শরাফত করিম আয়না! এই চরিত্রটিকে চেনেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। অন্তত বাংলা সিনেমা সম্পর্কে যারা খোঁজ খবর রাখেন। এই চরিত্রটিকে সিনেমার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতা দান করেছেন নির্মাতা অমিতাভ রেজা। কিন্তু এই চরিত্রটি সৃষ্টির পেছনের মানুষ অনম বিশ্বাস। হ্যাঁ। বলছিলাম দেশের নিকট অতীতের ব্যবসাসফল সিনেমা ‘আয়নাবাজি’র চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা অনম বিশ্বাসের কথা। না নতুন করে আয়নাবাজি প্রসঙ্গ নয়। তিনি কথা বলেছেন তার পরিচালনায় প্রথম সিনেমা ‘দেবী’ নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে যে চলচ্চিত্রটি সরকারি অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে। ছবিটি প্রযোজনা করছেন অভিনেত্রী জয়া আহসান। আলোচিত ‘দেবী’ ছবির প্রসঙ্গ ধরেই নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার অনম বিশ্বাস কথা বলেছেন নির্মাণের নানা বিষয়ে। বলেছেন আয়নাবাজি নিয়েও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা-
‘দেবী’র কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। কোন পর্যায়ে এখন?
পোস্ট প্রোডাকশন চলছে। ডাবিং করছি এখন। প্রায় অর্ধেক শেষ। আর কয়েকদিন সময় লাগবে। এডিট একটা পর্যায়ে দাঁড়ালো। ডাবিং শেষ করে আমরা ফাইনাল এডিট করে মিউজিক, সাউন্ড, কালার কারেকশান করবো।
গত বছরের শুরুতে দেবী’র শুট শুরু হয়েছিলো?
হ্যা। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে আমাদের শুটিং শেষ হয়েছে। কিন্তু দু’দিনের শুট বাকি ছিলো আমাদের। প্রত্যেকের ব্যস্ততার কারণে দুদিনের জন্য আমরা আসলে অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। আর শুটিং যেহেতু হচ্ছিলো না, তাই এডিটে যাবো কি যাবো না এটা সিদ্ধান্ত নিতেও আমরা একটু দেরি করে ফেলেছি। অবশেষে শুটটা গত কয়েকদিন আগে শেষ করা হয়েছে। আশা করছি আগামি মাসের মাঝামাঝিতে বুঝতে পারবো আমরা গল্পটাকে কীভাবে বলতে চাই। আর তারপরে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শেষ হতে যে ক’দিন লাগে।
‘দেবী’ নিয়ে আপনাদের এমন কোনো টার্গেট কি আছে, যে অমুক দিনে মুক্তি দিতে চান?
এখন যে পর্যায়ে আছে এভাবে ভাবলেও ছবির কাজ শেষ হতেই আরো দুই থেকে তিন মাস লাগবে শেষ করতে। মানে মে মাসস পর্যন্ত আমরা ছবিটাকে কমপ্লিট করতে সময় নিবো। তারপর সুইটেবল একটা সময় দেখে হয়তো রিলিজের কথা ভাববো। হয়তো বছরের মাঝামাঝিতে মুক্তির বিষয়টা সম্ভব হতে পারে।
সম্পাদনার কাজ নিয়ে ভাবনা কী?
একটা ফার্স্ট এডিট হয়েছে। এরকম একটা লং ট্রিপে একাধিকবার এডিট হবেই। মানে এটাই স্বাভাবিক প্রসেস। এটা হয়তো সামনের মাস পর্যন্ত চলবে। তারপর আর এডিট করবো না। তারপর সাউন্ড, মিউজিক নিয়ে কাজ শুরু করবো। কারণ ‘দেবী’ সিনেমার সাউন্ড খুব ক্রিটিক্যাল। ছবির কাহিনীতো একটু মিস্ট্রি, একটা মনস্তাত্বিক জগতের রিফ্লেকশান। সেই জায়গা থেকে এই ছবির সাউন্ড খুব ক্রিটিক্যাল আরকি।
মানে সাউন্ড নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপার আছে…
হ্যাঁ। এজন্যই আমরা একটু বেশি সময় নিচ্ছি।
কিন্তু দেবী’র শুটিং শেষ, এখনো এই ছবির কোনো ছবি বা লুক প্রকাশ পায়নি কোথাও। কেন?
আমরা আসলে সারপ্রাইজ দিতে চাই। একটা টাইমের আগ পর্যন্ত আমরা আমাদের চরিত্রগুলোকে রিভিল করতে চাচ্ছি না। চঞ্চল ভাই, জয়া আপা তারাতো খুব পরিচিত মুখ। সবার চেনা। আয়নাবাজিতে চঞ্চল ভাইতো অনেক রকমের রোল প্লে করেছেন। সো, উনার অনেক রকমের মেকাপও আমরা দেখেছি। জয়া আপাকেও আমরা বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি। এজন্য আমরা চেষ্টা করছি আমাদের মতো করে সবার সামনে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। না হলেতো সারপ্রাইজ নাই। একটা টার্মের পর থেকে অনলাইনে আমরা প্রমোশন শুরু করবো। আমরা ক্যাম্পেইনে যাবো। তখন সবাই দেবীর চরিত্রদের সাথে পরিচিত হতে পারবেন। ধীরে ধীরে সবাইকে আমরা পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। যেনো মানুষের মাঝে কিউরিসিটিটা থাকে।
‘দেবী’ নিয়ে এমনিতেই মানুষের আগ্রহ। বিশেষ করে এটা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের গল্প। তারউপর মিসির আলী!
হ্যা, হ্যা! তাতো অবশ্যই। দেবীর প্যাটার্নের গল্পতো এর আগে আমরা দেখেনি আশেপাশে। সেই জায়গা থেকে, এরকম প্যাটার্নের গল্প আমাদের সিনেমায় দর্শক কীভাবে রিসিভ করে, কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় এগুলোও আসলে ভাবনার বিষয়। আমরাতো প্রেম বা অ্যাকশানের গল্পে সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু দেবীর মতো গল্পকে মানুষ কীভাবে নেয় এটাই দেখার চেষ্টা করছি। মানুষের কাছাকাছি এমন গল্পে কীভাবে পৌঁছানো যায় এটা নিয়েও ভাবছি। কারণ এটা সত্যিই একটা কমপ্লেক্স গল্প।
অকে। কমপ্লেক্স গল্পের কথা যখন আসলো, তখন আমরা ‘আয়নাবাজি’ নিয়ে একটু কথা বলি। এটার গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপতো আপনারই?
জ্বী। এটা আমার চিত্রনাট্য।
তো আয়নাবাজিওতো একটা জটিল গল্প…?
আয়নাবাজি অরিজিনাল একটা গল্প। এটা একটা আলাদা জায়গা। আয়নাবাজিতে একটা কমফোর্ট ছিলো। যে কমফোর্টটা সামহাউ মানুষ পছন্দ করে ফেলছে। আর হুমায়ূন আহমেদতো আমাদের পছন্দের রাইটার। তার লেখা পড়ে আমরা বড় হইছি। তার প্রতি আলাদা দুর্বলতা আছে। কিন্তু আয়নাবাজি দেবী থেকে আলাদা প্যাটার্নের গল্প। দেবীতে একটা মেয়ের সাইকোলজিকে ফোকাস করা হয়েছে। যে ভাবে তার উপর একটা দেবী বা স্পিরিট আছে। শরীরে। এদিকে অন্যরা তাকে পাগল ভাবে। এই যে একটা দ্বন্দ্ব। আমরা চেষ্টা করছি এই সাইকোলজিক্যাল দ্বন্দ্বকে উপন্যাস থেকে বের হয়ে একটু আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে। মানে সিনেমার জন্য যেভাবে উপস্থাপন করা লাগে, সেভাবেই করার চেষ্টা করছি। উপন্যাস থেকে সিনেমায় আরেকটু ডিটেইলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, একটু ভেঙে। কিছুটা ইমপ্রুভাইজ করছি। যাতে দর্শকদের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছে দেয়া যায়।
আয়নাবাজির মতো জটিল গল্প ভাবনা আপনার ছিলো। এবার করছেন দেবী। ফিল্মমেকার হিসেবে কেমন দেখছেন সিনেমা নির্মাণ ব্যাপারটা?
আয়নাবাজিতো আর আমার ডিরেকশান দেয়া না। সেই জায়গা থেকে আয়নাবাজির মেকিং স্টাইল আর দেবীর মেকিং স্টাইল এক হবে না।
না। তাতো নাই। কিন্তু দুটোই আপনার কাছ থেকে দেখা। নির্মাতা হিসেবে আপনার ফ্রেশ অনুভূতিটাই জানতে চাই?
প্রতিদিন দেবী সিনেমার ভেতর দিয়েইতো যাচ্ছি এখন। প্রতিদিন বুঝতেছি। শিখতেছি। এতো লম্বা একটা জার্নি। লম্বা জার্নিটাই একটা ঘটনা আসলে। শুটিং শেষ করে যে ডাবিং শুরু করলাম এটাকেই আলাদা একটা জার্নি মনে হচ্ছে। প্রতিটা ক্যারেক্টারের উপর যখন সাউন্ডের লেয়ার ফেলছি তখন মনে হচ্ছে এরা আরো জীবন পাচ্ছে। এবং মনে হচ্ছে চরিত্রগুলোকে আরো ইমম্প্রুভাইজ করা সম্ভব। ডাবিং প্যানেলে। আমি আসলে এই জিনিষগুলো দেখছি প্রতিদিন।
নির্মাণে কি এটাই একেবারে হাতেখড়ি আপনার?
দেবীর আগে ফিকশন নিয়েতো আমি কাজ করিনি। আগে কিছু টিভিসি নির্মাণ করেছি।
আয়নাবাজি নিয়ে যদি একটু কথা বলি…
হ্যাঁ, অবশ্যই। আমিতো এখনো আয়নাবাজি নিয়ে প্রচুর কথা বলতে চাই। এটার রাইটিংয়ের যে এক্সপেরিয়েন্স এগুলো আমি বলতে চাই। কারণ ক্যারেক্টারগুলো এতো অরিজিনাল!
আয়নাবাজির গল্পটা কীভাবে এলো?
আয়নাবাজির আইডিয়াটা আসলে আসে শাওন ভাইয়ের মাথা থেকে। আমি তখন গ্রে’তে কাজ করতাম। সকাল বেলা একদিন শাওন ভাই এসে একটা নিউজের কথা বললেন। তখন সেটা ছিলো এক বা দুই লাইনের একটা গল্প।
নিউজটা কী ছিলো?
নিউজটা ছিলো এরকম, একজনের বদলি আরেকজন জেল খেটে দেয়। এটা শুনেই আমার মনে হয়েছিলো যে এটার মধ্যে ভালো ফিকশনের একটা ইলিমেন্ট আছে। এটা নিয়েই সিনেমা করা সম্ভব। আয়না, জার্নালিস্টের ক্যারেক্টার, আয়নার প্রেমিকা সবই আসলে অনেক ভাবনা চিন্তা করে ধীরে ধীরে ইম্প্রুভাইজ করে নির্মিত। সিনেমা রিলিজের কিন্তু চার বছর আগে স্ক্রিপ্ট তৈরি করা!
শরাফত করিম আয়নার চরিত্রটি নির্মাণ ভাবনাতো কনটেম্পরারি সিনেমায় একেবারে অভিনব…
এই চরিত্রটি আসলে আর্টিস্ট হিসেবে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। আদার ওয়াইজ, তার কাজ কর্মেতো ন্যায় অন্যায় প্রসঙ্গ চলে আসে আসলে। সে যে অভিনয় করতে পছন্দ করে এটাকেই স্টাব্লিশ করতে চেয়েছি। আর্টিস্ট হিসেবে তাকে ট্রিট করলে তাহলেই কেবল আয়না চরিত্রটি ন্যায় অন্যায়ের উর্দ্ধে থাকে। আমরা এভাবেই তাকে নির্মাণ করতে চেয়েছি।
হ্যাঁ। সমাজ বাস্তবতায় তার চরিত্রটি নিয়েওতো আমরা তর্ক বিতর্ক দেখেছি?
আমার কাছে মনে হয়, আয়না আসলে একজন অ্যাক্টর। অভিনয় হচ্ছে তার প্যাশন। সামহাউ তার আর্থিক অনটনের সময় জেলে ডুকে যায় কোনো ঘটনায়। কোনো এক সময়ে। তারপর যখন আর আর ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হয়, তখন তার ভেতরে অভিনেতার সত্তা জেগে উঠে। সেই পরিবেশটা তার ভাল্ লাগতে শুরু করে। সে কারণে যখন সে ডিটেইলে যায়। একটা মানুষের সাথে কথা হলে তার কথার ধরণ, ভঙ্গি, গেটাপ সব অনুকরণ করা। এখন তার এসমস্ত কাজকে আর্টিস্টের চোখ দিয়ে দেখলে কিন্তু ন্যায় অন্যায় প্রশ্নগুলো আর আসে না। কারণ সেতো আর্টিস্ট! আর এটাতো স্রেফ একটা গল্প।