চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল: ইতিহাস থেকে উন্মাদনা

গত ক’দিনের উন্মাদনা দেখে নিছক কৌতুহলের বশেই ঢুঁ মারি গুগল ম্যাপসে। বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের রুট খুঁজে না পেয়ে দুঃখপ্রকাশ করে সে। পরে গুগল ম্যাপসের পিতা গুগলের কাছেই যেতে হয়। জবাব মেলে ঢাকা থেকে আর্জেন্টিনা ১৭ হাজার ৬৩ কিলোমিটার আর ব্রাজিল ১৫ হাজার ৯ শত ১৯ কিলোমিটার।

কী এমন টান? যার কারণে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের দুটি দেশ আবেশে জড়িয়ে রেখেছে বাংলাদেশের দেশের সর্বস্তরের মানুষকে। ধর্ম? রাজনীতি? শিক্ষা? কিংবা সংস্কৃতি? এগুলোতে উত্তর না খুঁজে নজর দিন মাঠে। ফুটবলের মাঠে। সাথে সাথেই মিলবে জবাব। এই ফুটবলই, আরও পিন পয়েন্টে বললে বিশ্বকাপ ফুটবলই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সাথে বেঁধে রেখেছে এ দেশের মানুষের মন। তবে, ফুটবলের এই আবেগ খানিকটা সিজনাল বললে ভুল হবে না। ৪ বছর পর পর লিপ ইয়ারের ২৯শে ফেব্রুয়ারির মতো আসে। বিশ্বকাপের জোয়ার। শেষ হলেই ভাটা। লক্ষ্য করবেন ভাটা শব্দটা। খরা কিন্তু বলি নি।। কারণ, মনের মাঝে সমর্থনের রেশ রয়ে যায় ঠিকই।

আজ তাই গল্পটা দেশের ভিনদেশী সমর্থনের। বিশেষত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সমর্থন দ্বৈরথ নিয়ে।

তবে এ বিষয়ে কাটাছেঁড়া করতে হলে তিনটি বিষয়ে আলাপ দরকার। পেছনের ইতিহাস, বর্তমান উন্মাদনা আর লেখকের নিরপেক্ষতা।

শেষেরটা দিয়ে শুরু করি। আমি ফুটবল বিশ্বকাপে ইতালির সমর্থক। এবারের বিশ্বকাপে ইতালির অনুপস্থিতি আমাকে আরও নিরপেক্ষ করে দিয়েছে। তাই, নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন লেখার শেষ পর্যন্ত। তবে, বিপদটা আমার। সতর্ক থাকতেই হচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপে।

এবার ফুটবলের মজার জগতে আনবো খটমটে ইতিহাস। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এই দ্বৈরথের শুরুটা কোথায়? উত্তর হয়তো অনেকেই জানেন। যারা জানেন না, তাদের বোধ করি স্বস্তি মিলবে। জেনে-বুঝে এগোনোই তো বুদ্ধিমানের কাজ!

আর্জেন্টিনার পতাকার রঙে, ‘ম্যারাডোনা’ লেখা নকল কফিন হাতে ব্রাজিলের সমর্থক
আর্জেন্টিনার পতাকার রঙে, ‘ম্যারাডোনা’ লেখা নকল কফিন হাতে ব্রাজিলের সমর্থক

ইতিহাসে সর্বপ্রথম আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল মুখোমুখি হয় ১৯১৪ সালে। আর্জেন্টিনার ঘরের মাঠে। সেবার ৩-০ গোলের জয়ে শুরুর হাসি হেসেছিল আর্জেন্টিনা। সেই সাথে সর্বশেষ দেখায়ও ব্রাজিলের মাঠে ১-০ গোলের জয় আর্জেন্টাইনদের। মজার ব্যাপার শুনবেন? চিরশত্রুদের মধ্যকার এ দুটো ম্যাচই ছিল “ফ্রেন্ডলি”! শুরু আর সারার গল্পে আর্জেন্টিনা এগিয়ে থাকলেও ভেতরের ম্যাচগুলোর পরিসংখ্যানে ব্রাজিলের জয়জয়কার। দ্বৈরথে সবচেয়ে বেশিবার জিতেছে ব্রাজিল। ৪৪ বার। সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়ও ব্রাজিলের। ৬-২।

এবার আসি প্রতিবেশী দুই দেশের দা-কুমড়ো সম্পর্কের শুরুটা নিয়ে। শুরুটা ঠিক কত সালে তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও মাঠের “কু” সম্পর্কের বেশ কিছু শক্ত নজির তো দেয়া যাবেই। ১৯৩৭ সালে আর্জেন্টাইন এক সমর্থক বর্ণবাদী বাণ ছোড়েন ব্রাজিলিয়ানদের উদ্দেশ্যে। এ নিয়ে হই-হট্টগোলের মাঝেই গোলশূন্য ড্র হয় ম্যাচটা। বিপত্তিটা বাধে এক্সট্রা টাইমে। আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে যাবার পর একটি গোল বিতর্কিত দাবি করে মাঠ ছাড়ে ব্রাজিল দল। তাও আবার শেষ বাঁশি বাজার আগে।

১৯৩৯ সালে পুলিশ প্রহরায় মাঠ ছাড়ে আর্জেন্টাইন দল। কারণটা, ব্রাজিলকে দেয়া একটা পেনাল্টি নিয়ে বিতর্ক এবং শেষমেশ আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক ছাড়াই পেনাল্টি থেকে ফাঁকা জালে গোল করে ব্রাজিল।

আর ১৯৪৫ সালে তো আরও উচ্চমার্গীয় ব্যাপার। কথিত আছে, ইচ্ছে করেই নাকি ব্রাজিলের ফুটবলার পা ভেঙ্গে দেন বিপক্ষের আর্জেন্টাইন এক ফুটবলারের।

এ তো গেল মাঠের রেশারেশি। চলুন মাঠ থেকে বেরিয়ে এবার যাই সাইডলাইনে। একটা ঘটনাই বলবো। “হোলি ওয়াটার স্ক্যান্ডাল”। ম্যারাডোনা ফাঁস করেন এক টিভি সাক্ষাৎকারে। কোনো এক ম্যাচে আর্জেন্টাইন ট্রেনিং স্টাফরা নাকি ব্রাজিলের এক ফুটবলারকে ঘুমের ওষুধ মেশানো পানির বোতল দিয়েছিলেন! যদিও আর্জেন্টাইন ফুটবল সংস্থা তা অস্বীকার করেছিল।

আর্জেন্টিনার এক ম্যাগাজিনের আয়োজনে ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও পেলের সাক্ষাৎ, এপ্রিল ১৯৭৯
আর্জেন্টিনার এক ম্যাগাজিনের আয়োজনে ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও পেলের সাক্ষাৎ, এপ্রিল ১৯৭৯

ফুটবলে রেশারেশি থাকবে আর লাল কার্ড থাকবে না! ১৯৯১ সালে কোপা আমেরিকায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার এক ম্যাচে দেয়া হয়েছিল পাঁচ লাল কার্ড।

এবার চলুন ফুটবল জগতের বাইরে ঘুরে আসি। সেখানেও দেখা মিলবে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল শত্রুতার। ১৮২৫ সালে সিসপ্ল্যাটাইন যুদ্ধ। এর অন্য নাম আর্জেন্টাইন-ব্রাজিলিয়ান যুদ্ধ। ২ বছর ৮ মাস ধরে চলা এ যুদ্ধ শেষ হয় এক চুক্তির মাধ্যমে। সে সময়, আর্জেন্টিনাকে বলা হতো “রিও-ডে-লা-প্লাটা” (উরুগুয়ের কিছু অংশ সম্পৃক্ত ছিল) আর ব্রাজিলকে বলা হতো “এম্পায়ার অব ব্রাজিল”। ইতিহাসের এ যুদ্ধের স্মৃতি হয়তো নতুন রসদ জোগাতে পারে মাঠের বৈরি সম্পর্কে। এ জন্য যুদ্ধের ফল নিয়ে আর কিছু লিখবো না। কষ্ট করে গুগল করে জেনে নিতে পারেন।

কিছু নাম, কিছু কিংবদন্তী জড়িয়ে আছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের এই ফুটবল আবহে। পেলে, রিভেলিনিও, কাফু, রোনালদিনিও, রোনালদো, জিকো থেকে নেইমার…এই তো ব্রাজিল। আর মুদ্রার ওপিঠে? ম্যারাডোনা, ফিওল, জানেত্তি, কেম্পেস, মোরেনো, বাতিস্তুতা, ডি স্টেফানো থেকে মেসি…এই হল আর্জেন্টিনা। হয়ত এর থেকেও বেশি কিছু।

১৯৮২ বিশ্বকাপ- (ব্রাজিল ৩ আর্জেন্টিনা ১) আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোলমুখে ফ্যালকাও এর শট
১৯৮২ বিশ্বকাপ- (ব্রাজিল ৩ আর্জেন্টিনা ১) আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোলমুখে ফ্যালকাও এর শট

এবার সোজা চলে আসবো বাংলাদেশে। ক্রিকেট যে দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়ামোদীদের আকর্ষণের জায়গা, যে দেশ ফিফার বিচারে ১৯৭তম, সে দেশে এ উন্মাদনা আসে কোত্থেকে!

এই তো নতুন শব্দ বলেই ভুল করলাম। উন্মাদনা। কি দেখে বুঝবেন এই উন্মাদনা? সহজ। খবরের কাগজ, টিভির পর্দা, বাড়ির ছাদের পতাকা, গায়ে জার্সি, টিভি কেনার ঢল, ফেসবুকে উত্তাপ….দম ফেলার সুযোগও পাবেন না পুরো তালিকা তুলে ধরলে।

বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল উন্মাদনা কবে এল এ প্রসঙ্গের সদুত্তর আমার কাছ থেকে অন্তত পাবেন না। কারণ, আমার জন্মের বহু আগেই শুরু হয়েছে এ পর্ব। তবে বোধ-বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখছি এ সমর্থনের জোয়ার। আমি পেলেকে কিংবা ম্যারাডোনাকে দেখি নি। তবে দেখেছি কিভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়েছে তাদের কীর্তির সুবাস। ফিনিক্সের মতো জন্ম নিয়েছে নতুন কিংবদন্তী, যার সবশেষ সংস্করণ মেসি আর নেইমার।

ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা যাই সমর্থন করুন না কেন, বর্তমানে সমর্থন আর শুধুমাত্র সমর্থন পর্যায়ে নেই। তা পৌঁছে গেছে রীতিমতো যুদ্ধের পর্যায়ে। নিজে হারি-জিতি নাহি লাজ, তবে প্রতিপক্ষের হারের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায় সবকিছু। সোশ্যাল মিডিয়াও সরব এ যুদ্ধে। একটা এসএমএস খুব ভাইরাল হয়েছে। এবারের বিশ্বকাপ ব্রাজিল জিতবে। এমন জোক পেতে এসএমএস করুন এই নাম্বারে। আবার এর আর্জেন্টাইন ভার্সনও বেরিয়েছে একই সাথে। ব্রাজিলিয়ান ফ্যানরা বলছেন, মায়ের চেয়ে মেসির দরদ বেশি আবার কেউ বলছেন, আমি খেলা বুঝিনা হুদাই লাফাই এর ট্রান্সলেশন কি? উত্তর: I am a Brazilian supporter অথবা I am an Argentine supporter.

এবার শেষ করি। একটা বিষয় জানেন তো? ফুটবলের সৌন্দর্যে বা সমর্থনে কোথাও নেই কোনো সংঘাত। খেলোয়াড়রা তাদের মতোই খেলে যায়, দেশের জন্য, দশের জন্য। মূলত: যুদ্ধের আঁচ আর উত্তাপ ছড়ায় মাঠের বাইরে। গ্যালারি থেকে খবরের কাগজ, টিভি আর শেষতক সোশ্যাল মিডিয়া ঘুরে আপনার ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে।

চলুক উন্মাদনা। ভালবাসুন ফুটবল। একদিন হয়ত আমরাও…

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)