পরশু সকাল সকাল একটি ফোন এলো। “হ্যালো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলছি। আপনি বিদেশ থেকে এসেছেন, কোন দেশ থেকে”? উত্তর পেয়ে প্রশ্ন, “আচ্ছা আপনার কি জ্বর-কাশি, শ্বাসকষ্ট এমন কোনো সমস্যা আছে? থাইল্যান্ডে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন? কোনো সি-ফুড খেয়েছিলেন কি? আচ্ছা, আপনার শরীরে যদি এসব কোনো উপসর্গ আছে বলে মনে হয় তাহলে স্থানীয় হাসপাতালে যোগাযোগ করবেন, আর আপনাকে যে কার্ড দেওয়া হয়েছে সেখানে জরুরি ফোন নম্বর দেয়া আছে, যোগাযোগ করবেন”। আবারও প্রশ্ন, “বিমানবন্দরে আপনি কি থার্মাল স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন”? থাইল্যান্ড থেকে দেশে আসার ঠিক ১৪ দিনের মাথায় সরকারি এই ফোন আসা।
এইটুকু কেয়ার বা যত্ম করে এই যে ফোন দেয়া, তাতে আমি অভিভূত। বারবার মনে হচ্ছে আমরা দেশ নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা শুনি বা বলি। বাংলাদেশে এখনও করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু সতর্কতা হিসেবে এই যে সরকারের একটি দপ্তর থেকে ফোনে আমার খোঁজখবর নিলো, এটি ভালো একটা প্রস্তুতির ইঙ্গিত।
কয়েক মাস আগে থেকেই টিকিট হাতে ছিলো। বেড়াতে যাবো ব্যাংককে; সঙ্গে একটু চেকআপ। যাবো ১০ ফেব্রুয়ারি, ফিরে আসবো ১৮ তারিখ; মাত্র ১ সপ্তাহের ভিজিট। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই কাছের মানুষজন সতর্ক করছিলেন করোনা ভাইরাস নিয়ে, যার উৎপত্তি চীনের উহানে। সময় এগিয়ে আসার সাথে সাথে মনের কোণে কিছুটা যে উদ্বেগ বাড়ছিলো না, তা বলবো না। তখনও চীন ছাড়া মাত্র হাতে গোণা কয়েকটি দেশে করোনার বিস্তার ঘটেছে। পরিস্থিতি আজকের অবস্থায় যায়নি তখনও।
শঙ্কা আর সব ধরনের সতর্কবার্তা মাথায় নিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে সঙ্গে নিলাম মাস্ক আর স্যানিটাইজার। ব্যাংককে গিয়ে দেখি, প্রচুর বিদেশি মুখে কোনো মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দেখে অনেক সাহস পেলাম। তবে থাইদের অনেকের মধ্যে সচেতনতা দেখলাম বেশি। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে কিছুটা শীত দেখে গেলাম। কিন্তু থাইল্যান্ডে গিয়ে পড়লাম বেশ গরমে। অভ্যস্ততা না থাকায় মাস্ক পড়তে বেশ সমস্যাই হচ্ছিলো। কয়েকদিন খুব কষ্ট করে হলেও পাবলিক প্লেসে নিয়ম মেনে চলেছি। কিন্তু আস্তে আস্তে কিছুটা ঢিলেঢালা হয়ে যায় বিষয়টা।আসার সময় মধ্যরাতে ফ্লাইট। ফ্লাইটে হঠাৎ করেই কেবিন ক্রু-যাত্রীদের দিকে একটি-একটি করে ফরম এগিয়ে দেন। আমার কাছেও আসলো। পড়ে দেখি একপাশে বাংলা আরেক পাশে ইংরেজিতে লেখা ফরমে সুস্থতা সংক্রান্ত তথ্য জানানোর নির্দেশনা। যথারীতি পূরণ করে পাসপোর্টের সঙ্গে রেখে দিলাম। প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে গিয়ে ভাবলাম ওই ফরম চাইবে। কিন্তু না। ইমিগ্রেশন থেকে বের হতেই দেখি লম্বা লাইন। পাশে তাকাতেই চোখে পড়লো বড় মনিটর। সেখানে আমাদের ছবিগুলো কেমন যেন সবুজ সবুজ দেখা গেলো। বুঝলাম ছবি লাল হলেই ঘটতো বিপদ।
তারপর বড় লাইনের মাথায় কোনোমতে গিয়ে দেখি সেখানে ফরমটি জমা নিচ্ছেন দুজন স্বাস্থ্যকর্মী। একটি অংশ ছিঁড়ে ফেরত দিচ্ছেন একজন, আর সঙ্গে দিচ্ছেন একটি স্বাস্থ্যকার্ড। মধ্যরাতে এই দীর্ঘ লাইন ধৈর্য্যে কিছুটা বিচ্যুতি ঘটালেও, পরে আমাদের কেন এই লাইন তা জানার পর স্বস্তি হচ্ছিলো। আমার ধারণা যদি আগে থেকেই জানতে পারতাম যে আমাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে, যাত্রীরা কোনো হট্টগোল করতেন না। এখন যদিও অনেকে উচ্চবাচ্য করছেন, তখন তাও হতো না।
আমরা প্রতিদিন দুপুরের দিকে টেলিভিশনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরার মুখ থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বিষয়ে সর্বশেষ আপডেট জানতে পারছি। তিনি অবশ্য যতটা পারছেন পরিস্থিতির পরিষ্কার ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে, আমাদের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনার বিস্তার ঠেকানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো, কঠোর প্রস্তুতি ও সতর্কতা।
কোভিড নাইন্টিন নামের এই ভাইরাসের যেহেতু কোনো ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়নি আর উপসর্গে ফ্লু-এর সঙ্গে মিল থাকায় সনাক্ত করার ক্ষেত্রে সময় লেগে যায়; তাই এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে না, কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যাবে। তাই কোনো সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার চেয়ে এই রোগের আক্রমণের ভয় কম নয়। ইদানিং ফেইসবুক খুললেই নানা ধরনের সতর্কতামূলক পোস্ট দেখা যায়। এর মধ্যে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ আছে। কেউ লিখছেন গরমে এই ভাইরাস মরে যায়, আবার, কেউ কেউ আইসক্রিম খেতে নিষেধ করছেন। আবার মাস্ক পড়লেই করোনা প্রতিরোধ হবে না এমনও বলা হচ্ছে। এসবে মানুষ নানাভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে।
তবে অবস্থা দিন এমন একটি জায়গায় যাচ্ছে, যখন করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জাতীয় কমিটি গঠন অত্যন্ত প্রয়োজন। তবেই, সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে ভয়াবহ এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচানো যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)