সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে এ মাসের ১০ তারিখ থেকে লন্ডনে শুরু হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী ড.হাছান মাহমুদ। লন্ডনে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: বাংলাদেশের গণমাধ্যম কিছু বণিক-গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তারা চাইলেও সেই বণিক গোষ্ঠীর সমালোচনা করতে পারে না।
‘সেই বণিক গোষ্ঠী অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক রাখে। কিন্তু এটার স্বাধীনতা রক্ষায় যারা এর পেছনে অর্থলগ্নী করেছে, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ না করে কিভাবে কাজ করা যায় সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।’
আসলেই কি বণিকগোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে গণমাধ্যম? আমরাও এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।জানার চেষ্টা করেছি এ বিষয় নিয়ে কি ভাবছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ড. মো. গোলাম রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: কয়েক দশক ধরেই গণমাধ্যম বণিক গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এটা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম কখনো বণিক গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি। গণমাধ্যম আপাত দৃষ্টিতে বণিক গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হলেও কখনো প্রচ্ছন্নভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারাও পরিচালিত হয়ে থাকে।
তিনি বলেন: গণমাধ্যম চালাতে বিপুল অর্থের বিনিয়োগ দরকার। আর এ বিপুল পুঁজির বিনিয়োগের কারণেই গণমাধ্যম কোনো না কোনোভাবে বণিকদের হাতে চলে যায়। আর ব্যবসায়ীরা তাদের অন্য ব্যবসার নিরাপত্তা ও সহায়ক হিসেবে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতেই এই খাতে বিনিয়োগ করে থাকে। গণমাধ্যমকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। অনেক সময় দেখা যায় তাদের ব্যবসাকে ঠিক রাখার জন্য ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করতে তাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিউজ করে থাকে।
বণিক গোষ্ঠীর হাতে চলে যাওয়ার ফলে গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হচ্ছে, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
এমন এক প্রশ্নের উত্তরে ড. মো. গোলাম রহমান বলেন: গণমাধ্যমের পেশাজীবীদের উন্নয়ন না হলে অবস্থার আরো করুণ হতে পারে। এই জন্য পেশাদারিত্বের উন্নয়ন করতে হবে। গণমাধ্যমের সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। সংগঠনের নেতাদের পেশাদারিত্বের উন্নয়নের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে এ বিষয়গুলোকে একটি আন্দোলনের পর্যায়ে নিতে হবে। সততা থাকলে গণমাধ্যমের মালিকরা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আলী আজগর চৌধুরী এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোর জন্য বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন। আর বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই ব্যবসায়ী। আর ব্যবসায়ীরা তাদের স্বার্থে বা অন্য ব্যবসার সুরক্ষা ও সুবিধার জন্য গণমাধ্যমকেই বেছে নেয়। তাদের ব্যবসায়িক দরকারের জন্য গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছে। যার ফলে গণমাধ্যম জনগণ সম্পর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে দিন দিন এড়িয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে ভূমিকা রাখবে গণমাধ্যম কর্মীরা। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে দিন দিন গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীদের সুবিধা বাড়ছে না। এখানেই বোঝা যায় গণমাধ্যম কতটা ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন: গণমাধ্যম ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে। তবে এখনো মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোতে ভালো কাজ করার সুযোগ রয়েছে।এটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় মালিক পক্ষের সঙ্গে আমাদের সাংবাদিকদের আঁতাত করে চলতে দেখা যায়। আবার আমাদের সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো, ইউনিয়নগুলো বেশির ভাগ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনও কথা বলছেন না। আবার সাংবাদিক নেতাদের বাইরে গিয়ে গণমাধ্যম নিয়ে সাধারণ সাংবাদিকরা কোনও মন্তব্য বা উদ্যোগ নিতে পারে না। যার ফলে গণমাধ্যমগুলো বণিকগোষ্টীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, রিপোর্টাস উইথাউট বর্ডারস এর ২০১৯-এর প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম। যেখানে যুক্তরাজ্যর অবস্থান ৩৩তম।
বাংলাদেশের পুরো গণমাধ্যম বর্তমানে যে স্বাধীনতা ভোগ করে, সেটি ইউ কেতেও অতো স্বাধীনতা সবক্ষেত্রে সব সময় ভোগ করে না বলে জানিয়েছে তথ্যমন্ত্রী।
বাংলাদেশে গত ১০ বছরে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালে দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৭শ, এখন এই সংখ্যা প্রায় ১৩শ। টেলিভিশনের সংখ্যা অন-এয়ারে আছে ৩৪টি। লাইসেন্স দেয়া আছে ৪০টির।