বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের নির্বাচক হিসেবে এমন একটা সময়ে দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন দেশে করোনার ব্যাপক বিস্তার। শক্তিশালী জাতীয় দল গঠনে যে পরিকল্পনা ছিল, তার অনেকটাই ভেস্তে গেছে মহামারীর হানায়। যদিও বিকল্প ফর্মুলায় হেঁটে মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু করে গেছেন নিজের কাজ। আসন্ন ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের জন্য ২০ সদস্যের প্রাথমিক দল চূড়ান্ত করেছেন।
মহামারীর কঠিন সময়ে ধাপে ধাপে ক্যাম্প আয়োজনের মাধ্যমে ক্রিকেটারদের পথে রাখার চেষ্টা করেছে বিসিবি। অবশ্য আয়োজন করা সম্ভব হয়নি আন্তর্জাতিক সিরিজ। খেলা না থাকায় বাড়তি চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে নির্বাচক ও ম্যানেজার মঞ্জুরুলকে।
বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম উইকেট শিকারি মঞ্জুরুল চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন লাল-সবুজের নারী ক্রিকেটের পাইপলাইন নিয়ে। শুনিয়েছেন আশার কথাই।
প্রায় একবছর হল নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়নি। খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন কিংবা দল গঠন করা নিশ্চয়ই খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল?
মঞ্জুরুল: আসলে প্রতিটি কাজেই চ্যালেঞ্জ থাকবে। এই সময়টায় অনেককিছুই হওয়ার কথা ছিল- বিদেশ সফর, হোম সিরিজ, ঘরোয়া লিগ। কোভিডের কারণে হয়নি। ক্যালেন্ডার ধরে আগাতে পারিনি। লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ভিন্ন পরিকল্পনায় আগাতে হয়েছে। ক্যাম্পে মেয়েরা নিজেদের মাঝে প্রচুর ম্যাচ খেলেছে। যা খুব কাজে দিয়েছে। প্রায় একমাসের ক্যাম্প আমরা বিকেএসপিতে শেষ করলাম। মঙ্গলবার থেকে মিরপুরে ক্যাম্প, তারপর সিলেটে। ঢাকায় ফিরে মিরপুরে আরেকটি ক্যাম্প করে দল যাবে জিম্বাবুয়েতে কোয়ালিফাইং খেলতে। তার আগে স্বাগতিকদের সঙ্গে একটি ওয়ানডে সিরিজও হয়ত খেলব। খুব ভালো শেপে আছে আমাদের দল। বাছাইপর্ব উতরে ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।
বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়া কাপ জিতেছে। সম্ভাবনাময় দল হিসেবে মূল্যায়িত হয়। পাইপলাইন দেখে সত্যিকার অর্থে আপনি কেমন সম্ভাবনা দেখছেন?
মঞ্জুরুল: টিম করতে যেন অনেক কষ্ট করতে হয়। একটা পজিশনের জন্য তিনজন থেকে চারজন থাকা উচিত। যে খেলোয়াড় ওখানে জায়গা পাবে তাকে যেন প্রতিযোগিতা করে আসতে হয়। পেছনে তিন-চারজন বিকল্প খেলোয়াড় থাকলে কোনো ব্যাটারের ৩০-৪০ রান ৭০-৮০ হয়ে যাবে। যদি ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলার মতো কেউ থাকে।
আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর ৩১ জন খেলোয়াড় নিয়ে ক্যাম্প শুরু করেছিলাম। ১৩-১৪টি অনুশীলন ম্যাচ খেলেছি। খুব ভালো পারফর্ম করেছে সবাই। সিরিজ বাতিল হওয়ায় প্ল্যান ‘বি’ ধরে এগিয়েছি। চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রস্তুতি ম্যাচে অনেকে ৫ উইকেট পেয়েছে, সেঞ্চুরি হয়েছে, ফিফটি হয়েছে, অসাধারণ কিছু রান আউট হয়েছে, অসাধারণ ক্যাচ হয়েছে। অনুশীলন ক্যাম্পে পার্টিকুলার ডে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেখান যা আদায় করার মেয়েরা করেছে। বিসিবি থেকে যখন যেভাবে চেয়েছি বলেছে ‘গো অ্যাহেড’। শুরুর ক্যাম্প থেকে ১৫ জনের দল দিতে পারিনি। ২২ জন করতে হয়েছে। তখন ক্রিকেট বোর্ডকে বলেছি, ২২ জনকেই রাখা হয়েছে দলে। পেছনে বিকল্প খেলোয়াড় তৈরি থাকলে পারফর্ম করার তাগিদ থাকে। এটাই বেস্ট ওয়ে। চ্যালেঞ্জ ছাড়া উন্নতির সুযোগ নেই।
করোনা-বিপর্যয়ের মাঝেও এপর্যন্ত বাংলাদেশের প্রস্তুতি কেমন হল?
মঞ্জুরুল: আমরা সাউথ আফ্রিকা ইমার্জিং দলের সঙ্গে চারটা ওয়ানডে খেলেছি। সবকটিতেই ভালো ব্যবধান রেখে জিতেছি। ওদের দলেও জাতীয় দলের সাতজন খেলোয়াড় ছিল। আমাদের দলে যদিও আরও বেশি ছিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো হয়েছে। নতুনদেরও সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তারা ভালো করেছে। তার আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমসে নিজেদের মধ্যে তিনটি দল করে খেলা হয়েছে। ওখান থেকে কিছু নতুন প্রতিভা উঠে এসেছে। যাদের কয়েকজনকে সুযোগ দিচ্ছি জাতীয় দলে। বিকেএসপিতে প্রায় একমাসের ক্যাম্প শেষ করলাম। জাতীয় দল, ইমার্জিং দল, অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-১৭ দল নিয়ে একটা টুর্নামেন্ট হয়েছে। মোট ৬০ জন খেলোয়াড় অংশ নিয়েছিল। সামনেই প্রাথমিক দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে ক্যাম্প রয়েছে।
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট নিয়ে আপনার লক্ষ্য কী?
মঞ্জুরুল: জাতীয় দলের একটি ভালো সেটআপ, ইমার্জিং দলের সেটআপ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ভালো সেটআপ তৈরি করা আমার লক্ষ্য। এই তিনটি দলকে যদি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আর ভাবতে হবে না। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলও আমরা ঠিক করে ফেলেছিলাম। বিশ্বকাপ পিছিয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিপাকে পড়েছি। বিশ্বকাপ আসতে আসতে তাদের অনেকেরই বয়স পেরিয়ে যাবে। সেজন্য আমরা অনূর্ধ্ব-১৭ দল তৈরির কাজ করছি। দেশব্যাপী ট্যালেন্ট হান্টের প্রাথমিক কাজ শেষ হলেও করোনার কারণে ক্যাম্প শুরু করতে পারিনি।
বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটের কী ভবিষ্যৎ দেখেন?
মঞ্জুরুল: ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কোচ হিসেবে এসিসিতে (এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল) কাজের সুবাদে চায়না, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলবো, আমাদের বিশ্বমানের কিছু খেলোয়াড় রয়েছে। সালমা খাতুন, আমার দেখা সেরা স্পিনার। নিগার সুলতানা বিশ্বমানের ব্যাটার। সাউথ আফ্রিকা মেয়েদের বিপক্ষে চার ম্যাচে দুটি সেঞ্চুরি করেছে, বিশ্বমানের খেলোয়াড়। রুমানা আহমেদ দুর্দান্ত একজন অলরাউন্ডার। আরও অনেকের নামই বলা যায়। অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে দুটি মেয়ে জায়গা পেয়েছে। তারা অসাধারণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগাতে পারলে এই দল অনেক দূর যেতে পারবে।
বাংলাদেশের মেয়েদের টেস্ট খেলতে নামতে কতদিন লাগতে পারে?
মঞ্জুরুল: একটি উদাহরণ দেই, শ্রীলঙ্কা ১৯৯৯ সালে টেস্ট শুরু করে গত ২২ বছরে আর খেলেনি। আমরা তাই আরেকটু সময় নেবো। লংগার ভার্সনে নাম লিখিয়ে যেন আবার পেছনে ফিরে যেতে না হয়। আমরা টেকসই পদ্ধতিতে আগাতে চাই। শুরু যেন শুধুই শুরুর জন্য না হয়। যখন শুরু করব, যেন ধারাবাহিকতা থাকে। বাংলাদেশের মেয়েরা ভালো ক্রিকেট খেলছে। যখনই টেস্ট খেলি পারফরম্যান্স যেন ভালো হয়। সেটি নিশ্চিত করেই আমরা নামব।