আজ থেকে দেড়যুগ আগে আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চট্টগ্রাম কলেজের মতো ইসলামিক সংগঠনের ঘেরাটোপে থাকা পরিবেশ থেকে ঢাবি’র মুক্ত চিন্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ। বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গেলো। স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকি। ইতিহাস বিভাগে প্রাথমিক ভর্তি। বেশ বন্ধুবান্ধব জুটে গেলো। খুব কম দিনই নিজের টাকা দিয়ে প্রাত:রাশ করেছি। বান্ধবীরা বাসা থেকে ছোট টিফিন বাক্সে নাস্তা নিয়ে আসতো। ডাকসুর ক্যান্টিনে খেতাম।
সামিয়া, সেই বান্ধবীকুলের একজন। তার আরেক নাম সঞ্চিতা। আমার প্রতি এ শ্যামলা বরনের মেয়েটির অন্য রকম দুর্বলতা টের পেতাম। তার কাছ থেকেই প্রথম উপহার পেয়েছিলাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মানব জীবন’। মনে আছে, সেই বইটি বেশ সময় নিয়ে পড়েছিলাম।
দেড়যুগ পর ঢাকায় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে বাতিঘর বইয়ের দোকানে শীর্ষেন্দুর মুখোমুখি আমি। ‘আমার জীবন আমার রচনা’ নিয়ে আলাপে। তার আরো অনেক গুণমুগ্ধ পাঠক আছেন। আমি চ্যানেল আই থেকে রিপোর্ট করার জন্য হাজির। সহকর্মী অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর চকোর মালিথা আমার লেখালেখি আর পড়াশুনার পাগলামি সম্পর্কে আগে থেকেই জানেন।
যদিও আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পাঠক নই। কারণ উপন্যাসে আমার আগ্রহ কম। নন-ফিকশন পাঠেই আমার যতো আনন্দ। আমি নিজেও নন ফিকশন লেখার চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে বড় লেখকদের জীবনের প্রতি আমার দারুণ দুর্বলতা আছে। তারা কিভাবে লেখেন, কখন লেখেন, জীবনটা তারা কিভাবে যাপন করেন এইসব।
অজনপ্রিয়তার থেকে জনপ্রিয়তায়
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ৩০ এর দশকে। বড় হতে হতে ভাবতে লাগলেন, তাকে দিয়ে কি করা যাবে? শেষ পর্যন্ত তরুণ বয়সে স্থির সিদ্ধান্তে আসলেন লেখক ছাড়া অন্য কিছু হওয়া তার পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। পেট তো চালাতে হবে! তাই দেশ পত্রিকায় চাকরি। অনেক লিখতেও চাননি। ষাটের দশকে তার লেখা কেউ পড়তো না। বেশ হতাশ হতেন। একবার এক বেশ নামকরা কবি বলেছিলেন, তার মা তাকে বলেছে, শীর্ষেন্দুর বই না পড়তে। কারণ তার লেখা পড়লে ভয় পাবে। ‘ঘুণপোকা’ ১৭ বার পড়ে এক ছেলে আত্মহত্যা করেছে। কেন? আজও তার কাছে স্পষ্ট নয়। সেখান থেকে আজকের শীর্ষেন্দু। বেশ অবাক করা ব্যাপার।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহে শীর্ষেন্দুর জন্ম ১৯৩৫ সালে। পিতার রেলের চাকুরির সুবাদে এক যাযাবর জীবন ছিলো তার। তারপর ঠাকুর মেনে জীবন চলতে গিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলার পথে প্রান্তরে।
‘ছোট বেলায় আমি ছিলাম বেশ দুষ্ট। তাই ডাকনাম ছিলো রুঢ়। দুটো কাজ করতাম খেলাধুলা ছুটোছুটি। আর প্রচুর বই পড়তাম। এই অভ্যাসই হয়তো লেখক জীবনে ঠেলে দিয়েছে।’
‘বাংলাদেশে বাংলা বইয়ের পাঠক বেশি পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে’
বাংলাদেশে আসলে একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে। এখানকার পাঠকরা বেশ ভালো। আমি যতো রয়্যালিটি পেয়েছি, তার সিংহভাগ বাংলাদেশ থেকে। কয়েকবছর আগে আমি একবার গাড়ি নিয়ে ফেরি পার হচ্ছি। হঠাৎ একটি ছেলে আমাকে দেখে দৌড় দিলো। পরক্ষণে একটি বই নিয়ে এসে অটোগ্রাফ দিতে বললো। বইটির নাম পার্থিব। এমন পাঠক পশ্চিমবঙ্গে বা কলকাতায় পাওয়া যায় না। অবশ্য ইদানিং পাইরেসির কারণে রয়্যালিটি কমে গেছে। হা-হা।
‘বঙ্কিমের মতো লিখতে চেয়েছি’
ছোট বেলায় বঙ্কিম পড়তাম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সমাসবদ্ধ তৎসম শব্দ দিয়ে লিখতে চাইতাম। কিন্তু ১৯৬৭-৬৮ পর্যন্ত আমার কোনো পাঠকই ছিলো না। বেশ কয়েকবছর পর ৮০ দশকে আমি জনপ্রিয়তা পাই। পরবর্তী প্রজন্মেও পাঠক আমার বই পড়ছে বলে আমার রক্ষা। না হলে শীর্ষেন্দু অকালেই হারিয়ে যেতো।
‘লেখার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের প্রশ্ন ছিলো তার নানা লেখার চরিত্র, গল্প, গল্প লেখার গল্প নিয়ে। শীর্ষেন্দেুর সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমি লিখি না আমাকে দিয়ে চরিত্ররা লিখিয়ে নেয়। আমি প্রচুর ঘুরি। মানুষের চলাচল, ঝগড়া, আনন্দ দেখি। মনে করুন হঠাৎ কোথাও হুল্লোড় হলো। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মানুষের ভিড় ঠেলে দেখি। অনেকে হুটহাট দেখে চিনে ফেলে। বলে আপনি শীর্ষেন্দু না! আমি মজা করে বলি, আমি সে নই তবে তার মতো হওয়ার চেষ্টা করছি। অনেকে তাই ভুল করে। হা-হা-হা।
‘ঠাকুরের শিষ্যত্ব আমার জীবনকে অন্যরকম করে দিয়েছে’
বাংলা সাহিত্যে অন্য লেখকদের চেয়ে আমার জীবনটা একটু ভিন্ন। ঠাকুরের শিষ্যত্ব কারণে আমি বাংলার গ্রাম-গঞ্জে পথে ঘাটে ঘুরে বেরিয়েছি। প্রচুর পায়ে হেঁটেছি। সাধারণ মানুষের বাড়িতে থেকেছি। ওরা তো আর আমার লেখাটেকা পড়ে না। আপন মানুষ হিসেবে জানে। এখন আমি যেসব গল্প লিখছি সেখানে গ্রামের, পল্লী এলাকার অনেক মানুষের গল্প আছে। যারা ঠিক ষড়যন্ত্র বোঝে না। যাদের জীবনে তেমন দৌড়ঝাপ নেই।
‘সুনীল রহস্য, সমরেশের অনেক লেখা পাঠকের চাহিদায় লেখা তাই সাহিত্যমূল্য কম’
লেখক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া এখানে বেশ কঠিন। হয়তো সম্ভবও না। আমি সেটি করিনি। চাকুরি করে তার পাশাপাশি লেখালেখি করেছি। আপনি যদি লেখালেখি করে জীবন ধারণ করতে চান, তবে পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী লিখতে হবে। পাঠক তো বিচিত্র। কখনো ঝালমুড়ি চায়, কখনো আইসক্রিম থেকে চায়। তখন কম্প্রোমাইজ করতে হয়। কম্প্রোমাইজ করলে লেখক সত্ত্বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সমরেশ অনেক লিখতে গিয়ে এটি করেছে। তার অনেক লেখার সাহিত্য মূল্য নেই। তবে সুনীল বেশ রহস্যময়। কিভাবে এত লেখা লিখতেন জানি না। তিনি রাতে লিখতেন না। সকালে লিখতেন। সকালে দু’তিন ঘণ্টা লিখে কিভাবে এত লেখা লিখা সম্ভব জানি না। অবশ্য তাকেও আমি বলেছিলাম আরেকটু কম লিখতে।
‘ভালোবাসার মূলেও আছে ভিটামিন’
আমি যখন লিখতে বসি তখন মাথা একেবারে সাদা থাকে। কিছুই থাকে না। তখন ভাবতে থাকি একটি লাইন। এটা অনেকটা একটি তন্তু থেকে অনেক সুতো বের করার মতো। এই যেমন ভাবতে ভাবতে আমি একটি উপন্যাস শুরু করেছি এই বলে, ‘ভালোবাসার মূলেও আছে দারুণ ভিটামিন।’
‘আমি চোর নই, তবে চোর আমার খুব প্রিয় চরিত্র’
শীর্ষেন্দেুর গল্প উপন্যাসে বেশ চোরের দেখা মেলে। কিছুদিন পূর্বে নিজেও চোরের খপ্পরে পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে বেশি কিছু নেয়নি। আমার কাছে চোরের জীবন বেশ রহস্যময় মনে হয়। আমরা প্রত্যেকেই তো চোর। আসলে যে খেতে না পেয়ে চুরি করে, তার চেয়ে বেশি চোর তো আমাদের আশেপাশে নিয়মিতই ঘুরে বেড়ায়।
‘আমি প্রযুক্তি অভ্যস্ত, এখন ট্যাবেও লিখি’
এখনকার প্রজন্মের বিনোদনের অনেক মাধ্যম। তাই তারা শুধু বইয়ে মেতে থাকে না। তবে আমি নিজেও এখন ট্যাবে লিখি। তাতে সুবিধা হয়। যদিও আমার পরের প্রজন্মও এসবে ভয় পায়। আমার সন্তানেরা চায় আমি হাতে লিখি। তারা তাদের বাবাকে হাতে রাখতে চায় তো। হাহাহা।
‘বিশ্বাস আত্তিকৃত না হয়ে লেখায় এলে বিপদ’
আপনি তো ঠাকুরে বিশ্বাসী তারপরও আপনার লেখায় বিশ্বাসের প্রভাব কম। কারণ কী? এমন প্রশ্নে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন, দেখুন বিশ্বাস ভালো। তবে সেটি লেখায় আত্মীকৃত হয়ে আসতে হয়। বিশ্বে যত সাহিত্য সেগুলো এক পাল্লায় আর রাশিয়ান সাহিত্য আরেক পাল্লায়। লিও টলস্টয় কিন্তু কমিউনিস্ট বিপ্লবের পূর্বের মানুষ। দুঃখ-কষ্ট, যাতনার মধ্যে, অসাম্যের মধ্যে লিখেছেন। কমিউনিস্ট বিশ্বাসকে চাপিয়ে দিতে চাননি। অসাম্যের পৃথিবীর অবসান চেয়েছেন। কিন্তু দেখুন কমিউনিস্ট সময়ে কোনো বড় সাহিত্যিক পাওয়া যায়নি। বিশ্বাসের নগ্ন প্রকাশে সাহিত্য মূল হারায়। একপক্ষীয় হয়ে পড়ে।
‘লেখক জীবনের আক্ষেপ নেই তবে পৃথিবী নিয়ে শঙ্কা আছে’
৮৪ বছরের জীবনে কোনো আক্ষেপ নেই। যা হয়েছি, তাই হওয়ার কথা ছিলো। জীবন তো দারুণ উপভোগও করলাম। আমার লেখার সাড়া চেয়েছি। মানুষ সাড়া দিয়েছে। খ্যাতি, টাকা পয়সা, পরিচিতির জন্যও তো লিখিনি। লিখেছি যাতে মানুষের অনুরণন পাই। আমি যেভাবে জীবনকে দেখছি সেভাবে আর কেউ দেখে কিনা, ভাবে কিনা সেটি বোঝার জন্য। মানুষের সাড়া পেয়েছি। আমি ধন্য। তবে খুব খারাপ লাগে যখন মূর্খ কালিদাসের মতো যে ঢালে বসে আছি সে ঢালের গোড়া কাটছি দেখি। আমাজনে আগুন লেগেছে। আসলে তো লাগেনি, লাগানো হয়েছে। ওখানকার প্রেসিডেন্টও জড়িত। ওখান থেকে রিসোর্ট করে আয় করতে চায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো আবহাওয়া ও জলবায়ুর পার্থক্য বোঝে না। বলে আমাদের আমেরিকায় তো খুব শীত। বলুন কেউ যদি জেনে না জানার ভান করে কিংবা না জেনে জানার ভান করে তবে তাকে আপনি কিভাবে বুঝাবেন। আমাদের প্রিয় ধরিত্রী ধ্বংস করছে কিছু অর্বাচীন। আগামী দিনের পৃথিবী এদের কাছে বড়ই অনিরাপদ।’