২৬ আগস্ট। সকাল আটটা। বাবাকে খুঁজতে যাওয়া জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি, বিকাশ আর সঞ্জয়। ফোন বেজে উঠলো। টাঙ্গাইল থানার এসআই। বললেন, ঘাটাইলে আপনার বাবাকে পাওয়া গেছে। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন একটা এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে আসুন। লাইনটা কেটে গেল। বাবাকে পাওয়া গেছে- খুশির খবর। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্স কেন! আমি কল ব্যাক করলাম। তিনি দ্বিধা নিয়ে জানালেন, দেখুন, আপনি উনার ছেলে, আপন জন। আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার বাবা বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা পিকাপের সামনে পড়েন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এই মুহূর্তে যে সাপোর্ট দরকার তা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই। ডাক্তাররা বলছেন, ঢাকা নিয়ে যেতে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন।
আমার মাথা কাজ করছে না। কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগছে। বাবা ঘাটাইল গেলেন কীভাবে! অফিসের গাড়ি চালক শোয়েব ভাইকে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বাসায় আসতে বললাম। অফিস কলিগ শাহেদ ভাইকে সবকিছু জানিয়ে ঘাটাইল যাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে বললাম। পরিবারের সবাইকে মানসিকভাবে তৈরি হতে বললাম ভালো-খারাপ দুটোর জন্যই। আমাদের টাঙ্গাইল প্রতিনিধিকে সব জানিয়ে খোঁজ নিতে বললাম। সোহেল নামে এক ছোট ভাই একটি বেসরকারি চ্যানেলের প্রতিনিধি, তাকেও জরুরিভিত্তিতে বাবার খোঁজ-খবর নিতে বললাম। ওদের কাছে এসআইয়ের নাম্বারটা দিয়ে যোগাযোগ করতে বললাম। ওরা সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিল। অফিসের গাড়ি আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমরা একটা সিএনজি গ্যাস চালিত অটো নিয়ে শাহেদ ভাইয়ের খামার বাড়ি বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম।
আবার এসআইয়ের ফোন। এবার তিনি বললেন, দুটো ইনজেকশন লাগবে, দাম ষোল হাজার টাকা। এতো টাকা তার কাছে নেই। তাছাড়া তিনি একা রোগীকে সামলাতে পারছেন না। বিকাশ করে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বললেন। আমি বললাম, দশ মিনিটের ভেতর আমার লোক যাচ্ছে, প্লিজ, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি সোহেলকে আবার ফোন করলাম। ও বলল, পাঁচ মিনিটের ভেতর আমরা পৌঁছে যাব। একটু অপেক্ষা করুন। আবার এসআইয়ের ফোন, আপনি কি আপনার বাবাকে বাঁচতে দেবেন না? উনার ইনজেকশনের খুবই প্রয়োজন। আপনি টাকা পাঠান। লাইনটা কেটে দিলেন। আমি সোহেলকে আবার ফোন করলাম। ও বলল, দাদা ধৈর্য ধরুন, আমি পৌঁছে গেছি। আবার এসআইয়ের ফোন, সব শেষ। আমি বললাম, বাবা কি মারা গেছেন? উনি বললেন, এখানো বেঁচে আছে। তবে…। সোহেলকে ফোন করে বললাম, আমি এসআইয়ের মোবাইলে বিকাশে টাকা পাঠাচ্ছি। ও বলল, দাদা আপনি টাকা পাঠাবেন না। আমরা পুরো হাসপাতাল ঘুরে দেখেছি। এ ধরনের কোনো রুগী হাসপাতালে নেই। ঘাটাইলে গত দুদিনে এই ধরনের কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি।
বিষয়টি ডিসি ও টিএনওকে জানানো হয়েছে। পুলিশের কাছে নাম্বারটাও দেয়া হয়েছে। আপনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আমি এসআইয়ের নাম্বারে ফোন দিলাম। সুইচ অফ বলছে। এই দুঃসময়ে মানুষ এমন ফাঁদও পাততে পারে!
একটা রাত পার হয়ে গেছে। কোথায় আছেন বাবা? কি খাচ্ছেন, কোথায় থাকছেন? মাথায় দুশ্চিন্তার ঝড়। সারা জীবন ছকে বাঁধা নিয়মের ভেতর জীবনযাপন করেছেন। একবেলা ওষুধ খাওয়া বন্ধ করেননি কোনোদিন। নেশা জাতীয় দ্রব্য ছুঁয়েও দেখেননি। যোগ ব্যায়াম করেছেন। ঠিক সময় পরিমিত আহার করেছেন। ঘুমেও ছিল না কোনো অনিয়মের বালাই। ভোরবেলা উঠতেন, আমাদেরও ডেকে তুলতেন। বলতেন, ভোরবেলার হাওয়া লাখ টাকার দাওয়া’।
একটা দাঁতও খোয়া যায়নি তার। শরীরে বার্ধক্যের বিরক্তিকর কোনো ব্যথাও নেই। আমার জীবনাচরণের অনেক কিছুই বাবার কাছ থেকে পাওয়া। আজ আমি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠি। ঘুমোতেও যাই ঠিক সময়ে। কিন্তু বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর বাবার সঙ্গে আমারও জীবনাচরণের ছক সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। গত রাতে গাবতলি, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুরসহ অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। মূল রাস্তার ধারে, গলির ভেতর শুয়ে থাকা মানুষ টর্চ জ্বেলে দেখেছি। চলতি পথের দুধারের মানুষকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি। রাত দুটো পর্যন্ত চলেছে খোঁজাখুঁজি। না, আমরা কেউই কোনো খোঁজ আনতে পারিনি। শেষে ক্লান্তি আর অবসাদে অচল শরীরটাকে টেনে নিয়ে বাসায় ফিরেছি। সকাল আটটাতেই ভুয়া এসআইয়ের ফোন পেলাম। মানবতা আজ কোথায় নেমেছে ভাবতে বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠল।
খামার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। শায়েদ ভাই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সোয়েবও চলে এসেছে। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া বাবা নাটকের উপসংহার সবাইকে খুলে বললাম। একটু যেন ভারমুক্ত হলো তারা। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, হাসপাতালে গিয়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখব। তারপর কীভাবে খোঁজাখুঁজি চলবে তার পরিকল্পনা হবে। গাড়ি চলল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। বাবার বেডের কাছে যেতেই মা বললেন, একজন লোক এসেছিলেন, বলে গেছেন, পরিচালকের রুমে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ রেডি আছে। আমি দেরি না করে শাহেদ ভাই আর শোয়েবকে নিয়ে গেলাম পরিচালকের রুমে। পরিচালক নেই। ওখানে কর্তব্যরত ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ২৫ তারিখ সকালের ফুটেজ দেখাতে শুরু করলেন।
ফুটেজে দেখা গেল- বাবা ঠিক ছয়টার দিকে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে হাঁটা শুরু করলেন বারান্দা দিয়ে। এরপর তাকে দেখা গেল একেবারে হাসপাতালের সামনের বারান্দায় পায়চারি করতে। সিকিউরিটি গার্ডে সঙ্গে কথা বলতে। তারপর তিনি ভেতরে ঢুকলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার বারান্দায় এলেন। পায়চারি করতে করতে একসময় আর তাকে দেখা গেল না। ভেতরে ঢোকারও কোনো ফুটেজ নেই। তবে এটাও দেখা গেল না যে তিনি বাইরে বেরিয়ে গেছেন। হাসপাতালে ঢোকার মূল রাস্তা আর ডান পাশের রাস্তায় সিসি ক্যামেরায় কাভার করলেও বাঁপাশের রাস্তায় কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা জানার উপায় নেই। আমরা বাঁপাশের গেইট দিয়ে বাবা বেরিয়েছেন এমনটা ভেবে পরিচালকের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
যে ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলেন বাবা তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বাবা যে নিখোঁজ তিনি সেটাই জানেন না। ওই সময়ের কর্তব্যরত কোনো ডাক্তার সেটা জানানোর প্রয়োজনও মনে করেননি। ছবি থেকে তিনি বাবার ছবি তুলে জুনিয়র ডাক্তারদেরকে দিয়ে দিলেন। সবাইকে খোঁজ-খবর নিতে বললেন। আমাকে সান্ত্বনা দিলেন নানা ধরনের কথা বলে। জুনিয়র একজন ডাক্তারের কাছে শুনলেন, ওনাকে কি আমি দেখেছি? কেউ কোনো উত্তর দিলেন না। আসলে বড় ডাক্তাররা রুগীদের কাছে খুব কম যান। অন্তত বাবার চিকিৎসা করানোর সময় আমার চোখে সেটাই ধরা পড়েছে। খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা না হলে রুগীদের কাছে যান না। জুনিয়ররাই সামলে নেন। তবে রুগীর প্রয়োজনে সকল ডাক্তার এক হয়ে চিকিৎসা দেন কালেভদ্রে। আর সেটা পেয়ে থাকেন ভাগ্যবান রুগীরাই।
ডাক্তারের রুম থেকে বেরোতে একটা ফোন এল। সুইজারল্যান্ড থেকে। ভদ্রলোকের নাম ইমরাম। তিনি বললেন, অপনার এই দুঃসময় অনেক প্রতারক ফোন করতে পারে বাবার এক্সিডেন্টের কথা বলে। আপনাকে টাকা দিতে বলবে। সাবধান, এ ফাঁদে পা দেবেন না। এটা টাকা হাতানোর একটা কৌশল। আমি বললাম, ইতিমধ্যে এমন ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি আমি। তিনি আরো কিছু পরামর্শ দিয়ে লাইনটা কেটে দিলেন।
হাসপাতালের বাঁপাশ দিয়ে বেরোলেই রাস্তা। রাস্তার ওপাশে চার-পাঁচটা দোকান। সবাই মিলে একটা দোকানের পাশে দাঁড়ালাম। এখন আমাদের কী করণীয় হতে পারে তাই নিয়ে ভাবছি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন, এ হাসপাতাল থেকে প্রায়ই এমন রোগী হারিয়ে যায়। খোঁজাখুঁজি করে আর পাওয়া যায় না। ছয়মাস আগেও খুলনা থেকে নিয়ে আসা এক রুগী হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি চলেছে। আজ পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান মেলেনি। তারপর তিনি যা শোনালেন তা রীতিমত ভয়ের ব্যাপার।
মনটা আবার বিষাদে ভরে উঠল। তারপরও সবাই মিলে খোঁজাখুঁজির সিদ্ধান্তে অটল আমরা। একজন নিউমার্কেটের দিকে যাবে। একজন বিহারি ক্যাম্প হয়ে মোহাম্মদপুর। গিন্নি আর সোহেলী ঘুরবে হাসপাতালের আশপাশ দিয়ে। আমি গেলাম চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের দিকে। কথা হলো- কেউ কোনো খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের জানাতে। আমি যাওয়ার আগে গিন্নিকে বললাম, খোঁজা শেষ হলে হাসপাতালের পরিচালক বরাবর বাবা নিখোঁজ হওয়ার খবর জানিয়ে তদন্তের জন্য একটা আবেদন করতে। আর হাসপাতাল থেকে মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে। মা বাবা ছাড়া হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরতে নারাজ। মার বিশ্বাস- বাবা ফিরে আসবেনই।
দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে আমি চন্দ্রিমা উদ্যান, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে অবশেষে সন্ধ্যার দিকে বাণিজ্য মেলার মাঠে এসে কিছু তথ্য পেলাম। একজন চটপটিঅলা বাবার ছবি দেখে বললেন, হ্যাঁ, এই লোকটি দুদিন ধরে এখানে ঘুরছে। আমি তাকে দুটো আলু খেতে দিয়েছি। তবে পরনে উনার লুঙ্গি নেই। একটা কালো প্যান্ট। আমি ভাবলাম, হয়তো লুঙ্গিটা খুলে যাওয়ায় কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি বাবাকে একটা প্যান্ট পরিয়ে দিয়েছেন। খবরটা সবাইকে দিতেই তারা আধা ঘণ্টার ভেতর হাজির হলো। শুরু হলো আমাদের শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, আগারগাঁও, চন্দ্রিমা উদ্যান আর বাণিজ্য মেলার মাঠে চিরুনি অভিযান।
শেরেবাংলার কৃষি অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ঘটনাটা তাকে জানাতেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। পরামর্শ দিলেন, বাবার ছবি দিয়ে লিফলেট ছাপাতে এবং আশপাশের এলাকাগুলোতে মাইকিং করতে। আমি সন্মতি জানালাম। তিনি তখনই তার অফিস কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাদিম, ইদ্রিস আর অভিকে ডেকে আনলেন। কার কী দায়িত্ব নিতে হবে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। অডিও দেয়া, লিফলেট ছাপানো, মাইক-রিকশার ব্যবস্থা করতে ওরা চলে গেল। অন্ধকার রাতের পথ ধরে আমরাও বেরিয়ে এলাম। রাতের অন্ধকারে আমরা ঠিকই বাসা খুঁজে পাব, কিন্তু বাবা কি দিনের সূর্য হয়ে ফিরে আসবে আমাদের জীবনে?
(চলবে)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)