বাংলা ভাষা নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় রিয়্যালিটি শো ‘ইস্পাহানি মির্জাপুর বাংলাবিদ’-এ সেরা বাংলাবিদ হয়েছেন নুসরাত সায়েম।সেরা ছয় প্রতিযোগীর মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট গিয়েছে তারই মাথায়। আজ শনিবার চ্যানেল আই কার্যালয়ে কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি জানালেন বিজয়ী হওয়ার পর নিজের অনুভূতিসহ আরও নানা বিষয়।
বিজয়ী হয়ে কেমন লাগছে?
অনেক ভালো লাগছে। প্রথমত গতকাল কোন দুশ্চিন্তা নিয়ে অংশ নেইনি। যার জন্য মনে হচ্ছে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করতে পেরেছি। বাকি পাঁচ জন যারা অনেক চিন্তা এবং চাপে ছিল বলে তেমন ভালো করতে পারেনি। যদিও তারা অনেক ভালো প্রতিযোগী। আর আমার বাবা-মা আমাকে বলেছিলেন, তখনই তুমি ভালো কিছু করতে পারবে, যখন তুমি চিন্তাহীন ভাবে কোন কিছু করবে। তাই আমি গতকাল থেকেই খুব হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আসলে এই মঞ্চ একবার চলে গেলে আর আসবে না। তাই আমি প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করছিলাম। আনন্দ নিয়ে খেলছিলাম। এত বড় একটা মঞ্চ, এত মানুষ এবং দেশের প্রথম বাংলা নিয়ে রিয়্যালিটি শোর সামনে নিজেকে উপস্থাপন করাটাই অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আর এমন অবস্থায় উপস্থিত বুদ্ধি এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখাটা খুবই দরকার। সবমিলিয়ে খুবই ভালো লাগছে।
ভেবেছিলেন কি বিজয়ী হবেন?
দু-একদিন আগে আমাদের অনুষ্ঠানের পরিচালক তাহের শিপন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমরা। তখন তাঁর রুমে আমাদের তিনটা ক্রেস্ট কাগজ দিয়ে আলমারির উপর মোড়ানো ছিল। সেই রুমে আবৃতিকার মাহিদুল ইসলাম স্যারও বসা ছিলেন। সেদিকে চোখ যেতেই মাহিদুল স্যার বললেন তোমরা চাইলে দেখতে পারো ক্রেস্ট। আর আমি তিনটা থেকে যেটার কাগজ খুললাম সেটা দেখি বিজয়ীর ক্রেস্ট। তখন সবাই বলছিল ও যখন প্রথম তুলেছে তাহলে ওর হাতেই উঠবে হয়তবা। আর আমার একবারের জন্য মনে হচ্ছিল তাহলে কি সৃষ্টিকর্তা এমন কিছু লিখে রেখেছেন। আবার চিন্তা করলাম কাকতালীয়ভাবেও হতে পারে। আর মঞ্চে উঠার আগে মনে হয়েছিল যদি প্রথম হয়েই যাই, ওইসময় আমার অনুভূতি কেমন থাকবে, বা ক্যামেরার সামনে কী বলতে হবে আমাকে। পরে অবশ্য এইসব বাদ দিয়ে খেলাতেই মনোযোগ ছিল।
আপনার কী মনে হয় এক রাতের মধ্যেই সবকিছু পাল্টে গেছে?
হুম। বিজয়ী হওয়ার পর চেনা-অচেনা অনেকেই ছবি তুলতে আসছিল। নিজেকে সবার থেকে একটু আলাদা মনে হচ্ছিল। বলতে গেলে অন্যরকম নুসরাতের জন্ম হয়েছে গতরাতে। আর এতে আমার ওপর সবার আশা ভরসা এবং দায়িত্ববোধ আরও বেড়ে গেল। আমরা এখন চাইলেই ভুল কিছু করতে পারব না। কারণ আমরা যদি ভুল বাংলা বলি তাহলে আমাদের যারা ছোটরা আছে তারা আমাদের কাছ থেকে কী শিখবে আর যারা বড় আছেন তারা বলবেন আমরা কীভাবে বাংলাবিদ হলাম। বাংলা শুধু আমাদের ভাষা না, আমাদের জীবন। আর আমাদের দেশে বাংলিশ নামে যেটা ব্যবহার করা হয় সেটা থেকে আসলে দূরে থাকতে হবে সবার।
নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী কাকে মনে হয়েছিল?
আমার দুশ্চিন্তাই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কারণ যেদিন দুশ্চিন্তা করেছি আমার খারাপ হয়েছিলো। তাই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে।
অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি কী মিস করবেন?
বাংলাবিদ অনুষ্ঠানের পুরো ক্যাম্পকে অনেক মনে পড়বে। গতকালের পর থেকে ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে পড়লেই মনে হচ্ছে কান্না করে দিব আমি। আসলে পড়ালেখা দিয়ে যে এত পরিচিত পাওয়া যায়, তা এই মঞ্চ থেকে বোঝা যায়। আমি চাই এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। আমরা নিজেরা যেভাবে ধন্য হয়েছি অন্যরাও যেন এমন ধন্য হতে পারে।
বিজয়ী পুরস্কার দিয়ে কী করবেন?
কী করব তা এখনও ভাবিনি। আসলে আমি এখনও ঘোরের মধ্যেই আছি। চারদিক থেকে হাততালির আওয়াজ, বাবা-মার হাসোজ্জ্বল মুখ, বিচারকদের প্রত্যাশার যে চিত্রগুলো তা এখনও চোখের সামনে ভাসছে। অনুভূতি এখনও রয়ে গেছে। তবে ইচ্ছে আছে শিক্ষার জন্য কাজ করা। পথ শিশু যারা আছে তাদের জন্য শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চাই।
নিজেকে কী তারকা মনে হচ্ছে?
আগে তারকাদের দেখতে বা ছবি তুলতে চাইলে কাছে যেতে পারতাম না। তখন ভাবতাম একটু দেখা দিলে কী হয়? কিন্তু কালকে যখন বিজয়ী হলাম তখন থেকে অনেকেই ছবি তুলতে চাইছিলো। তবে গার্ডদের কারণে পারেনি তারা। তাদের ভালোবাসায় আজ আমি এখানে, তাই একটু খারাপ লেগেছে। কিন্তু তারপরও খুব ভালো লেগেছে এই ভেবে যে, আমিও মনে হয় খানিকটা তারকাদের পর্যায়ে চলে গেছি। তাই সবাই আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইছে।
বিজয়ীদের নাম ঘোষণার মুহূর্তে কী মনে হচ্ছিল?
আমার মনে হচ্ছিল আমি এক নম্বর বেশি আছি আরিফিন ভাই থেকে। কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। কারণ আরিফিন ভাইও ভালো খেলেছে। তিনি হাসিখুশি দেখলাম। তাই ভেবেছিলাম সমস্যা নেই তিনি প্রথম হলে আমি দ্বিতীয় হব এই আর কী। তারপরও কেনো যেন মনের মধ্যে একবার মনে হয়েছিল হয়তবা আমি বিজয়ী হতে পারি বা হওয়া সম্ভব।
এমন একটা মঞ্চ দিয়ে পরিচিতি পাবেন কখনও ভেবেছিলেন কী?
আসলে আমার আকর্ষণ সবসময় ছিল এমন কিছুতে। আমি সবসময়ই খুবই চাইতাম মানুষ আমাকে চিনুক বা জানুক। একটু অন্যভাবে। তবে কখনও কোনো সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম না। কিন্তু যখন সুযোগ এলো তখন কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। আর মানুষ যেটা চায় সেটা নাকি পূরণ হয়ে যায়। এখন সেটা হয়ে গিয়েছে।
আপনার পরিবেশবিদ হওয়ার ইচ্ছে। আর কোনো ইচ্ছে আছে কী?
আমার তো পরিবেশবিদ হওয়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল বাংলা নিয়ে পড়ার। এমন কথা শুনলে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বাংলা নিয়ে পড়ার কী আছে এমনটা ভাবে তারা। তাই আমি বাংলাবিদের শেষের দিকে যখনে এলাম তখন আমি চেয়েছিলাম বাংলাকে যেন একটা ভালো জায়াগায় দাঁড় করাতে পারি। বাংলা নিয়ে ভালো কিছু করতে পারি। আর ইচ্ছে আছে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হওয়া। বাংলা ভাষা আরও জানা।
নিজেকে নিয়ে পরিকল্পনা কী?
সবজায়গায় বাংলা ভষার চর্চা ছড়িয়ে দিতে চাই। একটা সংগঠন বা যে কোনো মাধ্যমেই হোক সেটা। প্রতি জায়গায় আমরা বাংলাবিদ যারা আছি তাদের সহযোগিতায় একটা গ্রন্থাগার করতে চাই। আমার এলাকা দিয়েই শুরু করার ইচ্ছে। শুদ্ধ বাংলা প্রচারের উদ্দেশ্যে কাজ করব। এক কথায় বাংলা নিয়েই থাকতে চাই।
নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন?
আমার জন্ম ঢাকাতেই। ভিকারুন্নিসা স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ছি। গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। আর ব্যক্তিগত ভাবে আমি খুবই শান্ত। তবে রেগে গেলে অন্য রকম হয়ে যাই। ধৈর্য্য ধরতে জানি। কীভাবে হাসিমুখে সবকিছু করতে হয়, তা জানি। বেশি পড়ালেখা করতে ভালো লাগে না। অল্প পড়ি সারাক্ষণ পড়ি না। তবে একটা কথা না বললেই নয়, আমার দাদুকে আমি খুব বেশি মিস করছি এই দিনে। তিনি ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক। তিনি বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন আমার এই বিজয়ে।
ছবি: ওবায়দুল হক তুহিন