এক
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের অখ্যাত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে কিভাবে সাত কোটি বাঙ্গালির কিংবদন্তীতুল্য নেতায় পরিনত হলেন সেটা বুঝতে হলে তার পটভূমি জানা দরকার। ইতিহাস জানা দরকার। দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতামালায় বাংলাদেশ: স্টেট অব দি নেশন শীর্ষক লিখিত বক্তব্য রাখেন। নাতিদীর্ঘ ওই বক্তব্যে স্বভাবত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি বেশ কিছু কথা বলেন।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ একটি জাতি, কারণ তারা একটা জাতি হতে চায়, অন্য কিছু নয়। জাতি হিসেবে মৃত বা জীবন্ত ঐতিহ্যের যা-কিছু তাকে অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করেছে, তার কোনো তালিকা এই জাতিসত্তাকে ব্যাখ্যা করতে বা অস্বীকৃতি দিতে পারে না। এই জাতিকে তৈরি করেছে তার অনমনীয় গর্ব, সুখে-দুঃখে আট কোটি মানুষের সঙ্গে একই পরিচয় বহন করা, অন্য কিছু নয়, শুধু বাঙালি হতে চাওয়ার জেদ।
একজন জ্ঞানী গ্রিকের মতে, দেশপ্রেম হচ্ছে পাহাড়-নদী ঈশ্বর প্রদত্ত প্রকৃতি এবং জনগণসহ নিজের দেশকে ভালোবাসা। ……অ্যাসিরীয়, কালদীয়, মিসরীয়, গ্রিক, রোমান, আরব, ইরান বা ইদানীংকালের লাল রাশিয়ার অবদান, যার প্রকৃতি নিয়ে মস্কো ও পিকিং এমনকি ঢাকাতেও উত্তপ্ত বিতর্ক রয়েছে, যেসব ঐতিহ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে খুব বেশি পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন পড়ে না। এদের সঙ্গে যৌথভাবে বা আলাদাভাবে তুলনা করলে আমাদের জাতির দেয়ার মতো কিছুই নেই। তথাপি যা আমাদের একত্রে ধরে রেখেছে, পরিণত করেছে এক জাতিতে, তা হচ্ছে আমাদের শুধু এই জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়ার ঐকান্তিক কামনা। এটাই আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুকে আমাদের যুগের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
জাতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে, জাতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বিচার করতে, যে চালিকাশক্তি বঙ্গবন্ধুর মতো আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের পেছনে কাজ করেছে, তার গভীরে যাওয়া প্রাসঙ্গিক। কী কারণে তিনি জাতির জীবনে দাগ কাটতে পেরেছেন? বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়ার পেছনে তার দাবিগুলো কী? যা-ই করুন না কেন, বঙ্গবন্ধু কেন সেগুলো করেছিলেন? কেন মানুষটি তার নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে এত অসচেতন ছিলেন? সামান্যতম সতর্কতা দিয়েই করুণ পরিণতির মধ্যে সমাপ্ত এই নিচুস্তরের নির্মম নাটককে এড়ানো যেত। কিন্তু নাটক কি শেষ হয়েছে? এই জাতির বিশ্লেষণ এই বিষয়টি সবাইকে যত্নের সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। অবশ্য যত উঁচুদরের বীরই হোন না কেন, কেউই দিনের ২৪ ঘণ্টা জুড়ে বীর থাকে না। এই ব্যতিক্রমটি বাদে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, বঙ্গবন্ধু দেশপ্রেমে বিহ্বল ছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সেই কথার প্রতিধ্বনিই মেলে। বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ এই তিন সত্ত্বায় মিলেমিশে গেছে তার সারাটা জীবন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে সমাজতাত্ত্বিকরা এই উপলব্ধিতে একমত হয়েছেন যে, বাঙালির মনস্তত্ত্ব বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি আর কেউ বুঝতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বলে তিনি তার পুরোটা জীবনই উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার জন্য। বাঙালির জন্য। বাংলাদেশের জন্য।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার ঐ বক্তব্যে আরও বলেছেন, ‘দেশপ্রেমের সংজ্ঞাকে যত ব্যাপক করে তোলা যাক না কেন, বঙ্গবন্ধু ততখানিই তার দেশকে ভালোবাসতেন। যে প্রেম তাকে বিহ্বল করেছিল, তা দেশের প্রতি যে হালকা আবেগ আমরা অনুভব করি এবং যাকে দেশপ্রেম হিসেবে চালিয়ে থাকি, তার থেকে অনেক বেশি আলাদা। বঙ্গবন্ধু একজন ভালো মুসলমান, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় বিশুদ্ধবাদী মুসলমান ছিলেন। ……পৃথিবীর সেই ছোট্ট অংশটার প্রেমে তিনি বিহ্বল ছিলেন – যার নাম বাংলাদেশ। এ ধরনের ভালোবাসা বিপজ্জনক হতে পারে। বঙ্গবন্ধুই তার প্রমাণ। এ ধরনের আবিষ্ট বিহ্বল ভালোবাসা একজনকে অন্ধ করে তোলে, বিশেষ করে সেই ভালোবাসার প্রতিদান পাওয়ার সময়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত যে সময়ে দুই অসম শক্তি এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু এবং শুধু বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন সেই প্রতীক – যার চারদিকে নিঃসহায় এক উদ্দেশ্যের সমর্থকরা একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল না। ওই অন্ধকার দিনগুলোতে, ওই অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে, যে কোটি কোটি জনতা, যারা ভবিষ্যতের জাতিকে সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে লুকানো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন প্রতীক।’
দুই
‘আমি ধর্ম নিরপেক্ষতার একটি চারা বাংলাদেশে রোপণ করেছি। এই চারা কেউ যদি ছিড়ে ফেলতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায় তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে কলকাতার ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরিসীম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা না থাকলে বঙ্গবন্ধু এরকম আশংকার কথা বলতে পারতেন না। বিশ্ব রাজনীতির মোড়লরা তাকে রাজনীতির কবি বললেও তিনি আসলে তার চেয়েও অনেক বেশি উঁচু স্তরের মানুষ। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু তার আশংকার কথা বলেছিলেন।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন। প্রতিটি আন্দোলনেরই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। আজীবন বিপ্লবী বিনোদ বিহারি চৌধুরী তার ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। অন্তরঙ্গভাবেই কথা বলেছি। দীর্ঘ সুঠাম বলিষ্ঠ তেজোদ্দীপ্ত দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী! প্রাণখোলা হাসি তো ভোলার নয়। আমাদের ধর্মগ্রন্থ গীতায় আছে যিনি সুখে-দুঃখে অবিচলিত, যিনি ভয় ও ক্রোধশূন্য তিনিই স্থিতধী প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। জাতির পিতাকে আমি স্থিতধী প্রাজ্ঞ বলে মনে করি।
১৯৭২ সালের একটা সাক্ষাৎকারের কথা বলে আমার ছোট লেখা শেষ করব। সেদিন জাতির জনকের কাছে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলাম। … কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু জুলির কুরি পুরস্কার পেয়েছেন। আমি একটি ফুলের স্তবক নিয়ে গিয়েছিলাম। ফুল দিয়ে করজোড়ে তাকে প্রণাম জানালে তিনি বললেন, দাদা আপনি কেন এসেছেন? আপনার কী চাই বলুন? আমি হেসে হেসে বলেছিলাম, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কোনো লাইসেন্স পারমিটের জন্য আসিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি। এখনও চট্টগ্রামে রাতের আঁধারে রাজাকার-আলবদর বাহিনী ট্রাকে করে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছে। তাদের কঠোর হাতে দমন করা না হলে ভবিষ্যতে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন ১ কোটি লোক পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয় এবং নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। আনুমানিক ২ কোটি লোক দেশে থেকেই পাকিস্তানিদের বিরোধিতা করেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। কিছু লোক নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন ছিল। আর বাকিরা পাকিস্তানপন্থী, তারা রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। তাদের সম্পর্কে সজাগ থাকা আমাদের উচিত নয় কি? এ কথাটি আপনার কাছে নিবেদন করতে এসেছি। আর একটি প্রার্থনা আপনার কাছে, আমাদের দেশের সেবা করার সুযোগ দেবেন। …বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন এবং তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন। প্রতিটি আন্দোলনেরই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বিশাল এক নক্ষত্রের বিচ্যুতি ঘটল। বাঙালির ভাগ্যাকাশে মেঘ ঘনীভূত হতে লাগল। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে আছে ‘ন হন্যতে, হন্যমানে শরীরে’। স্থ’ল শরীরে মৃত্যু হলেও তার আদর্শের তো মৃত্যু নাই। আমি আশাবাদী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হবেই।’
তিন
বঙ্গবন্ধু তার রাজনীতির পুরোটা সময় দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানি শাসকচক্রকে গোনার মধ্যে নিতেন না। তিনি মনে করতেন হাজার বছর ধরে চলে আসা অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই বাংলায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোন স্থান হতে পারে না। ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে এদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এদেশের মানুষ সর্বান্তকরণে ধর্মপরায়ণ। যার যার ধর্ম তার তার কাছে এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী বাংলার সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানি শাসকরা পরিকল্পিতভাবে এদেশের সাধারণ মানুষের ভেতর ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামকে নিজেদের মনমতো তাদের সামনে উপস্থাপন করার ষড়যন্ত্র করতে চাইলে বাংলার মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে, ঈমান দিয়ে প্রতিহত করেছিল। একাত্তরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এটা পরিস্কার হয়েছিল যে, এদেশের সাধারণ মানুষ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাকে পছন্দ করে না। বঙ্গবন্ধু নিজেও আর আট দশ জন বাঙালির মত ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
একাত্তরে পরাজিত শত্রু ও তাদের দোসররা দেশ স্বাধীনের পর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। এই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা একাত্তরের বিজয়ের পর নানাভাবে তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে আটঘাট বেঁধে নেমে পরে তারা। সোনার বাংলা গড়ায় বঙ্গবন্ধুর সরকারের সফলতাকে স্বাধীনতাবিরোধীরা নানাভাবে বিঘ্নিত করায় মেতে ওঠে। এই অপশক্তি ’৭২ থেকে ’৭৫ এর পনের আগস্টের আগ পর্যন্ত দেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, লুটপাট, গুপ্তহত্যা চালিয়ে দেশকে কার্যত অকার্যকর করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা দেশের সর্বত্র অস্থিরতা তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও তার সরকারকে উৎখাত করার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের নগ্ন খেলায় মেতে উঠল।
এই পরিস্থিতিতে ৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধান ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধান চতুর্থ সংশোধন বিল গৃহীত হওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী সুদীর্ঘ ভাষণে বঙ্গবন্ধু এই পরিবর্তনের পটভূমি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে দেশে বিরাজমান নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলার প্রসঙ্গে সংসদকে জানান, ‘দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, আজ আপনার এই এসেম্বলি বা সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তারা এই কনস্টিটিওয়েস্ট এসেম্বলির মেম্বার ছিলেন। হত্যা করা হয়েছে গাজী ফজলুর রহমানকে, হত্যা করা হয়েছে নুরুল হককে, হত্যা করা হয়েছে মোতাহার মাস্টারকে। এমনকি যা কোনোদিন আমাদের দেশে আমরা শুনি নাই যে, নামাজে, পবিত্র ঈদের নামাজে যখন কোনো লোক নামাজ পড়তে যায়, সেই নামাজের সময়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যা করা হয়েছে যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের হত্যা করা হয়েছে যারা সুদীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত এই বাংলাদেশে পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করছেন। কোনো একটি রাজনৈতিক দল যাদের আমরা অধিকার দিয়েছিলাম – তারা কোনোদিন এদের কনডেম করেছেন কি না? তারা কনডেম করেন নাই। তারা মুখে বলেছেন যে, তারা অধিকার চান। তারা মিটিং করেছেন, সভা করেছেন, রাজনৈতিক পার্টি গঠন করেছেন। কিন্তু তারা কী করেছেন? আমাদের সংবিধানে অধিকার দেয়া আছে। ভোটের মাধ্যমে আপনারা সরকার পরিবর্তন করতে পারেন – এই ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম। বাই ইলেকশন আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি। জনগণ ভোট না দিলে তার জন্য আমরা দায়ী নই। তখন তারা বলেছিলেন, এই সরকারকে অস্ত্র দিয়ে উৎখাত করতে হবে। মুখে বলেছেন, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করেন। কিন্তু গোপনে গোপনে তারা অস্ত্র জোগাড় করেছেন এবং সেই অস্ত্র দিয়ে যাদের কাছ থেকে আমরা অস্ত্র নিয়েছি, যারা অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন তাদেরকে হত্যা করেছে ঘরের মধ্য দিয়ে।
… আজকে আপনারা জানেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটা একটা ‘হট রেড অব ইন্টারন্যাশনাল ক্লিকে’ পরিণত হয়েছে। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেয়া হয়। এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হন। … আমাদের রক্ত থাকতে এ দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ক্ষমতা কারোর নেই।’
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে এ-দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি খুব একটা স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নকে পরিপূর্ণ করার সুযোগ তারা তাকে দেয়নি। আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশীয় ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করে বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করে। এ হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়। দেশকে নিয়ে যেতে থাকে পেছনে। বাঙালি জাতীয়তাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে দেশকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গন্তব্যহীন পথে।
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর সামরিক শাসকরা এদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে দিতে সর্বোচ্চ তৎপর ছিল। ঘাতকদের কাছে জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। দিন যতই যেতে লাগল, জাতির জনকের আকাশস্পর্শী ব্যক্তিত্ব, গুণাবলি ও আকর্ষণ বাংলার মানুষের কাছে আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে লাগল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে এ দেশকে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। তৎকালীন সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ এই শব্দটি উচ্চারণে প্রবলভাবে বিধিনিষেধ জারি হলো। সামরিক শাসক নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কার্যত নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো। একই সঙ্গে প্রচার মাধ্যমে পাকিস্তানের পরাজিত বাহিনীকে হেয় করে কোনো সংবাদ প্রচারেও আপত্তি জানানো হলো। সে সময় ‘পাক হানাদার বাহিনী’র পরিবর্তে বলা হতো যুদ্ধে পরাজিত বাহিনী।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ষড়যন্ত্রের পুরস্কার স্বরুপ ক্ষমতায় আসিন হওয়া সামরিক শাসকরা গদিতে বসেই পাকিস্তানি প্রভুদের প্রতিশ্রুতি রাখতে সংবিধান সংশোধন করে দেশে পুনরায় চালু করলেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। সামরিক শাসকরা পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালনায় মনোযোগী হলেন।
দেশ থেকে গণতন্ত্র তিরোহিত হলো। দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য রাস্তায় নামল। নব্বই -এ পট পরিবর্তনের পর ৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে সাধারণ মানুষ নতুন আশায় বুক বাঁধে। তারা স্বপ্ন দেখে সোনালি দিনের। ৯৬ থেকে ২০০১ মানুষের স্বপ্ন যাত্রা অব্যাহত থাকে। এরপর আবার মানুষ দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়। তাঁদের স্বপ্ন বাঁধাগ্রস্ত হয়। তারপর আবার সোনালি দিনের আগমন ঘটে। ২০০৯ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দৃঢ় সংকল্পে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন সামনের দিকে। উন্নয়নের দিকে। মধ্যম আয়ের দেশের দিকে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও যোগ্য দিক নির্দেশনায় পৃথিবীর অনেক দেশে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিতার দেখানো পথে হাঁটছেন বলেই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্বে প্রশংসিত। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)