চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমার কাছে নূরজাহান বেগম

ঢাকা শহরে আমাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। কুষ্টিয়া জেলা শহরে জন্ম নিয়েছি, সেখানেই বেড়ে ওঠা। দাদা বাড়ী প্রত্যন্ত গ্রামে। বতর্মানের রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানায়। ছোটবেলায় ঘন ঘন যেতাম। সেখানে আজও বিদ্যুৎ এর আলো পৌঁছেনি। মুসলিম সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের চল অনুযায়ী সে বাড়ীতে ব্রিটিশ আমল থেকে কলকাতা ও ঢাকার অনেক বই পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা আসতো। তার মধ্যে আসতো ‘বেগম’ পত্রিকাও।

পত্রিকার পাঠক ছিলেন আমার বড় চাচীআম্মা উম্মে সালমা শামছুন্নাহার। তিনি লেখালেখিতে বিশেষ অভ্যস্থ না হলেও ভীষণ পড়ুয়া মানুষ। ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বই পড়তে যেয়ে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের ‘সওগাত’ এবং নারীদের জন্য তার অনন্য অবদানের কথা জানতে পাই। ‘বেগম’ সম্পাদক নূরজাহান বেগমের নামের সাথেও পরিচিত হতে থাকি।

আমার বাবা শিক্ষকতা করতেন। লেখালেখিতে ভীষণ আগ্রহ তার। আমাকে নিয়ে আব্বার অনেক স্বপ্ন। কবি সুফিয়া কামালের জীবনের গল্প অসংখ্যবার শুনেছি আব্বার মুখে। বেগম পত্রিকার গল্গ, মেয়েরা কিভাবে বড় লেখক হয় সেসব কথাও। ১৯৯৪ সালে ঢাকা এসেছিলাম বিটিভির এক আবৃত্তি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সেবার আমাদের এক লেখক ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম কবি সুফিয়া কামালের বাসা ‘সাঁঝের মায়া’য়। সেটি জীবনের অনন্য এক স্মৃতি। কিংবদন্তীতুল্য সুফিয়া কামালকে সামনে থেকে দেখলাম। তার সঙ্গে গল্প করলাম। যখন ফিরে গেলাম তখন জীবনকে যেন স্বার্থক মনে হলো। এরপর বসবাসের উদ্দেশ্যে ২০০২ সালে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ঢাকায় এলাম। জীবনকে সুন্দর করে সাজানোর স্বপ্ন নিয়ে। বিশাল ঢাকা। যেদিকে তাকাই বড় বড় মানুষ। বড় মাপের কারো সাথে উপযাচক হয়ে আলাপ পরিচয় খুব একটা আমাকে কখনই টানে না। কারণ একটাই, সালাম বিনিময়ের বাইরে কোনো কথা থাকে না। জানা শোনা কম, প্রয়োজনও কম। তবে তাদের মুখের কথা বা বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে। ২০০৩ সালে কোনো একদিন বিকেলে পল্টন দিয়ে রিক্সায় যাচ্ছি। মাইকে ভেসে আসছে একটি নারীকণ্ঠ। দৃপ্ত ও বলিষ্ঠ উচ্চারণের ভাষণ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনলাম। আমি এতটাই মুগ্ধ হলাম যে,  সিদ্ধান্ত নিলাম নারী অধিকারের এই সংগঠন করবো। পরবর্তিতে জানলাম তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আয়শা খানম। শুরু হলো মহিলা পরিষদের সঙ্গে পথচলা।

২০০৬ সাল থেকে সমালোচনামূলক পত্রিকা ‘ক্রিটিক’ প্রকাশের উদ্যোগ নেই।’ ২০১২ সালে আবার স্বপ্ন দেখলাম নারী বিষয়ক একটা পত্রিকা করার। এই ইচ্ছে ও উদ্যোগগুলোর গভীরে ছোটবেলায় দেখা ‘বেগম’ পত্রিকা আর তার সম্পাদক নূরজাহান বেগম যেন নিরবেই সাহস যুগিয়ে চলছিলেন। টাকা নেই, প্রস্তুতি নেই শুধু সাহসটুকু পুঁজি করে পত্রিকায় হাত দেয়া। আমার বন্ধু ও জীবনসঙ্গী সাংবাদিক আদিত্য শাহীন এই কাজে সিদ্ধহস্ত। তাইতো আমি এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখলাম আমার স্বপ্ন পথে।

মহিলা পরিষদের হোমায়রা খাতুনের মাধ্যমে একদিন নূরজাহান বেগমের সাক্ষাৎকার নেয়ার চিন্তা এলো। হোমায়রা আপাই যোগাযোগসহ সকল ব্যবস্থা করলেন। একদিন গেলাম শরৎগুপ্ত লেন এর সেই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে। গেটে যে লোকটি থাকেন তিনি গেট খুললেও তাৎক্ষণিক বাসায় ঢোকার অনুমতি মিলল না। ‘বড় আপার নিষেধ আছে ওপরে যাওয়া যাবে না। উনার শরীর ভালো না। কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে একটা মেয়ে নেমে এসে বলল। ‘দোতলায় আসুন, আপনাদের ডাকছে’, নানী না খালাম্মা বলল মনে নেই। লম্বা বারান্দা পার করে সরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেলাম। পাশে খোলা ছাদ। ঘরের দরজায় আমি দাঁড়িয়ে। আধো আলো-ছায়ায় আছন্ন ঘর। চিকন একটা খাটে সুন্দর চাদর পাতা। পরিপাটি পোশাকে বসে আছেন নূরজাহান বেগম। মাথার কাছে টেলিফোন। সামনে গোল টেবিল, পাশে সোফা। রুমটা অনেক বড়। তার পেছনে বড় জানালা ও দরজাটা খোলা। সেখান থেকেই কথা শুনতে পেয়ে লোক পাঠিয়েছিলেন, বুঝলাম। আমাদের ভেতরে ডাকলেন। তাকে একপলক দেখেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। একগুচ্ছ ফুল নিয়ে গেছি। তা তাকে দেব, না পায়ে সালাম করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আদর করেই বললেন, এখানেই বসো, পাশে হাত দিয়ে দেখালেন। তিনি যে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তা বুঝলাম তার প্রস্তুতি ও আপ্যায়নে।

বসে আছেন মুখে হাসি নেই কোনো। টেলিফোন বাজে, নিজেই রিসিভ করে কথা বলেন। মেহমান আসছে সে কথা নীচে জানান। একবার তার বড় মেয়েও ফোনে কথা বললেন। কথোপকথনে বোঝা গেল। বাকি কথা আমাদের সঙ্গেই হলো। সবমিলিয়ে ঘণ্টাখানেক নানা বিষয়ে গল্প হলো।

‘বেগম’ পত্রিকা নিয়ে কথা হলো অনেক। আক্ষেপ করলেন দেশ নিয়ে, বেগম-কে নিয়ে। ‘বেগম-এ যারা লিখেছেন তাদের অনেকেই আজ বড় বড় লেখিকা হয়েছেন। তাদের অনেকেই খোঁজ রাখে না। বেগম এর বর্তমান দুর্দিন যাচ্ছে। আমি কোনো অর্থশালী ব্যক্তির কাছে কখনো ‘বেগম’-এর জন্য যাইনি। বেগম ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কোনো রকম ধুঁকে ধুঁকে কয়েকজনের সহযোগিতায় এখনও চলছে।’ বুঝলাম বেগম- কে নিয়ে তার গর্ব যেমন, বুকের মধ্যে কষ্টও কম নয়। তিনি চান তার অনুপস্থিতেও ‘বেগম’ বেঁচে থাক।

নূরজাহান বেগম তার মেয়েদের কথা বললেন। বড় মেয়ে বেগম-এর দায়িত্বে। তিনি বলছিলেন, সে একা কত সময় লড়াই করে পারবে? আয়শা খানম, মকবুলা মতিন, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুনের কথা বললেন। তার দৃঢ় মনোভাব, আদর্শ, দূরদর্শিতা, সুচিন্তিত দর্শন, সত্যবাদি উচ্চারণ, সাহসিকতা আমাকে এতটাই আলোড়িত করছে যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে চলেছি। সব কথা রেকর্ড হচ্ছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে, আমার সাক্ষাৎকারের খেই ধরে রাখার জন্য দু’ একটা প্রশ্ন করছি।

‘বর্তমানে লেখকের সংখ্যা বাড়ছে, পত্রিকার সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু মেয়েদের লেখালেখির ক্ষেত্র সেভাবে সৃষ্টি হচ্ছে না। বেগম মনে করে, লিখতে লিখতে হাত পাকে। অনেক দূর্বল লেখাও ছাপে। পরে দেখা যায় দুর্বল লেখার সেই মেয়েটি অনেক ভালো লিখছে। কিন্তু এ ধরণের পত্রিকা এখন আর কেউ চালাতে রাজী নয়। মেয়েরা রান্না ও ফ্যাশনের প্রতি বেশী ঝুঁকেছে।’

নারী বিষয়ক সাহিত্য পাতায় এমন কি ‘অনন্যা’য় পুরুষের লেখা ছাপে কথা তুলতেই বললেন- অনন্যা তো নামেই মহিলা। ওরা একটা ট্রাডিশনে গেছে যে আমরাও পুরুষের সমান সমান চলছি। কিন্তু মেয়েদেরকে লেখালেখিতে তেমন উৎসাহী করে তোলা যায়নি। সে জন্য মেয়েরা নীচে নেমে গেছে। বেগম ছাড়া কেউ মেয়েদের লেখা সেভাবে প্রকাশ করছে না।

নারী নির্যাতন ও যৌতুক প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম। বললেন, নারী নির্যাতন তো বেড়ে গেছে, এগুলো প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠির চক্রান্ত। যৌতুক এখনও চলছে। অথচ দাঁড়ি টুপিওয়ালারা কোনদিন বলে নাই, এটা ভালো না। এটা হারাম। সাধারণ লোকেরা লেখাপড়া জানেনা, মৌলবী সাহেব যা বলে তা-ই। ওরা আধুনিক ও মানবিক বিষয়গুলো বলে না বরং বলে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দাও।’

নারী আন্দোলন সম্পর্কে তার ছিল একটাই কথা, আন্দোলন করে যাও। গ্রামের মেয়েরা এখনও অবহেলিত। তাদের কথা চিন্তা করো। ওরা তোমাদের টেনে পিছিয়ে নিয়ে যাবে। শিক্ষা দিয়ে জ্ঞান দিয়ে ওদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কঠিন ভাষা ওরা বুঝবে না। তোমরা যারা শিক্ষার সুযোগ পাও, সচেতন হয়েছো যে যেখানে পারো কাজে নেমে যাও। দেখবে যে নারীর অধিকার আমরা নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে পারবো। নারী অধিকার যখন পাবে, যখনই সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার পথ মুক্ত হবে, তখনই দেখবে নতুন নতুন জ্ঞান তোমাদের লেখার মধ্যেও চলে এসেছে। এই জন্যই আমরা নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলন করছি। এটা দ্রুত হওয়া উচিত। আমি মনে করি তোমরা এগিয়ে গেলেই, তোমরা কাজ করে গেলেই ক্ষমতা আপনা আপনিই হাতে চলে আসবে। তোমাদের যা বলার বলে যাও। এটার জন্য আইনের দরকার হবে না। মেয়েরা স্বাধীন হয়ে যাবে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করবে। আমি বিশ্বাস করি এখনও লেখার অনেক শক্তি আছে। সৃজনশীল কাজের ভেতর দিয়েই এই সমাজের মানুষের পরিবর্তন আনা সম্ভব।

নূরজাহান বেগমের সাক্ষাৎকার দিয়ে শুরু হলো আমাদের নারী অধিকার বিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘পারি’র নতুন যাত্রা ।

এরপরও নূরজাহান আপার সাথে দেখা হয়েছে। তার জন্মদিনে শরৎগুপ্ত লেন এর বাসায় গিয়ে কেক মিষ্টি খেয়ে এসেছি। রাবেয়া খাতুনের জন্মদিনে গুলশানের এক রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে দুই মহিয়সীর সঙ্গে কত কথা বলেছি। সুফিয়া কামালের জন্মদিনে তার মুখে সুফিয়া কামালের স্মৃৃতিচারণ শুনেছি। কত কত স্মৃৃতি। মাঝে মাঝেই মনে হতো, যাই আপার সঙ্গে দেখা করি, কিছু কথা শুনে আসি। কিন্তু হয়ে ওঠে না।

গত ২৩ মে ২০১৬ তে এই দৃঢ় চেতা, আত্মবিশ্বাসী দেশপ্রেমিক মানুষটিকে আমরা হারিয়েছি চিরতরে। তার রেখে যাওয়া আদর্শ, বেগম পত্রিকায় তার নিবিষ্ট পাঁচটি যুগের পাতায় পাতায় রচিত হয়ে আছে অজস্র অম্লান স্মৃৃতি। তার চিন্তা আর সাহস ছড়িয়ে গেছে এদেশের হাজার নারীর চেতনায়।

বহু সচেতন বাবা তার মেয়ের মাঝে, বহু সচেতন যুবক তার প্রিয়জনের মাঝে খুঁজে পাক নূরজাহান বেগমের আদর্শের ছিটেফোঁটা। নুরজাহান বেগম বেঁচে থাকুন হাজার বছর। ইতিহাসের পাতায়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)