বলতে ইচ্ছে করছে, কেন তিনি যাবেন? তিনি কেন যাবেন? সবসময় সতেজ, প্রাণবন্ত, হাস্যজ্জল মানুষটির এটি কোনো যাবার সময় হলো! এই তো সেদিন, প্রণব দা চলে গেলেন। আলমগীর ভাই হতবিহ্বল, তারপরও অদ্ভুত প্রাণশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, বড় অসময়ে চলে গেল প্রণব! আহা, শাহ আলমগীর ভাইয়ের হাতে এখনও অনেক কাজ, অনেক করণীয় বাংলাদেশের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার জন্য! এসব ফেলেই তিনি চলে গেলেন? ইচ্ছে ও প্রতিবেশের বিরুদ্ধে হয়তো এভাবেই চলতি পথে প্রকৃতি ফেলে দেয় শেষ বৃক্ষের গুড়ি। পথচলা থেমে যায় অতঃপর।
চ্যানেল আই সংবাদের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও প্রতিষ্ঠাতা শাহ্ আলমগীর। তার দুই হাত ছিলেন সাইফুল আমীন ও প্রণব সাহা। প্রণব সাহা তার দীর্ঘকালের সহকর্মী। আর সাইফুল ভাই চেতনা ও কর্তব্যে তার খুব কাছাকাছি একজন। প্রণব দা চলে গেছেন মাত্র নয় মাস আগে। সাইফুল ভাই জীবনের প্রয়োজনে সুদূর প্রবাসে পার করছেন অসুস্থতার কঠিন সময়। আর শাহ আলমগীর ফেসবুক বন্ধুদের ব্যাকুল স্ট্যাটাস আর প্রার্থনাকে তুড়ি মেরে দিয়ে চলে গেলেন, আমাদের ছেড়ে। চ্যানেল আই এর দুই প্রাণপুরুষ ফরিদুর রেজা সাগর আর শাইখ সিরাজের কাছাকাছি বয়সের, কিন্তু অনুজতুল্য ছিলেন শাহ আলমগীর। তারা নাম ধরে ডাকতেন। আলমগীর ভাই, তাদের ভাই বলতেন। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক ত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের। চ্যানেল আই সংবাদের শুরুর দিকে পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ আলমগীর ভাই এর হাতে বুঝিয়ে দেন সংবাদ পরিচালনার চাবি।
আমি আজকাল দুয়েকবার ফেসবুক দেখি, আবার দেখিও না। আলমগীর ভাই অসুস্থ কদিন ধরেই চোখে পড়ছে। অনেক সাংবাদিকই তার অসুস্থতা ফেসবুকে হালনাগাদ করছিলেন। খুব খারাপ লাগছিল। চাইলেও ছুটে গিয়ে দেখে আসতে পারছি না। মন খারাপ করে বেশিক্ষণ থাকতেও পারি না। শরীরে প্রভাব পড়ে যায়। মনে হয়, চলে যাবার সময় কীভাবে কীভাবে যেন এগিয়ে আসছে। আমরা জীবনের কোনটুকু গুছিয়ে নেব, আর কোনটুকু কেটে ছেটে, ঝাড়ু দিয়ে, ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেব তা কে এসে শিখিয়ে দেবে?
আলমগীর ভাই আমাদের শিখিয়েছিলেন অনেক কিছু। আমরা অবশ্য তা শিখতে পারিনি পুরোপুরি। তিনি যেটি পারতেন, তা অনেক সাংবাদিকই পারেন না। তিনি উত্তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। বহুদিন তার কাছাকাছি দায়িত্বে, দায়িত্বহীনতায় নিয়োজিত থেকে দেখেছি, আমাদের কাছে যা সমুদ্রের মতো সীমাহীন, তার কাছে তা একেবারেই আয়ত্বের মধ্যেকার জিনিস। খুব জানেন এমন ভঙ্গিমা তার ছিল না। সবসময় থাকতেন বিনীতদের দলে। অথচ ভেতরের আগুন ঢেলে তিনি যে কতটা দুর্বিনীত হতে পারতেন, তাও আমরা দেখেছি। সারাটি জীবন তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনা ধারণ করেছেন আর নিরবে ও সরবে করে গেছেন শিশু সংগঠন ‘চাঁদের হাট’। কখনোই নেতার হম্বিতম্বি না প্রদর্শন করেও তিনি পেশাদার সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এমন একজন প্রথিতযশা, প্রজ্ঞাবান ও আধুনিক সাংবাদিককে সরকার যখন প্রেস ইনস্টিউট অব বাংলাদেশ পিআইবি মহাপরিচালকের দায়িত্ব দিলেন, তখন ওই চেয়ারটি যেন দীর্ঘকাল পর প্রাণ পেল। আমাদের কাছে অসংলগ্ন মনে হয়েছে। সরকারি চেয়ারে এমন একজন জাত সাংবাদিক! তারপর আবার তিনি ভাঙেনও না, মচকানও না। মানে তিনি তিনিই আছেন, কিন্তু কাজ করে চলেছেন সরকারের প্রেস ইনস্টিটিউটের। গুছিয়ে চলেছেন সারাদেশের সাংবাদিকদের পেশাগত জীবন। এ এক কঠিন কাজ। তারপরও তিনি হাত দিয়েছিলেন। তার অব্যর্থ হাতে অনেক কিছুই গুছিয়ে উঠেছিল। এই জায়গাতে তার সাফল্য শুধু সাংবাদিক বা সংশ্লিষ্টদের চোখেই ধরা দেয়নি, বারবার ধরা দিয়েছে সরকারের কাছেও তাই, দুইবার তার দায়িত্ব পূর্ণমেয়াদে বাড়িতে দেয়া হয়েছে। তিনি পিআইবিতে বিশাল বিস্তৃত এক সংসার মেলে নিয়েছিলেন। একদিন অফিস বেলায় গিয়েছিলাম আলমগীর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। একদিনই গিয়েছিলাম। দেখলাম কত শত কাজ তার হাতে। আমাকে একগাট্টি বই ধরিয়ে দিলেন। বিষয়ভিত্তিক সাংবাদিকতা নিয়ে প্রণীত সরু সরু বই। আরো অনেক কাজের কথা বললেন। শুনে আশা জাগলো। সরকারি ইন্সটিটিউটগুলোর মধ্যে পিআইবিকে এক আলাদা মাত্রায় নিয়ে গেছেন তিনি। সেখানে দেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক নিয়ে ভাববার অনেক নতুন খোরাক তৈরি হয়েছে। সুগভীর চিন্তক আর সৃজনশীল মানুষই পারেন পরিবর্তনের এমন জ্বলন্ত নজির গড়তে।
আমি যেন লিখছি না। আলমগীর ভাইয়ের খবরটি শুনে কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে কাছের দুয়েকজন মানুষের কাছে কিছু কথা বলে চলেছি। মনে পড়ছে, চ্যানেল আই এর হৃদয়ে মাটি ও মানুষের দ্বিতীয় শুটিংয়ে জনাব শাইখ সিরাজ প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহ আলমগীরকে সঙ্গে নেন। আমরা যাই সিরাজগঞ্জের এক গহীন চরাঞ্চলে। শীতকাল হলেও চরের তপ্ত বালুর ভেতর দিয়ে হাঁটতে আলমগীর ভাই, অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেন। মনে আছে, শাইখ সিরাজ বলছিলেন, আলমগীর এই জন্যেই তোমাকে এতদূর এনেছি। যাতে, বুঝতে পারো, আমাদের কৃষক ভাইয়েরা কত কষ্ট করে ফসল ফলায়!
আলমগীর ভাই, আমাদের যে সাংবাদিকতা বিদায় নিয়েছে সেই সাংবাদিকতা যুগকে লালন করেছেন।নিষ্ঠার সাংবাদিকতা। মগ্ন থাকার সংবাদিকতা। নির্মোহ এক চেতনা ধারণ করার সাংবাদিকতা। আমি দেখেছি তিনি গভীর রাত অবধি সংবাদ কক্ষে থাকতে পছন্দ করতেন। রাত গভীর হতো আর তার মগ্নতা বাড়তো। যোগাযোগ, পরের দিনের কাজ সবই করতেন। প্রশান্ত মন নিয়ে রাতের গভীরতা উপভোগ করতেন। সবাই চলে গেলে রাতের শিফটের রিপোর্টার, ভিডিও এডিটর, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারি মোস্তফা ভাই ঘুম থেকে জেগে দেখতেন আলমগীর ভাই কিছু করছেন। চ্যানেল আই এর সিদ্ধেশ্বরী অফিসে আলমগীর ভাইয়ের কক্ষটি ছিল সদর দরজা থেকে মুখোমুখি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই দেখা যেত তিনি কক্ষে আছেন। আমরা কালেভদ্রে অনেক রাতে সুনসান নিউজ রুমে তাকে দেখে হকচকিয়ে যেতাম।
অবশ্য তিনি ছিলেন আরেক সহজ মানুষ। সবসময় হয়ে উঠতেন আমাদের সাহস। সেসময়ের সংবাদ কক্ষের সাইফুল আমীন, প্রণব সাহা, জুলফিকার আলী মাণিক, মামুনুর রহমান খান, মাহবুব মতিন, রুহুল আমীন রুশদ, সন্তোষ মন্ডল, শারমীন রিনভী, আরেফীন ফয়সল, শাকিলা জেসমিন, রহমান মুস্তাফিজ, এহসান মোহাম্মদ, আশরাফুল আলম খোকন, ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক এর হাসান জাকির, হাফসা হোসাইনসহ সবাই গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন একই অভিযানে। আলমগীর ভাই পরিবারটিকে সংবাদমাধ্যমের আদি রঙে রাঙিয়ে রাখতেন। বলতে চাই, সেসময় সংবাদ বিভাগের প্রধান ভিডিও এডিটর আফতাব খোকনের কথাও। রাত নেই দিন নেই, সমস্যা হলেই তিনি হাজির। কারণ আলমগীর ভাই ডেকেছেন। আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে হাস্যরসের সম্পর্কও ছিল। কাজের জন্যেই এই হাস্যরস। আমরাও কখনো কখনো হাস্যরসে যুক্ত হতে পারতাম। সেই প্রবেশাধিকার তিনি দিয়ে রাখতেন।আহা মাহবুব মতিন, আফতাব খোকন, সন্তোষ মন্ডল, প্রণব দা চলে গেছেন অকালে, চলে গেলেন আলমগীর ভাইও। ওপারের দলটিই যেন মজবুত হচ্ছে এপারে শূন্যতা ছড়িয়ে। চ্যানেল আই সংবাদ কক্ষে দিব্যি দেখা যাচ্ছে এই শূন্যতা।
চ্যানেল আইতে তখন আমার মাস কয়েক হয়েছে। একরাতে কোনো এক কাজে আলমগীর ভাই আমাকে ফোন দিয়েছেন। আমার মোবাইলে আলমগীর ভাইয়ের নাম্বার ছিল না। আমি ফোন ধরে বলছি, কে? অপরপ্রান্ত থেকে কিছুটা আস্তে শুনলাম আলমগীর। আমি ধরে নিলাম আমার এক বাল্যবন্ধু ‘আলমগীর’। কোনো কথা না শুনে ঝড়ের মতো বন্ধুর পিণ্ডি চটকাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর অপরপ্রান্ত থেকে শুধু শুনলাম, আদিত্য, আমি শাহ্ আলমগীর। আমি জবাবহীন। লজ্জা আর বিড়ম্বনায় ফোন কেটে থ মেরে থাকলাম কিছুক্ষণ। পরে ফোন করে আলমগীর ভাইকে বারবার সরি বললাম। তিনি একেবারেই স্বাভাবিক করে নিলেন ব্যাপারটা। বললেন হতেই পারে, এটা তেমন কিছু না।
আলমগীর ভাই আমাদেরও বন্ধু হয়ে যেতে পারতেন যখন তখন। একবার চ্যানেল আই এর পুরানো ভবনের সংবাদ কক্ষের ভেতরের ছোট্ট খাবার ঘরে আমরা কয়েকজন শ্লীল, অশ্লীল মিলিয়ে গল্প করে যাচ্ছি। অনেকটা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। গল্পের একেবারে চূড়ান্ত জায়গায় এসে সবাই যখন হেসে ফেটে পড়ছি, তখন পেছনে তাকিয়ে দেখি আলমগীর ভাইও হাসিতে অংশ নিয়েছেন। তার মানে আমাদের গপসপ তিনিও শুনেছেন। আমরা কিছুটা জড়োসড় হলাম, পেলাম কিছুটা স্পর্ধাও।
আলমগীর ভাইকে আমি প্রথম দেখি কারওয়ান বাজারের স্টার কাবাবের দোতলায়। ২০০১ সালে। তখন ইউএনবি বাংলা সার্ভিসের বার্তা সম্পাদক জহুরুল ইসলাম টুকু। আমি টুকু ভাইয়ের পত্রিকা খোলাকাগজ এর বার্তা সম্পাদক। আলমগীর ভাই আমাদের আমন্ত্রণে এসেছেন। তখন চ্যানেল আই সংবাদ শুরু হয়েছে। আলমগীর ভাই তুমুল ব্যস্ত। এর মধ্যেই কথা প্রসঙ্গে প্রশংসা করলেন, প্রধান প্রতিবেদক সাইফুল আমীনের। বললেন, টেলিভিশনে কাজ করলেও সাইফুলের মধ্যে টেলিভিশনের পর্দার মোহ মোটেই নেই। তাই নেপথ্যের কাজগুলো ভালোভাবে গুছিয়ে ওঠা যায়। আলমগীর ভাইও তেমনটিই ছিলেন। চ্যানেল আই এর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে একবারমাত্র কিছুদিনের জন্য একটি টক শো উপস্থাপনা করেছিলেন। তাও সেটি তিনি খুব বেশি উপভোগ করতেন বলে মনে হয়নি কখনো।
আলমগীর ভাই চলেই গেলেন! কেন জানি, বিশ্বাস করে ওঠা যাচ্ছে না। মৃত্যুটা এমনই। চলে যাওয়া মানুষগুলো আরো বেশি আপন হয়ে যায়। আর চলে যাওয়া মানুষের সঙ্গে আমরাও কিছুটা চলে যাই। একইভাবে তিনিও অনেকটা থেকে যান আমাদের মাঝে। বাংলাদেশে পেশাদার সাংবাদিকতার ইতিহাসে শাহ্ আলমগীর এক উজ্জ্বল নাম হয়ে থাকবেন। সেই সঙ্গে একথাও আসবে বাংলাদেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতার কর্মী, সংগঠক বা কারিগর হিসেবে তাদের পথচলাটা একেবারে গোড়ার দিকে। তারপর তো এই উঠোন অনেক বড় হয়েছে। বিশাল বিস্তৃতি পেয়েছে টেলিভিশন মাধ্যম। কিন্তু যে যেখানেই বড় হোক শাহ আলমগীরের মতো মানুষের কর্ম আর সংগ্রামও যে পাটাতন তৈরি হয়েছে, সেটিকে ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)