চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আরও অনেক কথা সেদিন হতে পারতো যা হয়নি

কিংবদন্তী নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রয়াণে শোক ও শ্রদ্ধা…

কবি নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আজ সকালে আর ঘুম ভেঙে জেগে উঠেন নি! এই খবর এই বাংলাদেশে বসে যখন জানতে পারি এক গভীর কালচে বিষণ্নতা জেঁকে ধরে। বাংলাদেশযাত্রার সময়কালে তাঁকে দেখা, তাঁর সাথে কথা বলার মুহূর্তেরা স্মৃতিতে ভাসে। যেদিন তাঁকে সামনাসামনি দেখি আমার মন উছলে ওঠে অনেক কথার ভীড়ে।

আমি তাঁকে বলতে চাইছিলাম যে ‘চরাচর’ এর সেই লোকটা যে পাখি ছেড়ে দেয় সেরকম ঘোর মাথায় নিয়ে দিনের পর দিন কাঁটাবনের খাঁচার পাখিগুলো ছেড়ে দেওয়ার একটা মোহে কাটিয়ে দিয়েছি!

আমি বললাম ‘লালদরজা’ আর ‘কালপুরুষ’ এর কথা… সেই ‘কালপুরুষ’, বাবার পিঠে শিশুরা পৃথিবী আঁকে! অথচ মধ্যবিত্ত পুরুষের অবদমনের গল্প এইভাবে আর কোথায়, বাঙালি পুরুষ নির্মাতার কাজে!

তিনি হাসলেন, মাথায় হাত রাখলেন, কথা বললেন। আর আমার মনে হল, আহ্‌ এই দিনগুলো জ়ীবনে জমে থাকে বলেই আরও অনেকগুলো দিন এমন জীবনের সাধ জাগে আমাদের! আজ তাঁর প্রয়াণের দিনে তিনি তো জেগেই থাকেন ইমেজে, কবিতায়, তাঁর কথাতে।

ক্যামেরা চোখে বুদ্ধদেব…

আমার জানার খুব ইচ্ছে ছিল বোঝাপড়ার জায়গাটা কেমন তাঁর কবিতায় আর সিনেমা? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, বলেছিলেন – ‘ সিনেমা সিনেমাই থাকে, কবিতা কবিতাই। শুধু আমি কেন, অনেকেই সেটা অনুভব করেন। সিনেমার জন্য কবিতা, পেইন্টিং এবং মিউজিকের অদ্ভুত সম্পর্ক আছে। আমার কবিতা বাদ দিয়ে সিনেমা নয়, সুর বাদ দিয়ে সিনেমা নয় বা শব্দ বাদ দিয়ে সিনেমা নয়। কোনো মাধ্যম থেকে কোনো মাধ্যমেই আমি যাইনি।’

শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল তারকোভস্কি-র চলচ্চিত্রের কথা । এ নিয়ে কী ভাবেন তিনি?? বলছিলেন – ‘তারকোভস্কি সারাটি জীবন ধরে এ কাজটি করে গেছেন। সময়কে নির্মাণ করা বড় সহজ কাজ নয়। কবি সেটা পারেন, পেইন্টার সেটা পারেন, একজন মিউজিশিয়ান সেটা পারেন, একজন ফিল্মমেকারও সেটা পারেন। ফিল্মমেকার আরও যেটা পারেন, এই সবগুলোকে একসঙ্গে মিলিয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করতে পারেন। সময় এমন একটা জিনিস যেটা আজ রেলেভেন্ট হলেও কাল আর রেলেভেন্ট না। কিন্তু সেভাবেই সিনেমা করলে, সেভাবে ছবি আঁকলে, সেভাবে কবিতা লিখতে পারলে সময়কে পেরিয়ে যাওয়া যায়। নতুন সময় তৈরি করা যায়। সে জন্য জীবনানন্দ দাশের লেখা কবেকার লেখা। আমি কয়েকদিন নাটোরে ছিলাম, আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। কবে পড়েছি জীবনানন্দ দাশ, নাটোরের বনলতা সেন। মানে কী, কত বছর আগেকার লেখা, কিন্তু সময়কে উনি এমনভাবে গেঁথে দিয়েছিলেন সেই কবিতায়, যে আমার কাছে এমনকি আরও অনেকের কাছে তা আজও বাঙময়।’

আমাদের কথায় তখন উঠে আসছে তখন জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ইমেজ, চিত্রকল্প আর ‘চরাচর’ চলচ্চিত্রের সেই পুরুষ, যে পাখি ছেড়ে দেয় বারবার খাঁচা থেকে। আমি বলে যাচ্ছি- ‘চরাচর’, ‘বাঘবাহাদুর’ চলচ্চিত্রগুলো প্রকৃতি, স্বপ্ন, জীবনের ইমেজ ধারণ করে। আর তিনি বলছেন – ‘ইমেজ তো শুধু নয়, প্রথমে ভাবনা ভিত্তিক বিষয়। তারপর আসছি ইমেজে। আজ দুধরনের ইমেজের প্রধান্য আমরা দেখতে পাই।বহু ব্যবহৃত ইমেজ। যেগুলো মানুষ সিনেমায় দেখছে। প্রেডিক্টেবল ইমেজ। আবার কিছু কিছু ইমেজ আছে, যা একদম নতুন। একদম অদ্ভুতভাবে নতুন। কেন নতুন ? সেগুলো হৃদয় থেকে অনুভব করতে হবে। সেগুলো কোনো কিছু দেখে তৈরি হয়নি, কোনো কিছু অনুকরণ করে তৈরি হয়নি। ‘চরাচর’ এ আপনারা যা দেখেছেন, এর সবটাই অনুভূত। যদি ইমেজের মধ্যে আপনি অন্য মাত্রা যোগ করতে না পারেন তাহলে পুরনোই থেকে যাবে। আমি মনে করি যে খুব বেশি বাস্তব ভিত্তিক ইমেজ আমি ব্যবহার করি না। আপনি দেখেছেন ‘চরাচরে’র শেষ দৃশ্য, যেখানে ওর সারা জীবনের যে স্বপ্ন পাখির মতো ওড়া, সেটা ও শেষপর্যন্ত পারে। বা সেটা হয়ত পারে, হয়ত পারেনা। কিন্তু আমরা দেখতে পাই উড়ছে। এই ইমেজগুলো কিন্তু কোথাও লেখা নাই।’

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কিছু সিনেমার পোস্টার

‘প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে। এগুলো কারোটা দেখেই তৈরি করা নয়। এটা সম্পূর্ণই হৃদয়জাত। সেটা করতে গেলে নিজেকে ভাঙতে হয় বারবার। নিজেকে আগুনে পোড়াতেও হয়। তারপর দৃশ্যগুলো জন্মায়। আর একটা জিনিস মনে রাখবেন, যে বিষয় যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার সঙ্গে সমমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক, ভঙ্গি। যেটাকে স্টাইল বলা হচ্ছে। আমার একটি নিজস্ব সিগনেচার আছে , অনেকেই বলেন ছবি দেখলেই বোঝা যায়, এটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি, নাম না থাকলেও। এটা কিন্তু স্টাইল। স্টাইলটা অর্জন করতে হয়। এ ভঙ্গি কিন্তু খুব দরকার। কী ভঙ্গিতে আপনি কথা বলবেন। এটা না তৈরি হলে খুব মুশকিল।’- ইজেম, স্টাইল, নিজস্বতা নিয়ে এভাবেই সেদিন বলে যাচ্ছিলেন ‘তাহাদের কথা’র এই কারিগর।

আমার তখন মনে হচ্ছে রিয়ালিটি কিংবা বাস্তবতা নিয়ে কী ভাবেন কবি কিংবা নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত? তাঁর বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করছিলেন রিয়ালিটির সংজ্ঞাও – ‘আমি যেটা করি সেটা এক্সটার্নাল রিয়েলিটির কাজ, ম্যাজিক্যাল রিয়েলিটির কাজ। কেন না জেনারেল রিয়েলিটি আমার কাছে খুব বোরিং, খুব প্রেডিক্টেবল। তার সঙ্গে যদি স্বপ্ন মেশান, একটু ম্যাজিক মেশান, সেই রিয়েলিটি দেখবেন আপনার কাছে অন্যরকম, নতুন আরেকটা মাধুর্য নিয়ে আসছে। তা না হলে রোজকার যে রিয়েলিটি তার মধ্যে কোনো মজা নেই। ম্যাজিক নেই।’

আমি তখন জানতে পারছি ‘টোপ’ আসছে সামনে। তখনও ‘টোপ’ নিয়ে কথাবার্তা চলছে আমাদের সিনেমা আড্ডায়। আমার হুট করে মনে হল টোপও কি ম্যাজিক রিয়েলিটি? তিনি খুব স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিলেন সেদিন। বলেছিলেন – ‘এটা আমার বলার কথা নয়, এ আমি কেন বলতে যাব। আপনারা বলবেন। বলে কী বোঝানো যায় কিছু? ছবিটা আমি করে আসি। এখন দর্শক দেখবেন, যা বোঝার বুঝবেন।’

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কি সত্যজিৎ রায়-এর উত্তরসূরী ছিলেন? এ নিয়ে কথাবার্তা তো বেশ হতো। এর উত্তর সেদিন তিনি দিয়েছিলেন কড়া ভাষায়। বলেছিলেন, ‘আমি অনেককেই বলতে শুনেছি বিদেশে এসে, যে আমি সত্যজিৎ রায়ের উত্তরসুরী, ব্যাপারটা একদমই তা নয়। সত্যজিৎ রায় সত্যজিৎ রায়ের মতোন ছবি করেছেন, গল্প বলেছেন। আমি গল্প বলিনি। সত্যজিৎ রায় আমার প্রিয় কী প্রিয় নন, সেটা আমি কখনোই বলিনি। আমি এটা মনে করি সত্যজিৎ রায় খুব বড়মাপের একজন পরিচালক। বারবার তার ছবি দেখা যায়। কিন্তু আমার ছবির বিষয়, ভঙ্গি সবটাই তার থেকে যোজন মাইল দূরে।’

আর ঋত্বিক ঘটকের ‘ফিল্মের প্রেমে আমি পড়িনি মশাই, আমি মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চাই। কাল যদি এর চেয়ে বেটার মিডিয়াম পাই, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব’। এ উদ্ধৃতি সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘ আমি ঋত্ত্বিক ঘটকের এ বক্তব্য মানি না। অতো সহজে মাধ্যম চেঞ্জ করা যায় না। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন সাকসেসফুলি। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরও উনি এমনই মানসিকভাবে যোগ্য ছিলেন যে, তিনি ছবি আঁকতে শুরু করলেন। আরেকটা মাধ্যমের সাথে সংযোজিত হলেন। কিন্তু আঙ্গিককে অবহেলা করার , আঙ্গিককে ছুড়ে ফেলার কোনো কারণ নেই, আঙ্গিকটা একটা ভঙ্গি।’

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘টোপ’ ছবির একটি দৃশ্য

সেদিনের সেই আড্ডায় কথা প্রসঙ্গে যখন বাংলাদেশের নির্মাতাদের কথা উঠে আসে এক পর্যায়ে তখন তিনি নির্মাতা তারেক মাসুদ এর ‘মাটির ময়না’র কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন – ‘ইদানীংকালে দেখা ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ভালো কাজ। ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ও ভালো লেগেছিল।’

কী নিয়ে কথা বলিনি সেদিন ! এমনকি এই যে সিনেমার দেশ ঘুরে আসা কিংবা দেশেই সিনেমা প্রদর্শন অথবা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়া না হওয়া, এসব নিয়েও তো তাঁর মতামত জানতে চেয়েছিলাম। চলচ্চিত্র এবং বাণিজ্য এ নিয়ে তিনি স্পষ্ট মতামত দিয়েছিলেন সেদিন। বলছিলেন – ‘সবসময় যে চলচ্চিত্রগুলো বাণিজ্যিক উপায়ে ভালোভাবে রিলিজ করা যায়, তা হয়ত নয়। কলকাতায় একটা ছবি আমরা ১০০টা হলে রিলিজ করতে পারি, বাংলা ছবি। আর হিন্দি ছবি হলে তো আরো বেশি হলে রিলিজ করা সম্ভব। বাংলাদেশে সুযোগটি নেই। যেটা আমার খারাপ লাগে, দুঃখ লাগে এবং কষ্ট দেয় যে, অনেক প্রতিভাবান পরিচালক আছেন তারা ভালো কাজ করতে চান। কিন্তু দুটো জিনিস হচ্ছে না। দর্শকের সাপোর্ট , আর হচ্ছে অর্থ। কেননা পরিবেশক যিনি ছবি দেখাচ্ছেন তিনি ১৫% বাদ দিয়ে সবটাই নিয়ে নিচ্ছেন। তার জন্য বলতে চাই যে, বাংলাদেশের পরিচালকদের এটা ভাবতে হবে যে, ছবিগুলো কী করে বিদেশে বিক্রি করা যায়, বিদেশে তো বিশাল বড় বাজার আছে। আমার ছবি ‘দূরত্ব’ ১৯৭৮ সালে তৈরি। কিন্তু তখন আমার ছবি বিদেশে বিক্রি হয়েছে। এই শেষ ছবি ‘টোপ‘ও বিক্রি হয়ে গেল সেদিন টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। এটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে, বাজার একটা আছে। সেই বাজারটার একটা চাহিদা থাকে। সেই চাহিদাটা মাথায় রেখে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাথে লেখক জুয়েইরিযাহ মউ

আরও অনেক কথা সেদিন হতে পারতো যা হয়নি। আরও অনেক কথাই হয়েছিল যা লিখিত নেই, এই যেমন তিনি চলচ্চিত্র উৎসবে তরুণদের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন – নিজের নির্মাণ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সৎসাহস থাকা চাই। কত কত কথা ঝুলি ভরে জমিয়ে রাখি আমরা চলার পথের অনুপ্রেরণার রসদ হিসেবে। এসমস্ত কথা আমার এক জীবনের প্রাপ্তি হয়ে রইলো। প্রাপ্তি হয়ে রইলো দু’টো সাক্ষাৎ এর মুহূর্তরা।