিতে তার জন্মবার্ষিকীতে এ প্রশ্নের উত্তরে মিশ্র বক্তব্য পাওয়া গেছে লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের কাছ থেকে।

শিক্ষাবিদ আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘বেগম রোকেয়ার লেখার উদ্দেশ্য ছিলো মানুষের মন পরিবর্তন করা এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। তাছাড়াও সমাজ সংস্কার এবং উন্নত জীবন সম্পর্কে তার চেতনা ছিল। এই চেতনা কায়েমী স্বার্থবাদীদের আঘাত করেছে সে কারণে তারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সমাজে তিনি সাড়া ফেলেছেন বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।’

আবুল কাশেম ফজলুল হক

উদাহরণ দিয়ে তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পরবর্তীতে নারীদের নিয়ে তসলিমা লিখেছেন, হুমায়ূন আজাদ লিখেছেন। আরো কেউ কেউ আছেন যারা খুব সাড়া জাগানিয়া লেখা লিখেছেন।  সাড়া জাগানোই এদের উদ্দেশ্য ছিল। বেগম রোকেয়ার সময় আর এই সময়ের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন।’

তার মতে, ‘এখানে যারা সাড়া জাগানিয়া লেখা লিখেছেন তাদের লেখার ফল হয়েছে উল্টো। আমাদের ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরে গেছে। এই জাতি অনেক সংগ্রাম-সাধনা করে, বাধা অতিক্রম করে উন্নতির দিকে আসছিল সেসব বাদ দিয়ে এখন উল্টো দিকে যাচ্ছে। দাড়ি, টুপি, বোরকা, হিজাব, দরগা, মসজিদ, তাবলীগ জামাত, সুফী সম্মেলন এসবের প্রসার ঘটেছে।’

নারী বিষয়ক ওয়েব পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধর অবশ্য বলছেন, ‘বেগম রোকেয়ার পর আমরা সুফিয়া কামালকে, নূরজাহান বেগমকে পেয়েছি। আরো পরে তসলিমা নাসরিনকে পেয়েছি। তার সময়ে যে প্রেক্ষাপটে বেগম রোকেয়া যেসব কথা বলে গেছেন, এতো বছর পরে এসে এখনো রোকেয়ার চিন্তা সমানভাবে প্রযোজ্য।’

সুপ্রীতি ধর

‘এখন নারীরা যতটা সোচ্চার হতে পারছে সেটা বেগম রোকেয়ারই বোনা বীজ। তারই ধারাবাহিকতায় সময়ের সাথে সাথে নারীরা অগ্রসর হয়েছে। বেগম রোকেয়া তার সময়ে যে জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তসলিমা আসার পর নতুন করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন।’ এমনটাই মনে করেন সুপ্রীতি ধর।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক বখতিয়ার আহমেদ বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির চিন্তা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন এভাবে,বেগম রোকেয়ার যে বিপ্লবী চিন্তাধারা সেখানে স্পষ্টভাবেই ইউরোপীয় আধুনিকতার-চিন্তাধারার প্রভাব ছিল। তার ভেতরে উপনিবেশের ভেতর দিয়ে আসা চিন্তার প্রবল প্রভাব ছিল। রোকেয়ার বিপ্লব ছিলো দুটি জায়গায়: ১. বাংলা লিখবার সিদ্ধান্ত এবং বাংলা সাহিত্য চর্চা। ২. নারী মুক্তির প্রধান শর্ত হিসেবে নারী শিক্ষার কথা বলেছেন তিনি। এই শিক্ষার বিষয়টি ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপে তখন একেবারে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এমন একটা সত্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, রোকেয়ার যে শিক্ষা সেটা এক সময় ছিল অভিজাত স্বচ্ছল শ্রেণীর জন্য। তার সময়ের বিচারে বিপ্লবী চিন্তা ছিল। বিশেষত সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী-তে নারী-পুরুষের শ্রম বিভাজনকে তিনি তীব্রভাবে প্রশ্ন করছেন। তাছাড়া নারীকে গৃহের মধ্যে বন্ধ রাখার বিরুদ্ধে তিনি পশ্চিমের আধুনিক চিন্তাকেই গ্রহণ করেছেন।’

‘চিন্তায় বেগম রোকেয়া বিপ্লবী ছিলেন পাশাপাশি চর্চায় তিনি উদার ছিলেন।

হুমায়ুন আজাদ

সাহসের প্রশ্নে তার সংগ্রাম ছিলো তার নিজ শ্রেণীর মধ্যে। তার বিপ্লব ছিল লেখনীর মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে সময় বেশীরভাগ মানুষ পড়তে পারতো না। সে প্রেক্ষাপটে তুলনা করলে বাংলা ভাষায় লেখালেখিতে নারীবাদী লেখার ক্ষেত্রে রোকেয়ার পর নারীবাদী লেখালেখি করেছেন তসলিমা নাসরিন। ৯০ দশকের পর নারীদের চিন্তার জায়গায় কেউ যদি ধাক্কা দিতে পারেন, তিনি তসলিমা নাসরিন,’ বলে তিনি মনে করেন।

চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: রোকেয়া তার বিপ্লবী চিন্তা থেকে সমাজের প্রতি আক্রমণাত্মক ছিলেন না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় নারী মুক্তির বিষয়টি যেহেতু আরো স্পষ্ট হয়েছে সেহেতু তসলিমা আরো আক্রমণাত্মক হতে পেরেছেন। তাছাড়া জনপরিসরে তসলিমার লেখার যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হতো সেটার কারণে তসলিমা সমাজ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘১৯৮০-৮১ সালের দিকে যখন মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হলো, নারীবাদী আন্দোলনের জোয়ার শুরু হলো তখন এইসব আন্দোলন দ্বারা গরীব মানুষ, অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষ তাদের মর্মবোধে আঘাত পেলেন। সেই সময় থেকে আন্দোলনকারীরা ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলো। যারা গণতন্ত্র চাইতো, সমাজতন্ত্র চাইতো তাদেরকে দেখা গেলো গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ছেড়ে আবার ধর্মের দিকে চলে গেছে। কারণ গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে যেসব অপকর্ম হয়েছে এই অপকর্মগুলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বিষয়ে মানুষের আস্থা নষ্ট করে দিয়েছে। গরীব, অসহায় মানুষগুলো আদর্শগত অবলম্বন চায়। সেই অবলম্বন মানুষ গণতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে পাবে বলেই এগিয়েছিলো।’

নূরজাহার বেগম

আবুল কাশেম ফজলুল হক মনে করেন, বেগম রোকেয়ার দৃষ্টি ছিলো প্রগতির দিকে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের কথা তিনি বলেননি কিন্তু তার চিন্তা-চেতনা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের স্পিরিটকেই সহায়তা করেছে। যখন আমরা গণতন্ত্রকে ব্যর্থ করলাম তখন সাধারণ মানুষ বদলে যেতে লাগলো। যারা ধর্ম ব্যবসায়ী তারা তখন সুযোগ নিলো। রাজনীতিতে দেখা গেলো যাদের যা বলার কথা নয়, তারা তা বলছেন। এরকমভাবে ইতিহাস উল্টে গেলো।’

তবে, বেগম রোকেয়ার চেতনাকে নারীবাদীরাও ধারণ করছেন না বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তার মতে, ‘যারা আমাদের দেশের গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী তারাও ধারণ করছেন না। তিনি অভিযোগ করেন, বেগম রোকেয়ার আন্তরিকতা-সততা ছিল। এখন যারা আছেন তাদের আন্তরিকতা-সততার অভাব রয়েছে। বিদেশী টাকার জন্য অনেক আন্দোলন হচ্ছে, টাকা বন্ধ হয়ে গেলে এগুলো আর থাকবে না।’

তসলিমা নাসরিন

বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তব রূপ পায়নি স্বীকার করে সুপ্রীতি ধর বলেন, ‘বেগম রোকেয়া যখন স্কুল শুরু করেন তখন সেটা মুসলিম নারীদের জন্য বিশাল জাগরণ ছিলো। ওই সময়ে যারা আলোকিত হয়েছে তারা সবাই লিখেছেন না কিন্তু আলোকিত মানুষ পাওয়া গেছে। সে আলোর বিচ্ছুরণ তো এসেছে এই পর্যন্ত। কেউ না কেউ কথা বলে গেছে। এখনো বলা হচ্ছে। তিনি মেয়েদের জন্য যে দাবি করে গেছেন সেসব দাবি নিয়ে এখনো কথা বলা হচ্ছে। তার সময়ে তিনি একা ছিলেন। এখন অনেক অনেক বেশি নারী কথা বলছে। পার্থক্য এখানেই।’

বখতিয়ার আহমেদ মনে করেন, ‘নারী মুক্তির বিষয়টি বেগম রোকেয়া বা তসলিমা নাসরিনের চেয়ে আরো ক্রিটিক্যাল জায়গা থেকে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশেষ করে তার ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। অবরোধবাসিনীর সঙ্গে ‘ঘরে বাইরে’র তুলনা করলে দেখা যাবে, রোকেয়া নারীর ঘরের বাইরে সাবলীল হওয়াকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চাচ্ছেন, নারীকে ঘরের পরিসর থেকে বাইরে নিয়ে এসে দেখলে  পিতৃতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। নারীকে ঘরের বাইরে আনা মানে তাকে রাজনীতিতে, অফিস-আদালতে প্রতিষ্ঠা করা। ঘরের বাইর গেলে নারীকে পুরুষ হিসেবেই ভূমিকা পালন করতে হয়। রোকেয়ার নারীবাদ উদারনৈতিক নারীবাদ। তার সমাজে তিনি র‌্যাডিক্যাল কিন্তু বর্তমানে এসে সেটা উদারনৈতিক নারীবাদ।’

বখতিয়ার আহমেদ

বেগম রোকেয়া বা তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে কিছু বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘নারীর মুক্তি ভূমিকাকে নির্ধারণ করা হচ্ছে পুরুষকে একক ধরে। পুরুষ যা যা করতে পারে সেটাই নারী করতে পারলে নারী মুক্তি হচ্ছে। আরো বিপ্লবী নারীবাদীরা এখন এটাকে নারীমুক্তি মনে করেন না। খোদ নারীত্বের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সেটা পুরুষতন্ত্রের চেয়ে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হবে।’

‘আন্দোলন চলছে, আরো কথা বলতে হবে। তবে নারীমুক্তি আসবেই’ বলে বিশ্বাস করেন সুপ্রীতি ধর। তার মতে, এখনকার প্রজন্ম বেশ ভালোভাবে এগোচ্ছে। তারা ভিন্ন চিন্তা করছে।