ছাত্র রাজনীতির নামে নির্মমতার শিকার হয়ে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রাণ হারিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা পুরান ঢাকার নিরপরাধ দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস। আজ বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো।
পার্থক্য: একটি ঘটেছিল প্রকাশ্যে, আরেকটি শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের ভেতর।
বিশ্বজিৎ হত্যা
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে নির্মমভাবে খুন হন বিশ্বজিৎ দাস। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।
ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকার খেসারত দিতে হয়েছিল বিশ্বজিৎকে।
মামলার বর্ণনা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুসারে, তৎকালীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির সমর্থনে ওই দিন সকাল নয়টার আগে ঢাকার জজকোর্ট এলাকা থেকে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীরা একটি মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে যান। এসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি কাজী নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আইনজীবীদের ধাওয়া করেন।
এর কয়েক মিনিট পর ভিক্টোরিয়া পার্ক সংলগ্ন একটি তেলের পাম্পের কাছে তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পাম্পের দিকে ধাওয়া দিয়ে আসতে থাকলে আতঙ্কিত পথচারী বিশ্বজিৎ দৌড়ে সেখানকার একটি ডেন্টাল ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিড়ের মধ্য থেকে হঠাৎ শোনা গেল ‘ওপরে, ওপরে’। এরপরই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে বিশ্বজিৎকে জাপটে ধরে এলোপাতাড়ি রড দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। একপর্যায়ে তাকে ধারালো চাপাতি দিয়ে ডান হাতের গোড়ায় গুরুতর জখম করা হয়।
আহত ও আটকে পড়া অবস্থা থেকে ছুটে দৌড় দিলেও রক্ষা মেলেনি বিশ্বজিতের। নিচে নামতেই আবার চারদিক থেকে রড-লাঠির বাড়ি পড়তে থাকে।
এসময় পথচারীদের কেউ কেউ বিশ্বজিৎকে পাশের ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করলে তাতেও বাধা দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। ওই সময় প্রাণ বাঁচাতে আবারও দৌড় দেন তিনি। দৌড়ে শাঁখারীবাজারের একটি গলিতে গিয়েই ঢলে পড়ে যান। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় এক রিকশাচালক রিকশায় করে বিশ্বজিৎকে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর মারা যান বিশ্বজিৎ।
পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ওই হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
ওই সময় বিএনপির দাবি ছিল, বিশ্বজিৎ বিএনপির একজন কর্মী। অথচ পরিবারের দাবি, শুধু বিশ্বজিৎ কেন, তার পরিবারের কেউই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
আবরার: আরেক বিশ্বজিৎ
ছাত্র রাজনীতিকে ব্যবহার করে একই রকমভাবে শুধু সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনা আবারও ঘটল বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। শিবিরকর্মী সন্দেহে রোববার রাত ৮টার দিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে।
শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয়তলা থেকে ওই শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আবরার ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন, ১০১১ নম্বর রুমে থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া।
আবরারের রুমমেট সৈকত বলেন: সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে রুম থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় আবরারকে। তারপর আর জানি না। রাত দুইটার সময় ওর লাশ পাওয়া যায় একতলা আর দুইতলার মাঝের স্থানে।
বুয়েটের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. মাসুক এলাহী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: রোববার রাত ৩টার দিকে ছাত্রদের মাধ্যমে খবর পেয়ে শেরেবাংলা হলের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার মাঝামাঝি জায়গায় ফাহাদকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। তখন তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
আবরারের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানান এই চিকিৎসকসহ চকবাজার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. দেলোয়ার হোসেন।
অন্যদিকে আবরার হত্যায় এ পর্যন্ত একাধিক ছাত্রলীগ নেতার নাম উঠে এসেছে। ছাত্রলীগ নেতারা গণমাধ্যমের কাছে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে যাদের নাম এসেছে তাদের মধ্যে আছেন বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, উপ দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা এবং সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু।
বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আবরারকে শিবিরকর্মী সন্দেহে রাত ৮টার দিকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নেয়া হয়। সেখানে তার মোবাইল ফোনে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার পরীক্ষা করে দেখেন তারা। ওই সময় ফেসবুকে বিতর্কিত কিছু পেইজে তার লাইক দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবরার কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন, যেখান থেকে তার শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেন বিটু।
বিটু জানান: আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুজতবা রাফিদ, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল এবং উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা।
জেরা করে শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পর চতুর্থ বর্ষের ভাইদের খবর দেয়া হয় বলে জানান বিটু। খবর পেয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার সেখানে যান।
‘একপর্যায়ে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। এরপর হয়তো ওরা মারধর করে থাকতে পারে। পরে রাত তিনটার দিকে শুনি আবরার মারা গেছে,’ বলেন বুয়েট ছাত্রলীগের এই সহ-সম্পাদক।
কিন্তু নিহত আবরারের মামাতো ভাই আবু তালহা বলেছেন: আবরারের বাবা বরাবরই আওয়ামী লীগের সমর্থন করেন। তবে আবরার শুধু শিবির নয়, কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত ছিলেন না।
আবরারের এই আত্মীয় জানান: ক্যাম্পাসে এসেও সবার সঙ্গে কথা বলে তিনি জেনেছেন আবরার কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
এ ঘটনায় হলের সিসিটিভি ফুটেজসহ ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়।
এছাড়া বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদসহ একাধিক নেতাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে।