চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমি স্বাধীনতা দিবসের নাম দিয়েছি, ‘বেঈমান বিতাড়ন দিবস’

গবেষণামূলক ও সাক্ষাতকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘ভাষা সংগ্রামীর বাংলাদেশ’ থেকে সংক্ষেপিত

ভাষা সংগ্রামী ডা. কর্নেল (অবঃ) সরফুদ্দিন আহমদ। সরফুদ্দিন আহমদ নামে বেশি পরিচিত। পিতা মরহুম কাজিমুদ্দিন আহমদ। জন্ম ১৯২২ সালে ১ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার চুনকুটিয়া গ্রামে। ঢাকার ঠিকানা ছিল বাড়ি-১৩, রোড-১১, সেক্টর-৪, উত্তরা। ২০১৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণে করেন এই ভাষা সংগ্রামী।

পরিচিতি: সরফুদ্দিন আহমদ ১৯৫১-৫২ মেয়াদে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে চিকিৎসক হিসেবে চাকরি নিয়ে বৃহত্তর ফরিদপুরে কাজ করেন কিছুদিন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান আর্মিতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ১৯ মাস বন্দী ছিলেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ১৯৮০ সালে কর্নেল হিসেবে স্বেচ্ছায় অবসর নেন তিনি। এরপর লিবিয়া আর্মিতে ৬ বছর মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করেন। দেশে ফিরে আইন পেশায় যুক্ত হন, ঢাকা বারে ৪ বছর কাজ করার পর হাইকোর্ট বারে কাজ করেন ৩ বছর। এরপর অবসর।

গ্রন্থ: ত্রিকাল ত্রিগুণ, বাংলা ভাষা সহজীকরন।
সন্তান: ৩ ছেলে ১ মেয়ে।

২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভাষা সংগ্রামী সরফুদ্দিন আহমদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন তারিকুল ইসলাম মাসুম।

তা ই মাসুম: ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন কবে?
সরফুদ্দিন আহমদ: নাইন্টিন ফোর্টি এইটে। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলাম ১৯৫১-৫২ সালে। আমাদের সময় ভিপি ছিলেন ড. গোলাম মাওলা।
তা ই মাসুম: পড়াশোনা করলেন কোথায় কোথায়? ডাক্তারী শেষ করলেন কবে?
সরফুদ্দিন আহমদ: নাইন্টিন ফোর্টি এইটে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। রাজনীতি করতাম। ১৯৫১-৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিএস হই। ডাক্তারি পাশ করে চাকরি নিয়ে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ যাই বঙ্গবন্ধুর দেশে নাইন্টিন ফিফটি ফোরে। পরে ডিসি’র সঙ্গে ঝগড়া করে চাকরি ছাড়লাম। দেড় বছর পাড়া-গাঁয়ে ডাক্তারি প্র্যকটিস করি। পরে আর্মিতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে জয়েন করলাম।
তা ই মাসুম: আর্মিতে গেলেন কবে?
সরফুদ্দিন আহমদ: জুন নাইন্টিন ফিফটি সিক্স। সেখানেও অনেক কাণ্ড ঘটল।
তার কারণ, আমি কোনো সময় ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার বলতে অভ্যস্ত ছিলাম না। বলতাম না। আমি উর্দু বলতে এবং লিখতে পারতাম। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে বা বসদের কাছে কোনো সময় জানতে দিতাম না যে, আমি উর্দু জানি। সেখানে বলতাম যে, কমপিলিটলি আননোন, এই ভাষা আমি জানি না। তো, ওরা যখন উর্দু বলত তখন আমি বলতাম যে, হ্যাঁ আমি কিছু কিছু উর্দু বুঝি, কিন্তু আই অ্যাম সরি দ্যাট, আই ক্যান নট স্পিক ইন দিস ল্যাংগুয়েজ। এইভাবে চাকরি করলাম। আমার আজীবনের লালিত ইচ্ছা ছিল, লালিত স্বপ্ন, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, হয়ে গেল উল্টোটা। যখন নাকি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ লাগল, তার দেড় বছর আগেই আমার পোস্টিং হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানে। দুর্গম জায়গাতে পোস্টিং হল। তো কাজেই আর দেশে ফেরা হল না। পাকিস্তানিদের সঙ্গে সঙ্গে ওরা যেখানে যুদ্ধ করল, আমিও ওখানে গেলাম।

যুদ্ধের শেষে, আমরা সবাই জানি সব বাঙালিদেরকে আর্মি হোক, সিভিলিয়ান হোক সবাইকে ওরা বন্দী করল। বিশেষ করে আর্মিম্যানদের। আমাদেরকে বন্দী করে পাকিস্তানিদের যে দুর্গ আছে সেই দুর্গগুলায় রাখত। আমি পরপর ৪টি দুর্গের মধ্যে ছিলাম। অবশেষে ১৯ মাস এরকম বন্দী থাকার পর রিপ্যাট্রিয়েট হয়ে দেশে আসি।
কোথায় হব মুক্তিযোদ্ধা! তা না হয়ে হলাম আমি রিপ্যাট্রিয়েট। এইখানে ৬ বছর চাকরি করলাম বাংলাদেশ আর্মিতে। আমার লাস্ট পোস্টিং ছিল আমাদের ঢাকাতে এএইচকিউ’তে (আর্মি হেড কোয়ার্টার)। অ্যাজ এ ফুল কর্নেল আমি রিটায়ার্ডমেন্ট নিয়ে চলে গেলাম লিবিয়া। লিবিয়ার ত্রিপোলিতে আমি ছিলাম ৬ বছর। গাদ্দাফীর দেশে। ৬ বছর চাকরি শেষে আসলাম দেশে।
তা ই মাসুম: ওখানে কি চাকরি করলেন?
সরফুদ্দিন আহমদ: ওদের মিলিটারি হসপিটালে মেডিকেল অফিসারের চাকরি করলাম ৬ বছর। তো ওখান থেকে এসে আর ডাক্তারি না করে অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষা দিলাম, এলএলবি আগেই করা ছিল। ল’ ডিগ্রি।
তা ই মাসুম: এটা কবে করছিলেন?
সরফুদ্দিন আহমদ: কী?
তা ই মাসুম: এলএলবি?
সরফুদ্দিন আহমদ: ল’ ডিগ্রি করেছি, ৭০ এর দশকে হবে।
তা ই মাসুম: ভাষা আন্দোলনে আপনার অংশগ্রহণের বিষয়টা বলবেন?
সরফুদ্দিন আহমদ: এটা তো সবাই জানেন যে, ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরিতে মিটিং হয় যে, এই ভাষা আন্দোলনটাকে একটা সংগ্রামী চেহারা দিতে হবে। এইভাবে চলবে না। একটা সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে নামতে হবে, তা নাইলে এটা আদায় হবে না।

তো, সেখানে দুইটা রেজ্যুলেশন সামনে আসল। একটা হল যে, যেহেতু বাঙালিরা হল পাকিস্তানের শকতরা ৫৬ ভাগ লোক সংখ্যা। এবং এখানে আমাদের ভাষা হল বাংলা। অতএব, বাংলাই হবে সমস্ত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এটা ছিল এক নাম্বার প্রপোজড রেজ্যুলেশন, মিটিং এর শেষে। ঐ মিটিংটা প্রিজাইড করছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এটা জানেন সবাই।

তো, আরেকটা রেজ্যুরেশন হল যে, না, যেহেতু তাদের ডিমান্ড হলো উর্দু, উর্দু আমাদের ওপরে চাপাতে চায়। উর্দু বাংলা দুইটাই হোক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
এটা নিয়া অনেকক্ষণ বিতর্কের পর যখন নাকি ভোটে দেওয়া হল। আমি, জগন্নাথ কলেজের জিএস, আরো ২-৩ জন ছাত্র, নাম মনে নাই আমরা প্রথম রেজ্যুলেশনে পক্ষে ছিলাম যে, বাংলাই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু আমরা ভোটে হেরে গেলাম। ভোটে বলা হল যে, দুইটাই রাষ্ট্রভাষা হবে।

সেখানে কথা ছিল, আমরা, ২০ তারিখ, ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে আমরা রাস্তায় নামব। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২১ না কিন্তু ২০। ২০ ফেব্রুয়ারি ঠিকই মিছিল মিটিং হতে লাগল। এটা খুব সংক্ষেপে বলছি, সবাই জানেন এগুলা। মিছিল মিটং হতে লাগল, পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এগুলা হতে লাগল। হতে হতে ২০ ফেব্রুয়ারি তারা করল কি ১৪৪ ধারা জারি করল। আমার যতদূর মনে পরে এক বিহারী ছিলেন ঢাকার ডিসি। রহমতুল্লাহ বোধ হয় নাম ছিল। তো তিনি ১৪৪ ধারা জারি করলেন ২০ ফেব্রুয়ারি।

তো আমি গিয়ে ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের জন্য একটা মাইক কিনেই আনলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে, তৎকালীন ২৫শ ৬০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম মাইকটা। বেশ স্ট্রং মাইক ছিল। তো দুইটা চোঙ্গা, দুইটা মাইক, এমপ্লিফায়ার সব শুদ্ধ লেগেছিলো ২৫শ ৬০ টাকা। সেটা এনে ফিট করলাম। একটা কন্ট্রোল রুম বানিয়ে সেটা ফিট করা হল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে। তো, এইখানে একটুখানি বলে রাখি, (তিনি উঠে গেলেন। এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল এবং প্রথম শহীদ মিনার বাননোর স্থানের একটি ছবি নিয়ে আসলেন। ছবিটা বড় একটা ফ্রেমে বাঁধাই করা। এর একপাশ তিনি ধরেছেন আর আরেকপাশ আমার হাতে ধরিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন এবং বর্ণনা করছেন)

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে যে জায়গায় ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছিল, হোস্টেল এলাকার সেই সময়ের চিত্র দেখাচ্ছেন ভাষা সংগ্রামী ডা. কর্নেল (অবঃ) সরফুদ্দিন আহমদ

এটা হচ্ছে, তৎকালীন মেডিকেল কলেজের ব্যারাক হোস্টেল, এই লাইনে ছিল ১১টা ব্যারাক, প্রত্যেকটা একশ ফুট লম্বা। এই লাইনে ছিল ৬টা, প্রত্যেকটা ১শ ১০ ফুট লম্বা। আর এই তিনটা ছিল আরো বড়, ১শ ৯০ ফুট করে লম্বা। এই ২০টা ব্যারাকে আমরা প্রায় ৪শ আবাসিক ছাত্র ছিলাম। বাদ বাকীরা যার যার বাড়ি থেকে আসত। এইগুলা ডাইনিং হল, এইগুলা বাথরুম ইত্যাদি। এইটাই ছিল (পুরো এলাকা দেখিয়ে) রণাঙ্গন। রণাঙ্গন বলা ঠিক হবে না বধ্যভূমি। আমরা তো আর মারতে যাই নাই পুলিশকে, আমরা আন্দোলন করেছি।

এই জব্বার, বরকত এরা বিক্ষপ্তভাবে এখানে গুলি খেয়ে পড়েছিল। আর এই হল ফুলার রোড। ফুলার রোড এইখান থেকে গেলে এই জায়গাটায় হবে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সামনের দিকে গেলে। আর এইটা হল ফুলার রোড থেকে চলে গেছে বকশী বাজার রোড। এর ঐ পাশে হল ইঞ্জনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির মাঠটা। তারপরে হল বিল্ডিংটা এখানে, এই হল অবস্থানটা। আর মধ্যখান দিয়ে এইটা ছিল ইন্টারনাল রোড। আর এই ঘেরাও এর ঐ দিকে ছিল মেডিকেল কলেজের আউট পেশেন্ট এরিয়া ইত্যাদি।

ঐ বিল্ডিংগুলা নাই, এখন অন্য রকম বিল্ডিং করেছে। এই ব্যারাকও নাই। সব ব্যারাক উঠে গিয়ে এখন এইটা ময়দান। এখন এখানে মিটিং হলে আমরা শুনি।
আর এই প্রথম শহীদ মিনার আমরা তৈরি করি, এই ইনসেটে একটু বড় করে দেখানো হয়েছে। বেজটা বানাই ৬ ফুট বাই ৬ ফুট। মাটির নীচে আমরা ভিত দেই, ৫ ফুটের ভিত। ৬ ফুট বাই ৬ ফুট বেইজ আর উঁচুটা ছিল ১১ ফুট। সাহায্য নিয়েছিলাম, শুধু বকশি বাজার থেকে একজন ওস্তাগার নিয়েছিলাম। আর তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বর্তমান বিল্ডিং তৈরি করার জন্য কনস্ট্রাকশন ম্যাটারিয়ালস যথেষ্ট ছিল। ইট সিমেন্ট বালি এইগুলো আমরা ব্যবহার করেছি। অবশ্য মালিকের পারমিশন নিয়ে।
তা ই মাসুম: তখন মালিকের নাম ছিল কি?
সরফুদ্দিন আহমদ: পিয়ারু সরদার। পিয়ারু সরদারের কাছে যখন মেডিকেল কলেজের ছেলেদের পাঠালাম আমরা, পিয়ারু সরদার তৎক্ষণাৎ রাজি হলেন। বলেন কি, কিন্তু ছেলেরা তোমরা অপচয় করো না। যা লাগে তোমরা ব্যবহার করো। চাবি দিয়ে দিলেন উনি।
তা ই মাসুম: এখনকার যে শহীদ মিনার এটা কি এই জায়গাটা?
সরফুদ্দিন আহমদ: এই জায়গাটা, কোনাটা পড়েছে এই যে, এই রাস্তাটা তো আর নাই, একটা কোনা পড়েছে এইখানে। এইখান দিয়ে আমরা ঢুকি। এই সমস্ত জায়গায় বসি আমরা।
তা ই মাসুম: এখনকার বহির্বিভাগটা কোন জায়গা?
সরফুদ্দিন আহমদ: এখনকার বহির্বিভাগ এই জায়গায় (ছবিতে ওপরে পেছনের দিকে), এগুলো এখন তো আর নাই। এই এইগুলা সব বহির্বিভাগ।
তা ই মাসুম: তেল শাহ’র মাযার কি তখন ছিল ওখানে?
সরফুদ্দিন আহমদ: এই যে তেল শাহ’র মাযার। এই তেলশাহ’র মাযার,
(এক লাইনে ৬ টা ব্যারাক হোস্টেল যে লাইনে তার মধ্যবর্তী স্থান)
তেল শাহ’কে আমি দেখেছি। এই সাধুকে আমি দেখেছি।
তা ই মাসুম: দেখেছেন?
সরফুদ্দিন আহমদ: তেল শাহ করতো কী? গরম কাল কী শীত কাল, এই কম্বল-টম্বল জড়িয়ে থাকতো। আর হিন্দু কী-মুসলমান কী সবাই তাকে ভক্তি করতো। উনি করতেন কী, গিয়া, দোকানের মধ্যে হাত পাততো, ওরা জানতো যে, কী চায়? তখন ওরা অঞ্জলি ভরে সরিষার তেল দিতো। অঞ্জলি ভরে ঐ তেল মাথায় ঢেলে দিতো। তার পুরা কম্বল ভিজা তেল দিয়া, রাস্তায় যেখানে যেখানে যেতো তেলের ছাপ, ছাপ-ছাপ, ছাপ পড়তো।

মাইক ফিট করলাম, প্রথম বক্তৃতা করলেন গোলাম মাওলা সাহেব ভিপি। সেকেন্ড বক্তৃতা করলাম আমি। তারপরে মাইকটা পরিচালনার ভার দিয়ে দিলাম আব্দুল আলীম চৌধুরীকে। শহীদ আব্দুল আলীম চৌধুরীকে। ঐ যার চোখ তুলে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, মাইন্ড ইউ, আব্দুল আলীম চৌধুরীকে আমি ইলেকশনে পরাজিত করেছিলাম। উনি ছিলেন আমার এগেইনেস্টে জিএস ক্যান্ডিডেট।
তা ই মাসুম: উনি শহীদ হলেন কবে?
সরফুদ্দিন আহমদ: ঐ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তানিরা তার চোখ নাকি আগে তুলেছে শুনলাম। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। ও তুমি আই স্পেশালিস্ট? রাজাকাররা আগে তার চোখ তুলে তারপর তাকে হত্যা করেছে। ঐ বধ্যভূমিতে। মানুষ এরা! এদের আবার মৌলবীরা সাপোর্ট করে! আশ্চর্য! আচ্ছা, তো এই চলল, চলতে চলতে গিয়া, বললামই তো হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর জারি হইয়া গেল। পর দিনে হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর ভাঙা হবে কি, হবে-না? এটা জানে সবাই, এটা বলে লাভ নাই। আমতলায় মিটিং হলো। অনেক বাক-বিতণ্ডা হয়ে ডিসাইড হল যে, হান্ড্রেড ফোর্টি ফোর ভাঙা হবে। 

এই ১০ জন ১০ জন করে বেরোতে লাগল ছাত্ররা। এবং পুলিশ এদের তুলে নিয়ে ট্রাকে করে, এই বর্তমান যে উত্তরা, এইখানে এনে ছেড়ে দিতো। তো ২১শে ফেব্রুয়ারি এই রকম মিটিং মিছিল হতে লাগল। খণ্ড মিছিল এবং ছোট ছোট মিটিং হতে লাগল। পুলিশে ধাওয়া দেয়, পাল্টা ধাওয়া হয়।

অবশেষে আমরা ডিসাইড করলাম যে, না, বড় আকারে একটা মিছিল বাইর করা হবে। জমায়েত হল সবাই, এই ঢাকা মেডিকেল কলেজের এই ছাত্রাবাসের এই সব জায়গা ভরে গেল ছাত্র দিয়ে (ছবি দেখিয়ে)। এই রাস্তা ভরে গেল, এই রাস্তা ভরে গেল, এই রাস্তা প্রায় ভরে গেল। শুধু ছাত্র না।
তা ই মাসুম: ছাত্র-জনতা।
সরফুদ্দিন আহমদ: জনতা কেন? এর আগে একটু বলে নেই, ডিসিশন তো হলো ২০ তারিখ আন্দোলন আরম্ভ হবে?
তা ই মাসুম: জ্বি।
সরফুদ্দিন আহমদ: ১৯ তারিখ রাত্রি বেলা, সন্ধ্যার পরে গোলাম মাওলা সাহেব আমাকে ডেকে বললেন যে, সরফুদ্দিন সাহেব, ঢাকার যে মুসলমান, এরা যদি আমাদের বিপক্ষে লাগে, তাহলে কিন্তু আমাদের আন্দোলন সাকসেসফুল হবে না। মুশকিল আছে এবং তারা লেখাপড়া জানে না। ঢাকার মুসলমান যাদেরকে আমরা বলি কুট্টি। তো, উনি আমাকে ঠাট্টা করে বললেন, আপনিও তো কুট্টি মানুষ! আপনার বাড়ি ঢাকা তো? আপনি তো কুট্টি। এক কাজ করেন, আপনি কাদের সরদারের কাছে যান।

কাদের সরদার বুঝলেন কে? কাদের সরদার, তখনকার দিনে মুসলমান মহল্লাগুলা, ২২টা মহল্লা ছিল ঢাকায়। মুসলমান প্রধান, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ২২টা মহল্লা ছিল। এই মহল্লার প্রত্যেক মহল্লাতে একজন করে সরদার ছিলেন। এই সরদারদের ওপর একজন আবার প্রধান সরদার ছিলেন। সেই প্রধান সরদারকে এমপ্লয় করতেন ঢাকার নবাব নিজে। ঢাকার নবাব নিজে একটা ফাংশন করে তার মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দিতেন। এইটা ছিল কাস্টম ঢাকার।

সেই সময়কার প্রধান সরদার ছিলেন কাদের সরদার। কাদের সরদার নিরক্ষর মানুষ। পাতলা, কালো রং এর পাতলা মানুষটা, নিরক্ষর মানুষ কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান। ভীষণ সাহসী অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোক কিন্তু লেখাপড়া জানতেন না। ঢাকার লায়ন সিনেমা হল এবং চিটাগং এর লায়ন সিনেমা হলের মালিক কিন্তু। সোল মালিক ছিলেন উনি। লায়ন সিনেমা হলের গলিতে এখনো ওনার বাড়ি আছে। ওনার বাড়িতে ওনার একমাত্র ছেলে ওখানে থাকে, ঐ বাড়িতে থাকে।

আমি বছর চারেক আগে মিট করে আসছি, দেখা করে আসছি। আচ্ছা যাই হোক, মাওলা সাহেব ডেকে বললেন, ওনাকে গিয়ে যদি বোঝাতে পারেন, আমাদের আন্দোলনের কথাটা, আার সাপোর্ট যদি পান তাহলে কিন্তু অনেক কাজ হবে।
তখন কী করলাম, এই আমি, সাথে নিলাম আলীম চৌধুরী সাহেবকে। তখন কিন্তু অ্যাটিচিউডটা দেখেন! আমি কিন্তু তাকে পরাজিত করেছি ইলেকশনে।
তা ই মাসুম: জ্বি।
সরফুদ্দিন আহমদ: কিন্তু বলা মাত্রই সাথে সাথে গেছেন। সব কাজে ছিলেন। অ্যাটিচিউড ভিন্ন ছিল তখনকার দিনে। আলীম চৌধুরী সাহেব, মঞ্জুর, পরে মিনিস্টার হইছিলেন আহমদ ফজুলল করিম। ময়মনসিংহের পরে জিয়ার সময় মিনিস্টার হয়েছিলেন, ডেপুটি হেলথ মিনিস্টার। আমিসহ এই চার জন। ওরা তিন জন আর আমি দুইটা রিক্সায় করে গেলাম কাদের সরদারের বাড়িতে। তো কাদের সরদারকে অনেক বোঝালাম। উনি চা-টা আনলেন, আমরা আর খেলাম না।

বললাম যে, আপনার দেয়া চাই, আপনার সাপোর্ট চাই। অনেক করে বুঝালাম যে উর্দু চাপিয়ে দিলে যে বাঙালির কী ক্ষতি হবে? আমরা যে ওদের পদানত হয়ে পড়ব। চাকরি-বাকরিতে পিছিয়ে পড়ব। সব ব্যাপারে ওরা সুপ্রিম হয়ে যবে, আমরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে যাব। তো, অনেক করে বুঝাবার পরে, উনি বুঝলেন।
উনি বোঝার পরে ম্যানেজারকে ডাকলেন। ও মিয়া এই ২২ সরদারের কাছে খবর পাঠাও। যে, কাইলক্যা ছাত্ররা আন্দোলনে নামব, বাংলা ভাষার লাইগ্যা। আন্দোলনে নামব, ঢাকার মুসলমান যেউন এগো বিরুদ্ধে না যায়। হয় ওগো সাথে থাকব, আর না হয় বাইত, বইয়া থাকব। এদের বিরুদ্ধে যেউন না যায় কেউ। এইটা, এই খবরটা, আমার এই কথাটা ২২ সরদাররে পৌঁছাইয়া দাও। তিনি ম্যানেজারকে হুকুম দিলেন।

এইবার খেলাম, খেয়ে ওনাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। বললাম যে, আপনার দোয়া, আপনার এ সাপোর্ট, আপনার দোয়া, আমরা মনে করব যে, আমরা সাকসেসফুল হয়ে গেছি। ওনাকে ধন্যবাদ দিয়া আমরা চলে আসলাম। ছাত্র-জনতা এবং বিশেষ করে ঢাকার আদি মুসলমান। এরা না হলে পরে, এত বড় সমাবেশ হতো না।

আমার হাতে ছিল চোঙ্গা, তখনকার দিনে কিন্তু ব্যাটারির চোঙা ছিল না। টিনের চোঙা। তো আমার হাতে এক টিনের চোঙা, এখন আমরা ডিসাইড করছি এই বিশাল মিছিলকে কোথা থেকে কোথায় কোন রুট দিয়ে নিয়ে যাব।
তা ই মাসুম: জ্বি।
সরফুদ্দিন আহমদ: এই যখন চিন্তা ভাবনা চলছে, তখন বিনা প্ররোচনায়, ফট ফট ফট ফট গুলির আওয়াজ হল। তো গুলির আওয়াজ হল। আমরা মনে করলাম যে, এটা হয়তো আকাশে গুলি ছুঁড়ছে, আমাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য। দেখলাম যে না, রক্তাক্ত কয়েকজনকে দেখা গেল পড়ে গেছে। ছাত্ররা ধরাধরি করে তাদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

তখন চোঙা দিয়ে বললাম, আপনারা যে যেখানে পারেন আত্মগোপন করেন। পুলিশ গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করেছে। তো ঐ দিন মারা গেছিল ৪ জন আমাদের জানা মতে।
(এই বলে আবার ডাইরি আনতে গেলেন, ডাইরি নিয়ে এসে বসে দেখলেন ডাইরি)
জানা মতে যারা মারা গেছেন তারা হলেন রফিক, বরকত, জব্বার, সালাম এই একুশ তারিখে। আরো নাম না জানা তিন চারজন, মেডিকেল কলেজ ব্যারাক হোস্টেলের কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে সেক্রেটারিয়েট রোডের ওপর পড়ে গেল। তো এদের পরিচয় পাইনি। এবং পুলিশ নিয়া গেছিল। এবং কারা এরা এদের আমরা ট্রেস করতে পারি নাই। এই ৩-৪ জন নাম না জানা। এই চার জনের নাম জানা গেছে। এদের কবর পরে সনাক্ত করা হয়েছে আজিমপুরে।

২২ তারিখ আমরা গায়েবী জানাযা নামাজ পড়লাম। এই ব্যারাক হোস্টেলের প্রাঙ্গণে গায়েবী জানাযা নামাজ হলো। তারপরে ২৩ তারিখ আমরা মুখচুন করে সবাই বসে আছি। এরপরে কী করব? এরপরে আন্দোলনকে কেমন করে এগিয়ে নিব? চুপচাপ সব বসে আছি। সবার মুখ চিন্তান্বিত। ভেবে পাই না কী করব এরপরে?

তবে হঠাৎ করে, আমাদের মধ্য থেকে আমরাই বলে উঠলাম, কেন? একটা ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ করলে হয়। লাশ তো আমরা পাইনি, পুলিশে নিয়া গেছে। শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে, স্মৃতি রক্ষার্থে এইখানে, যেখানে এরা পড়েছে, এই প্রাঙ্গণের মধ্যেই আমরা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বানাব। কথাটা ডিসাইড হয়ে গেল সন্ধ্যার একটু আগে। অর্থাৎ ২৩ তারিখ সন্ধ্যার একটু আগে। তখন দুইজন ছাত্র ছিল, একজন ছিল বদরুল আলম, বদরুল আলম এখন নাই মারা গেছে। আরেকজন ছিল সাঈদ হায়দার। উনি বেঁচে আছেন, বুড়া থুরথুরা।
তা ই মাসুম: সাঈদ হায়দার?
সরফুদ্দিন আহমদ: ড. সাঈদ হায়দার। উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে থাকেন।
তা ই মাসুম: ওনার ফোন নাম্বারটা আছে? আমাকে দিবেন।
সরফুদ্দিন আহমদ: আছে। উনি বেঁচে আছেন। ওনারা এই দুইজন আঁকতে পারতেন। আমরা এদেরকে বললাম যে, একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বানাব। একটা ছবি এঁকে আনো। নকশা এঁকে আনো। এরা দুই জনে মিলে নকশা এঁকে আনল। আনার পরে আমি আর গোলাম মাওলা সাহেব নকশার মধ্যে একটু হের-ফের করলাম। হের-ফের করে আবার কারেকশন করে আনল।

তারপর ঐটার ওপরে সারারাতের শ্রমে ছাত্ররা, আমরাই কামলা, আমরাই মজুর, আমরাই মাটি খুঁড়ি, সবকিছু আমরাই। খালি দুইজন ওস্তাগারে ঐ গাঁথুনি গুলার মধ্যে সাহায্য করল। একজন ওস্তাগারে, আর বাদ বাকী সব ছাত্ররা। সেই দিন একটুখানি ঝির ঝির করে সামান্য সামান্য করে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছিল, আর খুব ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। ঠাণ্ডা বাতাসে আমাদের হাত-পা প্রায় হিম হয়ে গেছে। আমার তো এইগুলা (হাত) ফুলে গেল। কিন্তু শহীদ স্মতিস্তম্ভের টপটা ফিনিশ দিতে পারলাম না। ভোর হয়ে গেল তো। তো প্লাস্টার করে এইখানে (হাতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের একটা ছবি নিয়ে) লিখে দেয়া হলো ‘শহীদ স্মতিস্তম্ভ’। একটা বড় করে কাগজের মধ্যে লিখে দেওয়া হল। চারদিকে ঘেরাও দেওয়া হল।

তো এখন, এই কথা প্রচার হয়ে গেল, আর দলে দলে, হাজারে হাজারে পুরুষ-নারী, সবাই দেখতে আসল এটা। আর ফুলের মালা আর ফুল দিল মানুষ।
এই অবস্থায় চলল আর এইটাকে ওপেনিং করা হইছিল এইযে, দ্বিতীয় দিন যে শহীদ হল, শহীদ শফিক। শহীদ শফিকের বাবাকে কেমন করে যেন ছেলেরা খুঁজে আনল। তাকে দিয়ে ওপেনিং করা হল ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা। তো ২৪ তারিখ রইল, দলে দলে লোকেরা এসে শ্রদ্ধা জনাতে লাগল। লোকেরা কিন্তু এটাকে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বলল না।

লোকেরা মুখে মুখে বলতে লাগল, ‘শহীদ মিনার’ ‘শহীদ মিনার’। এই শহীদ মিনার বলতে বলতেই এটা শহীদ মিনার হয়ে গেল। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ কিন্তু লেখা ছিলো এটার গায়, ওটা আর কেউ বলল না। বোধ হয় উচ্চারণটা একটু কঠিন ছিল এই কারণে আমার মনে হয় কেউ বলল না। বলে শহীদ মিনার, শহীদ মিনার। ঐ যে শহীদ মিনার নাম দিল আজকেও ঐ শহীদ মিনারই আছে। 

তো এখন এটা রইল, ওপেনিং করার পর ২৪ তারিখ রইল। ২৫ তারিখও একই ব্যাপার। ২৬ তারিখও সারাদিন একই ব্যাপার। ২৬ তারিখ বিকাল বেলা ৩ ট্রাক, ২ ট্রাক ভর্তি পুলিশ, নূরুল আমীনের পুলিশ, আর ১ ট্রাকের মধ্যে গাইতি, বেলচা, কোদাল, শাবল এই সমস্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে আর বিরাট একটা দড়ি নিয়ে কাছি, মোটা দড়ি নিয়ে, লম্বা দড়ি নিয়ে নামল। তখন আমরা ভাবলাম এই দড়িটা দিয়ে কী করবে? আচ্ছা, আর ব্রেন গান, আজকাল যেমন স্টেন গান।
তা ই মাসুম: জ্বি।
সরফুদ্দিন আহমদ: তখনকার দিনে ছিল ব্রেন গান। ব্রেন গান হইল এটা এলএমজি। মিলিটারি নাম হইল এলএমজি, লাইট মেশিন গান। মাটিতে রেখেও ফায়ার করা যায়, আবার তুলেও ফায়ার করা যায়। লাইট মেশিন গান, ঐটা ছিল পুলিশের বড় যন্ত্র। থ্রি নট থ্রি লাইফেল আর ঐটা।

এইটা এইম কইরা আমাদের দিকে বলল যে, খবরদার! এর ধারে কাছে কেউ আসবা না। যখন ভেঙে নিয়ে চলে যায়। আমরা কেউ সামনে যেতে পারলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। বারান্দাগুলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আফসোস করলাম আর দেখলাম। ভেঙে নিয়ে চলে গেল এবং সম্পূর্ণ মাটি, একেবারে লাস্ট ইট পর্যন্ত নিয়ে গেল। আর মাটি সমান করে দিয়ে ভরে ওরা চলে গেল। ওদের গার্ড রয়ে গেল। ৩ দিন পর্যন্ত আমাদেরকে আটকে রখল। যে, ঐ ধারে-কাছে যেন আমরা না যাই।
হ্যাঁ, যে দিন ভেঙে নিয়ে যায় ২৬ তারিখ, ঐদিন আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেবকে ডেকে এনে ওনাকে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এটাকে (শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ) ওপেনিং করানো হয়েছিল। ২৬ তারিখ সকাল বেলা। আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেব আজাদের এডিটর ছিলেন উনি। ওনাকে এনে আনুষ্ঠানিক ওপেনিং করানো হয়েছিল। তো, এই শহীদ মিনার তো নিয়ে গেল!

তারপরে কয়েকদিন পরে এরা (পুলিশ) পিছনে পড়লো আমাদের কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করবে। পুলিশ ঘোরে, তো আমরা পালিয়ে গেলাম। আমি পালিয়ে গেলাম, তারপরে আহমদ রফিক, যার কথা বললাম, লেখক, ইনিও পালিয়ে গেলেন। বেশ কয়েকজন আমরা পালিয়ে পালিয়ে রইলাম। তো এখন এই হইল আপনার শহীদ মিনারের হিস্ট্রি।
তা ই মাসুম: ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হল এখন মোটামুটি কোয়র্টার সেঞ্চুরি পার করেছি। এখন ভাষা আন্দোলনের হাফ সেঞ্চুরি’র পর মোটামুটি ৬০ বছর পার করেছি পাকিস্তানের পর থেকে। ভাষা আন্দোলন হল আমাদের সব আন্দোলনের মূল সূত্রপাত। আমরা ভাগ হয়ে যাওয়ার ধরণা কিন্তু ঐ আন্দোলন থেকেই আসছে। তো এর মধ্যে আমরা কী পেলাম? কী পেলাম না?
সরফুদ্দিন আহমদ: এর আগে আমি আমার নিজের মনোভাবটা ব্যক্ত করি। আমার নিজের মনোভাব হল, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এই ভাষা আন্দোলন এবং এমনকি তার সূত্র ধরে মুক্তিযুদ্ধ এই দুইটাকেই আমি সম্মানজনক বলে কিছু মনে করি না। আপনি অবাক হবেন যে, এই কথা আমি কেন বললাম? এটাকে আমি জাতির জন্য সম্মানকজনক কিছু মনে করি না। আমি মনে করি, এটা আমাদের জাতির একটা বদনাম।

কেন বদনাম? শতকরা ৫৬ ভাগ হয়েও এদেরকে কেন সংগ্রাম করতে হবে। তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য? এটা ডেমেক্রেসি হয়ে থাকে। পাকিস্তান যদি আমরা ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি হিসেবে বানিয়ে থাকি। তাহলে তো ডেমোক্রেটিক্যালি অটোমেটিক্যালি এটা হয়ে যাবে। বাংলা হবে পুরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার জন্য মাইনরিটির কাছ থেকে এটা ছিনিয়ে আনতে হবে কেন? সংগ্রাম করতে হবে কেন? জীবন দিতে হবে কেন?

তার কারণ হল, আমি ওদের চেয়ে বেশি দোষ দেই আমাদের নিজেদেরকে। বাঙালি সম্ভবত একটা হীনমন্যতায় ভোগে। যার কারণে আজ থেকে প্রায় পৌনে চারশ বছর আগে বাঙালি কবি, চিটাগাং এর কবি আব্দুল হাকিমকে বলতে হয়েছিল, অত্যন্ত ক্ষেদের সঙ্গে উনি লিখেছিলেন, তার স্থানীয় ভাষায় লিখেছিলেন,
‘যে জন বঙ্গে’ত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,
সে’জন কাহার জন্ম নির্নয় ন’জানি’
নিজ ভাষা বিদ্যা যার মনে নাহি রয়,
নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশ ন’যায়!’

নিজের ভাষা যার মনোপুত না হয়, যার ভাল না লাগে, তাহলে যে দেশের ভাষা তোমার ভাল লাগে, সেই দেশে তুমি চলে যাও না কেন?আজ থেকে পৌনে চারশ বছর আগে চিটাগাং এর কবি অত্যন্ত ক্ষেদের সঙ্গে এটা বলেছেন। এতে বোঝা যায় যে, একটা হীনমন্যতা বাঙালির মনে অনেকদিন থেকে ছিল। এই হীনমন্যতার এগেইনেস্টে আবার তার লেখনির থ্রুতে লড়াই করেছেন, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। জ্ঞান তাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। উনিও লড়াই করে গেছেন এই হীনমন্যতার এগেইনেস্টে। উনিও বলে গেছেন, কেন বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে না? উনি বাংলার স্বপক্ষে অনেক কথা বলে গেছেন।

তো, এইভাবে আমি দেখেছি, পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের মধ্যে কিছু ছিল, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় স্তুজ। স্তুজ এর বাংলা কী? স্তুজ ও বলা হয় আর কুইজলিংও বলা হয়। যারা বিপক্ষকে সাহায্য করে, নিজের পক্ষের ক্ষতি করে। এই রকম কুইজলিং বা পাকিস্তানিদের স্তুজ বা ধামাধরা কিছু লোক ছিল। আপনিও জানেন, আমিও জানি, এই লিডাররা কার ছিলেন। এদের কারণে, আর কিছু অফিসার ছিলেন, যাদের মধ্যে হীনমন্য ভাবটা খুব বেশি ছিল। তারা আমি দেখেছি, বাড়িতে বাচ্চাদের সঙ্গে উর্দু বলথো। আরে! তুমি বাঙালি, তোমার ওয়াইফ বাঙালি, কি কারণে তুমি বাচ্চাদের সঙ্গে উর্দু বল?

তো এই সমস্ত দেখে, পাকিস্তানিরা উৎসাহিত হয়েছিল যে, না, আমাদের সাপোর্টে বাঙালিদের মধ্যে অনেক লোক আছে কাজেই এদের দাবালে পরে, দাবানো যাবে এদের। তো এই কারণে বোধ হয় আমাদের আন্দোলন করতে হয়েছিল। মাইনরিটির কাছ থেকে মেজরিটি হইয়া আমরা আমাদের অধিকার আদায় করছি। এইটা কিন্তু আমি কোনো গর্বের বিষয় মনে করি না। সিমিলারলি, কেন মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে? আপনি ফিফটি সিক্স পার্সেন্ট। আপনি ফোর্টি ফোর পার্সেন্টের কাছ থেকে স্বাধীনতা নিতে হবে কেন? আমি স্বাধীনতা দিবসের নাম দিয়েছি, ‘বেঈমান বিতাড়ন দিবস’। এই ৮৫ বছর বয়সে এখনো যখন দেখি যে, কোনো ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে অন্যের হয়তো গেইম হচ্ছে। শতকরা, আমার ছেলে বলে যে, শতকরা ৯০ জন বাঙালি এই পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে হাত তালি দেয়! এদের সম্পর্কে আমার খুব খারাপ লাগে। আরে বাবা, এরা তো তোদেরকে পরশু দিনই গোলাম বানাতে চেয়েছিল। এদের জয়ে তোদের উৎসাহ কেন? এটা আক্ষেপ আমারো, আমার হোল ফ্যামিলিরও আক্ষেপ। এই মনোভাবটা দূর করতে হবে।

ওরা মানুষ না! ওরা হল বর্বর জাতি। আমার চেয়ে ভাল, পাকিস্তানিদের আর কেউ চিনে না। আমি ১৮ বছর, আমার জীবনের বেস্ট সময়টাতে বাঙালি ডাক্তার হওয়া সুবাদে, মেডিকেল অফিসার হওয়ার সুবাদে ওদের জেনারেল থেকে আরম্ভ করে ওদের সুইপার র‌্যাঙ্ক সবার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আমি পরিচিত। কী লাইনে চিন্তা করে? নিজেদের সন্বন্ধে কী ভাবে? মানুষ সন্বন্ধে কী ভাবে? বাঙালিদের সন্বন্ধে কী ভাবে? আমার চেয়ে ভাল কেউ বলতে পারবে না।

আপনি কোন পার্টি সাপোর্ট করেন জানি না। আমি কোন পার্টি, আমি তো কমিউনিস্ট পার্টি’র আগেই বলেছি আপনাকে। আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগও দেই নাই। কমিউনিস্ট পার্টি এই মহাজোটে যোগ দেয়নি কিন্তু লক্ষ্য করেন। আমি মনে করি যে, এই ভাবটা দূর করতে হবে। প্রথম উঁচা স্টেজ থেকে। উচা স্টেজে যদি জিনিসটা হয়ে আসে, তাহলে নীচা স্টেজে অর্থাৎ ছাত্র লেভেলে, কর্মী লেভেলে এই ভাবটা যাবে।
আমি আমার ফ্যামিলিকে বলি যে, ভাবটা এমন পর্যায়ে এসেছিল।

আজকে যদি ওয়ান ইলেভেন না হতো? যদি আজকে ১/১১ না হতো। তাহলে হতো কী? এরা আাঁট-ঘাঁট বেধে ঠিকই করে নিয়েছিল যে, বিরুদ্ধ পার্টিকে কয়টা সিট দিবে। আর তাদের লিডার বলেই দিয়েছিল যে, এইবার ইলেকশন হলে আওয়ামী লীগ ১৫-২০টার বেশে সিট পাবে না। এক্সাক্টলি তাই, তাই দিত! ১৫-২০টার বেশি সিট দিত না এবং যেখানে যেখানকার সিট তাদের ইচ্ছা ঐ সিটগুলা দিত। তার পরে হতো কি? এই বাবরের মতো আরেকজনকে তারা বানাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ঐ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করতো কী? ২ দিন কি ৩ দিনের জন্য তার পুলিশ ফোর্সকে একটা ফালতু কাজে ব্যস্ত রাখত। দেখা যেতে কি পুলিশ খুব ব্যস্ত কাজে। আর এদের কর্মীরা দিনে-দুপুরে বড় বড় ছুরি হাতে, চাকু হাতে গিয়ে বিরুদ্ধ দলের যত লিডার আছে এবং যত প্রগ্রেসিভ লিডার আছে, আমাদের যেমন কমিউনিস্ট পার্টির যত লিডার আছে, এই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আর এ এইচ খান, মঞ্জুরুল আহসান খান এরা কেউ রক্ষা পেত না।

যত প্রগ্রেসিভ মাইন্ডেড মানুষ, লিডার এবং তাদের বিরুদ্ধ দলের যত লিডার তাদের দিনে-দুপুরে জবাই করে থুয়ে আসত। তারপরে পার্টি থেকে বলা হত, এরা ইন্টারনাল কোন্দলের কারণে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলাফলে এরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করেছে। এই করতো। আই অ্যাম শিওর এবাউট ইট।
তো, এর থেকে যে রক্ষা পেয়েছে, ১/১১ থেকে যে রক্ষা পেয়েছে। ১/১১ তারিখে যে রক্ষা পেয়েছে? কত তারিখ ২২?
তা ই মাসুম: ২২ জানুয়ারির নির্বাচন?
সরফুদ্দিন আহমদ: ২২ জানুয়ারি ২০০৭ হওয়ার কথা ছিল? ২২/১ এর থেকে যে রক্ষা পেয়েছে? ১/১১ হয়ে? যারা যারা আল্লাহ’এ বিশ্বাস করে তাদের আল্লাহ’র কাছে শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। আমি একটা ছোট্ট মানুষ, আমাকেও হয়তো ছাড়ত না, হে হে হে। আমাকেও ছাড়ত না। তো আমি খোদায় বিশ্বাস করলে আমিও একটা মিলাদ পড়াতাম, হে হে হে। আনফরচুনেটলি আই ডোন্ট বিলিভ ইন এনি গড।

চলবে…