জুন মাস আসছে। আসছে বাজেট। বাজেটে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তো থাকছেই, আরও থাকছে আয়করে জর্জরিত হওয়ার চিন্তা। আমরা যারা কম আয়ের মধ্যবিত্ত, তাদের জন্য, বাজেট সত্যিই একটা আতঙ্ক! বলতে দ্বিধা নেই, আয়করটা আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
একবার এক মার্কিন অধ্যাপক আমাদের দেশের একজন নামজাদা আয়কর বিশেষজ্ঞ আইনজীবীকে নাকি প্রথম আলাপেই জিজ্ঞেস করেছিলেন— ‘আপনি কি মনে করেন সরকারের কর আদায়ের অধিকার থাকা উচিত?’ আইনজীবী তো হতভম্ব। অধ্যাপকের প্রশ্নটাকে একটু ভেঙে দেখা যাক।
প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে সর্বশেষ অর্থবছরে আয়কর দিয়েছেন মাত্র সাড়ে ১৩ লাখের মত মানুষ। এবছর সেই সংখ্যা কিছুটা বাড়বে আশা করা হলেও সেটি মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র এক শতাংশও হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যদিও গবেষকরা বলছেন, এই সংখ্যা ৪ থেকে ৫ গুণ করার সুযোগ রয়েছে।
এদিকে প্রত্যক্ষ কর না দিয়ে বা বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়ে একদিকে অনেকে বেঁচে যাচ্ছেন, অন্যদিকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে মধ্যম আয়ের করদাতাদের ওপর করের চাপ বাড়ছে এবং পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরেও।
আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া সহজ করা এবং লোকজনকে আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে গত ৮ বছর যাবত আয়কর মেলা আয়োজন করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। যদিও বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে আয়করদাতার সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা যায়নি।
আমাদের সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, প্রায় এক কোটি মানুষকে সরকার কর দেওয়াতে পারে না। বড় বড় কোম্পানিদের কর ছাড় এবং আইন মোতাবেক কর ফাঁকি দেওয়ার গল্পও প্রচুর। দেশের মোট জনসংখ্যার যে মাত্র এক শতাংশ আয়কর দেন, তাঁরা কেন ঠিকঠাক কর দিচ্ছেন না, তা নিয়ে বাকি ৯৯ শতাংশের চিন্তার শেষ নেই! এরই নাম গণতন্ত্র। খুব সহজ করে বললে, ‘পাবলিক ফাইনান্স’ বা সরকারি খাই-খরচার তত্ত্বগ্রাহ্য সংজ্ঞা হল, পরের সম্পদে পোদ্দারি করা।
নাগরিকরা কেন কর দিতে চান না, সে বিষয়ে প্রচুর গবেষণা আছে। একটা কথা অনেক বার উঠে এসেছে— অনেক নাগরিক আছেন যারা রাষ্ট্রের দুর্নীতিকে এড়ানোর জন্য কর দেন না! আবার কর ব্যবস্থা জটিল হওয়ার কারণেও অনেকে কর দেন না-এমন তথ্যও রয়েছে। তবে আমার সাধারণ জ্ঞানে মনে হয়, কর না দিয়েও পার পাওয়া যায় বলেই আমাদের দেশের মানুষ কর দেন না।
তবে সবচেয়ে হতাশা হলো আমরা যারা কর দিই, তাদের। আমার দেওয়া করের টাকা কী ভাবে খরচ হয় যদি তার হিসেব করি, তা হলে দেখব, যে যে খাতে যত টাকা খরচ হচ্ছে, তার কোনোটাই আমার মনঃপূত নয়। আমাদের দেশে দীর্ঘ কাল ধরে রাস্তা ভাঙ্গা-গড়ার বিড়ম্বনা চলে, আর আমরা রাস্তার জন্য কর দিয়ে যাই। আজ শিক্ষা-উচ্চশিক্ষা সব তলানিতে গিয়ে ঠেকছে আর আমরা কর দিয়ে চলেছি। দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের আজীবন দেখভাল, অকারণে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দিনের পর দিন গবেষণার জন্য টাকা না দেওয়া, পরিবর্তে মিটিং-সেমিনারের নামে টাকার শ্রাদ্ধ— সবই দেখছি আমরা, তবুও বলব, সরকার বাহাদুরের ঘরে কর জমা দিয়ে চলা আমাদের পবিত্র কর্তব্য?
সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা হচ্ছে কর-নীতির বৈষম্য। আমি বেসরকারি চাকরি করে যা আয়কর দিই, আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু আমার চেয়ে অন্তত দশ গুণ বেশি রোজগার করে একই পরিমাণ আয়কর দেন। তাঁর বাড়ি, গয়না, দশটা ক্রেডিট কার্ড, গাড়ি-ড্রাইভার আরও কত কী! তিনি যদি আমার মতোই তাঁর গোটা আয়ের ওপর কর দিতেন, তবে তাঁর মোট আয়করের পরিমাণ আমার দেওয়া করের তুলনায় ঢের বেশি হত। তিনি দেননি, বা সরকার তাঁকে সেই কর দিতে বাধ্য করতে পারেনি। তাতে এটাই দাঁড়াল যে আমার রোজগারের একটা অংশ সরকারের ঘরে চলে গেল, কিন্তু আমার বন্ধুর টাকা তাঁর নিজের হাতেই থাকল। পাবলিক ফাইনান্সের তত্ত্ব বলবে, করবাবদ জমা দেওয়া আমার টাকাটা এখন গোটা দেশের সব মানুষের টাকা। প্রশ্ন হল, যাঁরা রোজগার করেন না, অথবা রোজগার করেও কর দেন না, আমার রোজগারের টাকা কী ভাবে তাঁদের সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়?
আসলে, কর ব্যবস্থা খানিকটা বেরোজগেরে আর নিঃস্ব রাজাদের সংসারখরচ চালানোর জন্য একটি আইনানুগ ব্যবস্থা। আমার সামাজিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার মতো যতটা কর প্রয়োজন, ততটা দিতে কারও আপত্তি থাকা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু আমার রোজগারের টাকা আপনি ভোট হাতিয়ার করে কেড়ে নিচ্ছেন, এটাই আসলে আয়কর। যার গতি নেই, সে দিচ্ছে; না দিয়েও যাদের উপায় আছে, তারা দিচ্ছে না। কোনটা ভাল কাজ আর কোনটা খারাপ কাজ, কোনটা আসল সাদা আর আসল কালো, কে জানে।
যে টাকায় কর দেওয়া হয়নি, সেটাই কালো টাকা। এই কালো টাকা নিয়ে গত প্রায় দুই দশক ধরে কথা খরচা কিছু কম হয়নি। কালো টাকা নিয়ে, কর ফাঁকি দেওয়া নিয়ে যত কথা হয়েছে, সেই তুলনায় করের টাকা কোথায় যায়, কী ভাবে ব্যবহৃত হয় এবং হয় না, তাতে কার কতখানি উপকার, আমার সাদা টাকাই বা অর্থনীতিতে কার উপকারে লাগে, সেই প্রশ্নগুলো কার্যত ওঠেনি। কাজেই, আরও একটা প্রশ্ন তুলে রাখা যাক।
ধরুন, আমি মোট ১০০০ টাকা রোজগার করি। তার ওপর ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিই ১০০ টাকা। বাকি ৯০০ টাকার মধ্যে ৪০০ টাকা ব্যাঙ্কে সঞ্চয় করি। ব্যাঙ্ক আবার সেই ৪০০ টাকা বড়লোক ব্যবসায়ীকে ধার দেয়। তিনি ঋণখেলাপি করেন, অর্থাৎ টাকাটি আর ফেরত দেন না। তখন সরকার অন্য করদাতাদের টাকায় ব্যাঙ্ককে ভর্তুকি দেয়। সেই টাকায় ব্যাঙ্ক আমাকে আমার জমা রাখা ৪০০ টাকার ওপর সুদ দেয়। যে ব্যবসায়ী ব্যাঙ্কের ঋণ মেরে দিলেন, তাঁর অন্য ব্যবসা কিন্তু দিব্যি ধার পায়। প্রশ্ন হল, ওই ৪০০ টাকা কোথায় গেল? কার উপকারে লাগল?
ধরুন, আমি কর ফাঁকি দিতে আরম্ভ করলাম— অর্ধেক আয় লুকিয়ে রাখতে আরম্ভ করলাম। এখন আমি ৫০০ টাকার ওপর কর দিই ৫০ টাকা। ব্যাঙ্কে ২০০ টাকা জমাই, হাতে নগদ কালো টাকা রাখি ২০০ টাকা। সেই ২০০ টাকা আমি আমার বাড়ির পাশের এক ক্ষুদ্র হতদরিদ্র পটলবিক্রেতাকে ধার দিলাম। বিনা সুদে নয়, বরং ব্যাঙ্কের সুদের হারের চেয়ে বেশি সুদেই। আমি সুদ পাই, পটলবিক্রেতারও সংসার চলে। আমি খুশি, পটলবিক্রেতাও খুশি। আমার কালো টাকা কিন্তু এই গরিব মানুষটির উপকারে লাগল।
ওই পটলবিক্রেতা ব্যাঙ্কে গেলে কোনও দিন ২০০ টাকা ঋণ পাবেন না, কারণ ঋণ পাওয়ার জন্য নিজেকে ‘সাদা’ প্রমাণ করতে হবে। তাঁর ব্যবসার ধরনই তাঁকে সেই সেই সুযোগ দেয় না। বলতেই পারেন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের চড়া সুদের ঋণ তাঁর ওপর প্রতি দিন আরও বেশি বোঝা চাপিয়ে চলেছে— তিনি কোনও দিন সেই বোঝা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্তু, সরকার তো তাঁর জন্য নেই। সরকার তাঁকে পটলবিক্রেতা ছাড়া আর কিছু হতে সাহায্য করেনি, ব্যবসায়ী হলেও কোনও ব্যাঙ্ক তাঁকে সাহায্য করে না। চড়া সুদ দিতে হলেও তিনি সংসার চালিয়ে নেন, না হলে মারা পড়তেন। ভেবে দেখুন, ব্যাঙ্কে জমা রাখা আমার সাদা ৪০০ টাকা যা করতে পারেনি, কর ফাঁকি দেওয়া কালো ২০০ টাকা কিন্তু সেই কাজটাই করল।
এখন ভয় পেয়ে আমি ওই ২০০ টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে দৌড়লাম, জেলে যাওয়ার ভয়ে। আমার করভার বেড়ে গেল— আমি সাদা হলাম। আমার ২০০ টাকা আবার কোনও বড়লোকের বিনিয়োগের নামে লোপাট হয়ে গেল। আমার চেয়েও যার বুকের পাটা বেশি, আমাদের পটলবিক্রেতা হয় এমন কোনও মহাজনের কাছে আরও চড়া সুদে ধার নিতে শুরু করলেন, নয়তো মারা গেলেন। টাকা কালো থেকে সাদা হওয়া মানে আসলে পটল বিক্রেতা থেকে ওই ধার শোধ না-করা বড়লোক ঋণগ্রহীতার হাতে টাকা হস্তান্তর।
বলতেই পারেন, সরকার ৪০০ টাকা থেকে প্রাপ্ত কর বিনিয়োগ করে, খরচা করে পটলবিক্রেতার অশ্রুমোচন করতে পারে। কিন্তু, তিনি হয়তো তাঁর ছেলে-মেয়েকে পড়াতে চান, উচ্চ গুণমানের শিক্ষা দিতে চান, তাদের জন্য পুষ্টি চান, স্বাস্থ্য চান। দেশের প্রায় প্রতি পঞ্চাশটি শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, ক্লাস সেভেন-এইট নাগাদ অন্তত ৫০ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুল ছেড়ে দেয়— উচ্চশিক্ষায় পৃথিবীর নিরিখে আমাদের স্থান লজ্জা পাওয়ার মতো। করের টাকা কি ঠিক ভাবে খরচা হয় আদৌ? সাদা-কালো ফারাক করা অত সহজ নয়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)