আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন শিশুতোষ বই হাতের নাগালে খুব কমই পেতাম। জন্মদিন বা উৎসবে কিছুসংখ্যক পরিবার ছাড়া অধিকাংশ পরিবারে খেলনা পোশাক উপহার দেয়ার চল ছিল। তবে দিন পাল্টেছে। এখন খালা, মামা, চাচা, ফুপুরা জন্মদিনে বাচ্চাদের অন্যান্য উপহারের সঙ্গে বইও উপহার দেন। এমনকি ঈদেও বাচ্চাদের বই দেয়ার রেওয়াজ চলে এসেছে। এর কারণ এখনকার বাবা-মায়েরা ছেলে মেয়েদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশিই কাপড়-চোপড় কিনেন বা কিনতে পারেন। তাই বাচ্চাদের আর ড্রেস দিয়ে খুশি করা যায় না, যতটা না গল্পের বই বা চকোলেট খেলনা দিয়ে খুশি করা যায়।
এখন শিশুরা বাবা-মায়ের হাত ধরে বই মেলায় যায় এবং বই কেনে। দেখে খুব ভালো লাগে। আহা আমাদের ছোটবেলায় যদি এমন বই মেলা পেতাম! তবে এখনকার ছেলে-মেয়েদের পড়ার বিষয় পাল্টে গেছে। তারা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বেশি ভালোবাসে, ভালোবাসে কৌতুক, রহস্য উপন্যাস। এগুলোতে তাদের আগ্রহ যতটা বেড়েছে ঠিক ততটাই আগ্রহ কমেছে জীবনভিত্তিক গল্প-উপন্যাসের প্রতি।
এর প্রধান কারণ শুরুর দিকে বই বাছাই। একজন বাচ্চা কী বই পড়বে বা এখন তার কোন বইগুলো পড়া উচিত সেটা তার পারিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ঠিক করে দেয়। পরিবারকে খেয়াল রাখতে হবে তার শিশু কোন বইগুলো পড়ছে বা বেশি পছন্দ করছে। ছোটবেলা থেকেই যদি শিশুকে সব ধরনের বই এর প্রতিই আগ্রহী করে তোলা যায়, বইগুলো বেছে নিয়ে তার সামনে দেয়া যায়, একটা সময় সে নিজেই বুঝে নেয় যে সে কোন বইগুলো পড়বে। কারণ একটি শিশু যখন পড়া শিখে যায় সে সামনে যা পাবে তাই পড়বে এবং এটাই স্বাভাবিক। সে সময় তাই পরিবারকে ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
একটা উদাহরণ দিয়ে বলি যা জীবন থেকে শেখা। আমার জীবনের প্রথম গল্পের বই পড়া শুরু হয় নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ উপন্যাস দিয়ে। হাতের নাগালে বইটি পেয়েছিলাম কারণ আম্মা-আব্বা তখন প্রচুর নিমাই, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এর বই পড়তেন এবং কাকুর কল্যাণে পরে সেবা
প্রকাশনীর মাসুদ রানাও পড়া হয়েছে বেশ কিছু। তবে সবই চোখের আড়ালে চুপি চুপি। তখন খুব বেশি হলে ক্লাস ফোরে পড়ি। আব্বা বই পড়ার আগ্রহ দেখে তার স্কুলের লাইব্রেরি থেকে কিছু বই এনে দিয়েছিলেন। সবগুলোর নাম মনে পড়ছে না, তবে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ‘ছয়টি রূপকথার গল্প’, নাসিরউদ্দিন হোজ্জার ‘ভিনদেশি এক বীরবল’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘আম আঁটির ভেঁপু’, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ – আরও কিছু বই পেয়েছিলাম, পড়েছিও। তারপর আর বইয়ের জন্য সমস্যা হয়নি। ক্লাস সিক্সে উঠে ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ স্কুলে এসে হাজির।
এছাড়া অনেকগুলো খালাতো, মামাতো ভাইবোনের মধ্যে বড় হওয়ার সুবাদে তাদের কাছ থেকেই বেশিরভাগ বইয়ের যোগান পেয়েছি। এভাবে বই পড়ার অভ্যাস শিশু তার পরিবার এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে পেয়ে থাকে। শিশুরা নরম কাদামাটির মত। তাদের শিক্ষায় আচরণে আমরা
যে আদল দেবো সে সেভাবেই গড়ে উঠবে। নিজের দেশের সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতিকে জানতে হলে চিনতে হলে বুঝতে হলে বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।
একটা সময় আমরা প্রচুর হুমায়ুন আহমেদ পড়েছি, ইমদাদুল হক মিলনের বই পড়েছি। তাই বলে অন্য কোন লেখকের ভালো উপন্যাস বা লেখার প্রতি আগ্রহ কম ছিল না। কারণ আমরা একই সাথে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বেগম রোকেয়া, জীবনানন্দ দাস, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বয়স অনুযায়ী আমাদের এসব বইয়ের যোগান দিয়েছিল তখন।
পড়ে পড়েই আমাদের সময়, ইতিহাস, রাজনীতি এমনকি নিজ দেশের ভূপ্রকৃতিটাকেও জানতে হবে, জানা দরকার। সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন, জাফর ইকবাল, আনিসুল হক সবার লেখাই পড়তে হবে। কিন্তু নিজের এবং আশেপাশে ছেলেমেয়েদের আজকাল দেখি তারা একজন লেখকের বই পড়ে ভালো লাগলে শুধু সেই লেখকের লেখাই পড়তে থাকে। শিশুদের মধ্যে একই ধরনের বই পড়ার আগ্রহ জন্মায় দু’টি কারণে: ১. যে ধরনের বই তারা পড়তে পছন্দ
করছে সেই প্রায় একই ধরনের গল্প একই লেখক প্রতি বছর তাদের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন।
২. বাবা-মায়েরা বাচ্চারা বই পড়তে ভালোবাসছে এই খুশিতে তাদের সেই সব বই লিস্ট ধরে কিনে দিচ্ছেন। ঠিক এই জায়গাটাতেই আশঙ্কা বোধ করছি। ছেলেমেয়েদেরকে অবশ্যই তার পছন্দের বই কিনে দিতে হবে। তবে সে যেন সব ধরনের বইয়ের পাঠক হয়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারে বাবা-মা অথবা যারা বই উপহার দিচ্ছেন তাদেরই সচেতন হয়ে দায়িত্ব নিতে হবে।
এখন বাচ্চারা প্রচুর পড়ে বলেই ধারণা। আমাদের সময়ের মত বই পড়া নিয়ে লুকোচুরি নেই। লাইব্রেরিতেও যেতে হয় না (এটা কতটা ভালো সেটা ভাবতে হবে), বাবামায়েরাই প্রচুর বই কিনে দিচ্ছেন সন্তানদের। এটা দেখে যতটা খুশি হই ভালো লাগে ঠিক ততটাই শঙ্কিত হই। এবারের বই মেলায়ও দেখেছি ছেলেমেয়ে তার পছন্দের লেখক ছাড়া আর কোন লেখকের বই ছুঁয়েও দেখতে চায় না। এক দুইজন লেখকের বইয়ের তালিকা করে নিয়ে আসছে, স্টল ঘুরে সে ক’টি বই কিনে বাড়ি ফিরছে। পাশেই অন্য কোন লেখকের বই উল্টে পাল্টে দেখছে না পর্যন্ত।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলি। আমার মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই তার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। আমরাও তাকে ভালো লেখকের বই সংগ্রহ করে দিয়েছি। এতদিন ঠিকই চলছিল। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সে শুধুমাত্র সায়েন্স ফিকশন ছাড়া আর কিছু পড়তে ভালোবাসছে না। আমি অবাক হলাম। আমার অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল যখন আমি তার সমবয়সীদের মধ্যে একটা ছোটখাট জরিপ করলাম। দেখলাম এরা প্রায় সবাই এই দু’একজন লেখকের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছু পছন্দ করছে না। বাবা-মা অনেকটা বাধ্য হয়েই এই বইগুলো তাদের সংগ্রহ করে দিচ্ছেন।
আমি বলছি না সায়েন্স ফিকশনের বই বাচ্চারা পড়বে না। তবে জীবনমুখী বইগুলোও বাচ্চাদের
পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। সত্যিকারের মানুষ হয়ে বড় হতে সব ধরনের বই পড়তে হবে। জীবন না বুঝে শুধু কল্পকাহিনী পড়ে কি মানুষ ও জীবন বুঝতে পারবে! শুধু তাই নয়, এখন বাচ্চারা অধিকাংশই চার দেয়ালের মধ্যে বড় হচ্ছে। খেলার মাঠ নেই, থাকলেও নিরাপত্তা নেই। তাই মফস্বলেও ঘরবন্দী জীবন। সেই শিশু মন যদি শুধু বিজ্ঞান এবং কল্পকাহিনীতেই দুপুর, বিকেলগুলো পার করে দেয়, তবে তাদের মনোজগৎ ফাঁকাই থেকে যাবে। জীবনের সুখ, দুঃখ আনন্দ, বেদনা সম্পর্কে তাদের ধারণা সীমিত হয়ে পড়বে বা পড়ছে। জীবনকে জানতে হলে, বুঝতে হলে জীবনমুখী বই পড়তে হবে। বই কেবল একজন পাঠককে আনন্দই দেয় না তাকে বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
এখন শিশু-কিশোরদেন মন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পড়ছে। জীবন এখন ডিজিটাল হওয়ায় নানা ধরণের মুভি এবং গেমে শিশুরা আসক্ত হয়ে বাস্তবে তার মারাত্মক প্রতিফলন ঘটাচ্ছে, যার ক্ষতি অপূরণীয়। শিশুদের মনোজগৎ নিয়ে বেশি করে ভাবা এখন সময়ের দাবি। নয়তো সেদিন বেশি দূরে নয় এই কল্পনার জগতে বিচরণ করা শিশুরা মাকে প্রশ্ন করে বসবে, মা চাল কোন পাউডার দিয়ে বানানো হয়? যারা বোতলে ফলের রস খায় তাতের পক্ষে কোনটা কোন ফলের ছবি না দেখে বলতে পারা কঠিন।
খুব ভালো যে শিশুরা বই পড়ে। তবে শুধু কল্পবিজ্ঞান পড়ে তারা যেন কল্পনাবিলাসী না হয়ে পড়ে সেজন্য বই বাছাইয়ে মা-বাবা-বড়দের ভূমিকা অনেক। সন্তান প্রচুর বই পড়ছে শুধু এটা ভেবে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে কী পড়ছে সেটাও চলুন খেয়াল করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)