এক
আমাদের বসুবাজার লেনের চিপা গল্লিটা তিড়িং বিড়িং করে কান্নি আর গোত্তা খেতে খেতে শরতগুপ্ত রোডে গিয়ে ইঁদুর যেমন গর্ত থেকে মাথা বের করে ইতি উতি তাকায় সেরকম করে নিজের করে তাকিয়ে দয়াগঞ্জ আর নারিন্দা রোডের দিকে মুখ করে দুদিকে চলে গেছে।
আমরা ছোটরা সাধারণত ওদিকটায় খুব একটা যাই না। শরতগুপ্ত রোডের দিকে যাওয়ার ব্যাপারে বড়দের কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা সব সময় বড়দের সমীহ করার চেষ্টা করি। সব সময় সমীহ করা হয়ে ওঠে না।
মাঝে মধ্যে সময় সুযোগ পেলে আমরা বড়দের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলে যাই বড় রাস্তায়। শরতগুপ্ত রোড আমাদের কাছে ছিল সত্যি সত্যি বড় রাস্তা।
একদিন।
সেদিন ছিল মোরগের ঝুঁটির মতো ঝলমলে দুপুর।
রাস্তাঘাটে লোকজন নেই।
সেই দুপুরে আমরা শরতগুপ্ত রোডে দাঁড়িয়ে একজন অদ্ভুত রকমের মানুষকে দেখেছিলাম। মানুষটা নারিন্দা রোড থেকে কাঁধে দুপুরের রোদ নিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা আরও খেয়াল করলাম মানুষটার সঙ্গে আরও একজন হেঁটে হেঁটে আসছে।
কিন্তু কি আশ্চর্য!
লোকটার পাশে পাশে হেঁটে আসা সেই আরেকজন আমাদের দৃষ্টি কোনোভাবেই আকর্ষণ করতে পারছে না!
লোকটার পান খাওয়া লালচে মুখ। কাঁচাপাকা চুলে পই পই করে তেল দেয়ার ফলে তার মাথার চুলগুলো ঝিলিক মেরে দুপুরের রোদকে আরও ধারাল করে ধাঁধিয়ে দিচ্ছে যেন।
লোকটা বেশ ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে দ্রুত হাঁটছে। হাঁটার সময় তার চুল ‘পাইন্যা’ সাপের মতো মাথার দুপাশে দোল খেয়ে উপচে পড়ছে।
সাদা লুঙ্গি, গায়ে একই রঙের ঢিলেঢালা রকমের বেপারী শার্ট। লুঙ্গিটাও কি ইস্ত্রি করা কড়কড়ে শার্টের মতো! হাতের কব্জিতে মোটা চেইনের বড় ডায়ালের সোনালী ঘড়ি চকচক করছে।
আমরা তাকে দেখছিলাম। দুপুরের খাঁখাঁ নির্জন রাস্তায় আমাদের পোলাপানের দলকে অমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি খুব একটা অবাক হলেন না। লোকটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঝুঁকে পড়ে ভালো করে পরখ করে আমাদের দেখলেন।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পরখ করলেন তিনি।
তারপর গমগম কণ্ঠে তিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে বললেন,
‘ আরে, মনছুইরা, দেখছছ নি পিচ্চিগুলার চখ্যের ভিতর কিমুন কইরা আলো খেলবার লাগছে!’
লোকটার কথায় আমি বুঝে উঠতে পারি না আলো আবার কিভাবে খেলবার লাগছে!
কথাগুলো বলে তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন। তাঁর হাসির শব্দের সঙ্গে পুরো এলাকা এক অসাধারন কড়া জর্দার গন্ধে ডুবে গেল।
সেই গন্ধে দুপুর রোদে আমাদের মাথা যত না ঝিম ঝিম করছিল তার চেয়ে বেশি ঝিম ঝিম করে উঠল জর্দার গন্ধে।
লোকটা মনছুরের কাঁধে হাত রেখে ধীরে ধীরে ( নাকি টলতে টলতে!…) শরতগুপ রোডের উল্টোদিকের কোম্পানিগঞ্জের সরু গলির ভেতরে চলে যেতে থাকলেন।
ধীরে ধীরে আমাদের থেকে দূরবর্তী হতে থাকা লোকটাকে আমরা অবাক নয়নে দেখতে থাকলাম। তিনি এক জাদুমাখা গন্ধের সাগরে আমাদের নিমজ্জিত করে দিয়ে চলে গেলেন।
দুই
কত দিন, কত মাস, কত বছর অতিক্রান্ত হলো!
এখনো চোখ বন্ধ করলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মোরগের ঝুঁটিঅলা ঝাঁঝাঁল দুপুর।
সেই দুপুরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলছেন, ‘আমার চোখে নাকি আলো খেলবার লাগছে!’
২ এপ্রিল, ২০১৯