আজ লেখার সময় মনে বড় ভয়। একটি দিন যায় আর ভাবি, পরের দিনটি কেমন হবে? কি এক কোভিড-১৯। যে ভাইরাস মানুষকে মেরে ফেলছে এক নিমিষে। আমরা না হয় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি দেশ কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, চীন, স্পেনসহ আরো কতো রাঘব বোয়াল দেশ, কে বাকি আছে এই ভয়াবহতা থেকে! আমাদের বিজ্ঞজনদের লেখা ও কথা শোনার চেষ্টা করি। তা থেকে অনুধাবন করি ও বাস্তবায়নে কাজ করার চেষ্টা করি। প্রথমে একটু পিছনে ফিরে যেতে চাই।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আসতে শুরু করলো তখন প্রথমদিকে বাংলাদেশ সরকার শক্ত অবস্থানে ছিলো। আমাদের দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাওলানা সাহেবরা রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর জন্য ওয়াজ মাহফিলে কান্না করলেন, মোনাজাতের সাথে আন্দোলনের হুমকি দিলেন। আমিও কুয়াকাটায় হুজুরের ওয়াজ শুনে কেঁদেছি। এর কিছুদিন পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কতো কিছু করলেন। রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করলেন। তখন বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন থেকে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলেন এবং মানবতা কী তা বুঝিয়ে দিলেন। কিছুদিন রোহিঙ্গাদের বরণ করার পরিণতি যখন আমরা টের পেতে শুরু করলাম, তখন আমাদের সেই মানুষেরাই যারা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার দাবিতে মায়াকান্না করেছিলেন, তারাই রাস্তাঘাটে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে একটি গালি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। ওই হুজুরগণ এখন ওয়াজের মধ্যেও ‘রোহিঙ্গা’ বলে গালি দিচ্ছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘নোবেল পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এগুলো করেছেন।’ আমি মেনে নিলাম নোবেল পাওয়ার জন্যই এগুলো করেছেন। আমার প্রশ্ন, বিএনপি কেনো সেদিন ওখানে গিয়েছিলো? কোন নোবেল প্রাইজের আশায়?
আসুন, একটু ফিরে দেখি কোটাবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহে। কতশত কথা শুনেছি সেদিন। সেদিন কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে মানুষ খুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ। দেশের স্বাধীনতা এনে দেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপমানকর গালি বর্ষণ। সেখান থেকে সরকার পতনের আন্দোলনের স্বপ্নের বীজ বপন।
আসুন, এবার মনে করে দেখি তার কিছুদিন পরের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা। কোমলমতি কোমলমতি করে আমাদের ছেলেমেয়েদের বলতে শুনেছি, ‘পুলিশ কোন চ্যাটের বাল’। শুনেছি সরকার বাচ্চাদেরকে মেরে আটকে রেখেছে। ওদের ভালো কাজকে বাহবা দিয়েছি। কেঁদেছি, সরকারকে গালি দিয়েছি আর ওদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে বাহবা দিয়েছি। কিন্তু আমার সরাসরি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি- মাস তিনেক আগে পাশেই ফুটওভার ব্রিজ থাকতেও রাস্তার মাঝখান দিয়ে সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর ব্যস্ততম রাস্তা পার হচ্ছিলেন এক মা। আমি মোটরসাইকেল আরোহী তখন। মা-মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে আমার যখন পঙ্গু হওয়ার উপক্রম। টানা দুই মাস বিছানায় পড়ে থাকলাম। এখন মানুষের এই বিবেক, সচেতনতা আর মনুষ্যত্ব ফেরানোর জন্য কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবো?
এবার আসুন, কভিড-১৯ নিয়ে কতটুকু দায়িত্ব আমরা নিজেরা পালন করেছি, আমরা সরকার তথা রাষ্ট্রকে কতটুকু দিয়েছি। শুরু হয়েছে চীন থেকে। আমার মনে পড়ে, একদিন আমার এক বন্ধু ফোন করলো- মাস্ক লাগবে এক লাখ পিস। তখন আনন্দে লাফাচ্ছিলাম- চাইনিজরা বহু টাকা নিয়েছে আমাদের সাথে ব্যবসা করে, এইবার একটা মুনাফা ওদের থেকে আমাদের করে নিতেই হবে। বহু নিয়েছো, এইবার একটু দাও। সেখানে কিন্তু মানবতার কোনো ব্যাপার ছিল না, ছিল মানুষের বিপদকে পুঁজি করে ব্যবসার ধান্ধা। আমরা মানসিক রোগী, আমাদের মনের চিকিৎসা করানো আগে দরকার। জীবনের বিপর্যয়ে কীভাবে আরো কাবু করে ফেলে মুনাফা অর্জনের লোভের আগুনে ঝাঁপাতে হয়, এই হলো আমাদের মানসিকতা। অন্য দেশের বিমানবন্দরগুলোতে আমরা সুড়সুড় করে দাঁড়িয়ে থেকে ভদ্রভাবে নিয়ম মেনে চলে আসি। নিজেদের দেশে এসেই যতো বিশৃঙ্খলা করতে ভালোবাসি।
সরকার খারাপ- এ আর নতুন কী? সরকার ইচ্ছে করলে আপনাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে নয় শুধু, জোর করে সব মানতে বাধ্য করতে পারত। শুধু আপনার রেমিটেন্স আমাকে যে কৃতজ্ঞ বানিয়ে রেখেছে! শুরুতে মানুষ বললো, প্রবাসীদের বিদেশ ফেলে রাখা হবে অমানবিকতা, যেই সরকার মানবিকতা দেখিয়ে আপনাদের ফিরিয়ে আনলো, আপনারা সুযোগের অপব্যবহার করলেন। আপনারা সামাজিক দূরত্বের বিধি না মেনে ইচ্ছেমতো জনসমাগমে মিশে গেলেন। এখন সেই মানুষেরাই যারা আপনাদের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তারাই আপনাদের তো গালি দিচ্ছেই, সাথে সাথে আপনাদের দেশে ঢুকতে দেওয়ার ‘অপরাধে’ সরকারকেও গালি দিচ্ছে। অথচ আপনারা একটিবারও ভাবেননি, আপনি সমাজকে তো বটেই, এমনকি আপনার মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তানদের বিপদে ফেলছেন। কীসের আপনারা দেশকে ভালোবাসছেন? আপনাদের মনুষ্যত্ববোধ নষ্ট, মৃত।
আসুন, একটু দেখি কী কী হয়েছে এই ক’দিনে। আপনি বিদেশ থেকে ফিরে হরহামেশাই ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিয়ে করতে গেছেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছেন, পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। সরকার লকডাউন করলো কিন্তু আপনি কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে বাইরে বের হলেন, আড্ডা দিলেন। এসব আড্ডাবাজদের পুলিশ পিটাচ্ছে, সেই পিটুনি বেঠিক হচ্ছে বলে অনেক জ্ঞানী বুলি ফুটিয়েছেন। হয়তো সবক্ষেত্রে পুলিশের আচরণ ঠিক ছিল না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু আপনিও বা কোন দায়িত্বশীল নাগরিক যে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে এখনো আড্ডাবাজি করতে চান?
সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনেক ভুল আছে সত্য, থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা ভালো কিছু খুব সহজে হারাই। এই জাতি ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে আবার এই জাতিই জাতির পিতাকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধও করেছে। এই জাতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আজ মডেল হয়েছে। তাই তারা করোনায় মৃত্যুকে ভয় করছে না। কিন্তু পুলিশের পিটানোকে ঠিকই ভয় পায়। ধর্মের দোহাই দিয়ে করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ না খুঁজে এ জাতির নিজে সুরক্ষিত থেকে অন্যকে সুরক্ষিত রেখে করোনাকে জয় করার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।