কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী চিররঞ্জন সরকারের মা গুরুতর অসুস্থ। মায়ের দীর্ঘ জীবন সংগ্রাম, কঠোর পরিশ্রম আর মহানুভবতা নিয়ে স্মৃতিচারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় যেসব ব্যক্তির জীবন নিয়ে আলোচনা হয়, সেসব ব্যক্তিদের চেয়ে তার মায়ের জীবন অনেক বেশি ঘটনাবহুল ও বর্ণাঢ্য হলেও হয়তো কখনো তাকে নিয়ে গণ্যমাধ্যমে কোন আয়োজন হবে না। তবুও নিজের মাকে নিয়ে এই কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী গর্বিত বলে জানিয়েছেন।
‘আমার মা’ শিরোনামে বেদনাহত চিররঞ্জন সরকার তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন: ‘‘আমার মা! রংপুরে আর জি ক্লিনিকে রাত জেগে মায়ের শিয়রে বসে আছি আমি আর আমার ছোট ভাই প্রিয়রঞ্জনের বউ সঞ্চিতা। অন্য ভাই, ভাইবউ ও ভাইঝিরা রাত এগারটায় বিদায় হয়েছে। ওরা সারাদিন মাকে নিয়ে অনেক ছোটাছুটি করেছে। বোদা থেকে ‘প্রায় অচেতন’ মাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে সাড়ে তিনঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে রংপুর এনেছে। ডাক্তার দেখিয়েছে। বিভিন্ন ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। অবশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে রাত এগারটায় বাসায় উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
মার নাকে এখন নল লাগানো। ঘুমের ঘোরেই মা চাচ্ছে হাত দিয়ে নাকের মধ্যে লাগানো নল খুলে ফেলতে। তাই সতর্ক থাকতে হচ্ছে। রাত্রির বিনিদ্র প্রহরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, আর বুকের ভেতরে হাহাকার করে চলেছে। মা যে আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে!
গত ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে বাড়িতে আকস্মিক মাথা ঘুরে পড়ে যান। এরপর স্থানীয় একজন এমবিএস আর ঠাকরগাঁওয়ের একজন প্রসিদ্ধ মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়। তারা এক্সরেসহ প্রাসঙ্গিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন। বয়সজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তারা কিছু ওষুধও দেন। কিন্তু মা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েন। কোনো কিছুই খেতে পারেন না। মাথা তুলতে পারেন না। কথা বলার শক্তিটুকুও নিঃশেষ প্রায়।
এ অবস্থায় আজ অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে রংপুর নিয়ে আসা হয়। আমাদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হরিপদ সরকার তথা হিমেনদার পরামর্শে এখানে একজন নিউরোলজিস্টকে দেখানো হয়। তিনি সিটি স্ক্যান করে নিশ্চিত হন যে মার আসলে ‘ইসকেমিক স্ট্রোক’ হয়েছিল। এবং মাথায় একটু রক্ত জমা হয়েছে (ইসকেমিক স্ট্রোক মেডিক্যাল সায়েন্সের ভাষায়-সেরিব্রাল থ্রোমবোসিস অথবা অ্যামবোলিজম। ইসকেমিক স্ট্রোক মস্তিষ্কে ও রক্তনালির রক্তে জমাট বেঁধে অথবা শরীরের অন্য কোনো স্থান থেকে বিশেষ করে হৃদপিণ্ড থেকে জমাট বাঁধা রক্ত মস্তিষ্কে নিয়ে রক্তনালির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়)।
টানা সাতদিন প্রায় অভুক্ত থাকার পর আজ ডাক্তারের পরামর্শে নাকে নল লাগিয়ে খাওয়ানো তরল খাবার দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে চলছে স্যালাইন।
চিকিৎসকের মতে, আপাতত ইনজেকশনের সাহায্যে ওই জমাট বাঁধা রক্ত অপসারণের চেষ্টা করা হবে। বাকিটুকু সেবা-শুশ্রূষা। আমি আজই দুপুরে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে রাতে রংপুর পৌঁছেছি। মা আমাকে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু তেমন উচ্ছ্বাস নেই। কথাও অস্পষ্ট! মায়ের এই রূপ দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না!
জীবনসংগ্রামে কখনও ‘মাথা নত না করা’ আমার মার এই রূপ দেখে মনটা হুহু করে কেঁদে উঠেছে। কিন্তু আমরা তো অসহায়! রোগাক্রান্ত ক্লিষ্ট মায়ের জন্য কেবল প্রার্থনা করা, মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা আর চিৎকার করে কাঁদা ছাড়া আমরা ভাইবোনেরা আপাতত মায়ের জন্য আর কি-ই বা করতে পারি?
আমার মার কথা ভাবলে সত্যিই বুকের ভেতরটা নিদারুণ কষ্টে ভরে ওঠে। আমরা ১১ জন ভাইবোন। এই ১১ সন্তানকে তিনি কী নিপুণ দক্ষতায় ‘মানুষের মতো মানুষ’ বানানোর চেষ্টা করেছেন! নিজে নিরক্ষর হয়েও সাধ্যমত সবার লেখাপড়ার চেষ্টা করেছেন। জীবনে এমন কোনো বিপদ নেই, যার মুখোমুখী আমার মা হননি। দেখেছেন মৃত্যুর মিছিল। নিজের মা ও শাশুড়ির মৃত্যু, চোখের সামনে অজ্ঞাত ঘাতকের হাতে সন্তান খুন হওয়া, স্ত্রী-সন্তান রেখে আরেক সন্তানের অকাল মৃত্যু, একাধিক নাতি-নাতনীর মৃত্যু, স্বামীর মৃত্যু, বিধবা ছেলের বউকে নিজের পরিবারের একজন করে রেখে দেওয়া, মেয়ের জামাইয়ের অকাল মৃত্যু, প্রতিবন্ধী দুই যমজ নাতনীর জন্ম ও বড় হতে দেখা, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে এক ছেলের দেশান্তরী হওয়া, আরেক মেয়ের দেশান্তর, চরম অভাব, দারিদ্র্য-সব কিছুই তিনি দেখেছেন! সমস্ত প্রতিকূলতা, দুর্যাগ ও শোক সামলেছেন নিজস্ব নিয়মে।
ছোটকাল থেকে দেখেছি মাকে সবার পরে ঘুমাতে। আবার দেখেছি সবার আগে উঠতে। সংসারের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অথচ কখনও অভিযোগ করেননি।
সংসারে চরম টানাটানির মুহূর্তেও দেখেছি নিজে আধ-পেটা খেয়ে অধিকতর দরিদ্র প্রতিবেশীদের গোপনে খাবার বিলিয়ে দিতে। নিজে কখনও কোনো সাধ-আহলাদ করেননি। ভালো একটা কাপড় দিলে পরতে চাননি। অথচ অন্যকে দেওয়ার ব্যাপারে আমার মাকে কখনও কৃপণ হতে দেখিনি। সবচেয়ে ভালোটা অন্যকে বিলিয়ে দেওয়ার মহত্ত্ব আমার মায়ের মত আমি দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি।
সব রকম সংকীর্ণতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ আর স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠেও যে বেঁচে থাকা যায়-সেটা আমি শিখেছি আমার মায়ের কাছ থেকে।
গত প্রায় নব্বই বছরেরও বেশি সময় ধরে মা আমাদের সংসারে বটবৃক্ষ হয়ে আছেন, থেকেছেন। কোনো বই না পড়ে, পুঁথিগত কোনো বিদ্যা ছাড়াও যে মানুষ বৃহৎ ও মহৎ হতে পারে-সেটা আমার মাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
গভীর রাতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, পৃথিবীর মানুষগুলো যদি আমার মায়ের মতো হতো!
প্রত্যেক সন্তানের কাছেই হয়তো তার মা সবচেয়ে সুন্দর ও মহৎ! কিন্তু এই একটি ব্যাপারে আমার একটা আলাদা অহঙ্কার আছে! আমার মায়ের চেয়ে সুন্দর ও মহৎ কোনো ব্যক্তিত্ব আমি আজও দেখিনি!
মাঝে মাঝে বিভিন্ন টেলিভিশনে, গণমাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির জীবনী নিয়ে আলাপ করতে শুনি। আমি জানি, আমার মাকে নিয়ে কখনও কোথাও কোনো আলোচনা বা অনুষ্ঠান বা ফিচার লেখা হবে না! কিন্তু আমি এও জানি, যাদের কথা গণমাধ্যমে আলোচনা হয়, আমার মায়ের মহত্ব, জীবনবোধ ও জীবনসংগ্রাম তার চেয়ে ঢের বেশি আকর্ষণীয়, তাৎপর্যপূর্ণ।
এমন আলোচনা না হলেও বা ক্ষতি কি? আমি তো অন্তত এমন মায়ের সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে বেঁচেছিলাম! হ্যাঁ, নীতি-আদর্শ-মহত্ব নিয়ে বুক উঁচিয়ে!
মা আমার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন কি না জানি না, সুস্থ হলেও কতটা দীর্ঘজীবন পাবেন, তাও জানি না! কিন্তু মাকে নিয়ে আমার অহঙ্কার আর আক্ষেপ কখনও ঘুচবে না! এমন মা কেন আরও আরও অনেক বেশি সুস্থ ও দীর্ঘজীবী হবেন না কেন? কেন?’’