বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনকে যারা বেগবান করেছেন এবং একইসঙ্গে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের যাত্রা যাদের জন্য মসৃণ হয়েছে তারমধ্যে নির্মাতা মানজারে হাসীন মুরাদ অন্যতম। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। তার নির্মিত আমাদের ছেলেরা ও রোকেয়া প্রামাণ্যচিত্র দুটি বেশ প্রশংসিত। গেল বছরে তিনি নির্মাণ শেষ করেছেন ‘এখনো ‘৭১’ নামের আরো একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই প্রামাণ্যচিত্রটিও ইতিমধ্যে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। ২৪ মার্চ এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির তিনটি প্রদর্শন হচ্ছে ছায়ানট মিলনায়তনে(দুপুর তিনটা, বিকাল পাঁচটা ও রাত ৯টায়)। চলচ্চিত্র সমালোচক ও গুণী এই নির্মাতা এবার মুখোমুখি চ্যানেল আই অনলাইনের। তাঁর সঙ্গে চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন জুয়েইরিযাহ মউ:
‘এখনো ‘৭১’ নিয়েই কথা শুরু করি, এই চলচ্চিত্রের কাজ আপনি কবে থেকে শুরু করেছিলেন?
গতবছর কাজটা শেষ হল। শুরু করেছিলাম তিন বছর আগে, ২০১৩ থেকে শুরু হয়েছিল।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে যেটা প্রায়ই হয় দীর্ঘ সময় ধরে নির্মাণকাল হওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথমে যা ভেবে যেভাবে পরিকল্পনা করে শুরু করা হয়, শেষ পর্যন্ত অনেক পরিবর্তন ঘটে ভাবনায়-পরিকল্পনায় এমনকি ফর্মেও। এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সেই যাত্রা কেমন ছিল?
আসলে যেটা হয়েছে এটা তো একটা মাল্টি কান্ট্রি প্রোজেক্টের আন্ডারে করা হয়েছে। কেনেডিয়ান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওরা একটা অনুদান দিয়েছিল দিল্লী বেসড একটা কমিউনিকেশন অর্গানাইজেশনকে। তারা সাউথ এশিয়ার পাঁচটা দেশে পাঁচটা ছবি করে। তার মধ্যে এ চলচ্চিত্র একটি। আর এটার একটা জেনারেল থিম ছিল ‘কনফ্লিক্ট এন্ড জাসটিস’। আমি প্রথমে এটা করতে চেয়েছিলাম ফুলবাড়িয়ায় যে ওপেন পিট মাইনের কথা হচ্ছে সেখানে যে ডিসপ্লেসমেন্ট হবে সেটার উপর। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন গণজাগরণ মঞ্চ হল তখন আমার মনে হল এই যে একটা সামাজিক আন্দোলন যেটা ৯০ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শুরু করেছিলেন যেহেতু রাষ্ট্র এতো বড় অপরাধকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। তখন মনে হল যে থিমটার সাথে এই আন্দোলন মিলে যায়। আমার মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল একটা সামাজিক আন্দোলন যেটা কোন পার্টিজান থেকে নয় তা কী করে বড় বড় রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোতেও সাধারণ মানুষের ভয়েসকে নিয়ে আসতে পারে এবং সেটাকে পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারে। যেহেতু এটা একটা বহমান আন্দোলন, আমি জানতাম না পরবর্তী দিন কি হবে। সুতরাং এটা একটা ওপেন এন্ডেড প্রোজেক্টই ছিল, যে যাই ঘটুক চলচ্চিত্রের থিম মাথায় রেখে যতটা গ্রহণ করা যায় তা করতে হবে। তাই শুটিং পর্যায়ে পরিবর্তন তো ঘটেছেই, এমনকি সম্পাদনার পর্যায়েও পরিবর্তন ঘটেছে। তাই পরিবর্তন হবে পরিকল্পনায় এ চিন্তা মাথায় রেখেই এগোতে হয়েছে।
এ চলচ্চিত্রে এমন অনেক ফুটেজ আছে যা গণজাগরণ মঞ্চের বা আন্দোলনকালীন সময়ের এমন চিত্র তুলে ধরে যা হয়তো অনেক নিউজে/টিভি চ্যানেলেও তেমনভাবে দেখা যায়নি। তো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের এই যে অ্যাভিডেন্স হয়ে উঠার বিষয় এ ব্যাপারে কী মনে হয় আপনার?
এটা তো শুরু থেকেই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের একটা বিশেষ ভূমিকা, একেবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জের সিংহাসন আরোহন থেকে শুরু করে ১ম বা ২য় মহাযুদ্ধ, অক্টোবর বিপ্লব সবখানেই এ কাজ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র করেছে। সুতরাং সেদিক থেকে এ আন্দোলনকে যদি বলা হয় জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন তাহলে তার কিছু দলীলিকরণ তো হয়েছেই এ চলচ্চিত্রে। তবে কতটা হয়েছে তা পরবর্তীকালেই বিচার করা যাবে হয়তো। কিন্তু দলীলিকরণ না করা হলে তো যে বক্তব্য আমি তুলে ধরতে চাইছিলাম তা আনা সম্ভব হত না। তাই সেদিক থেকে আমি চেষ্টা করেছি, শুধু আমার না, অন্যদের ফুটেজও আমি ব্যবহার করেছি। অনেকের সহায়তা এখানে আছে। একটা সামাজিক আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপের দলীলিকরণের চেষ্টা এটাকে বলা যেতে পারে।
এখনো ‘৭১- এই শিরোনাম কখন নির্বাচন করেন? শুরু থেকেই কি ভেবেছিলেন শিরোনামটা?
প্রথম থেকে শিরোনামটা মাথায় ছিল না। ইন ফেক্ট এ চলচ্চিত্রে একটা কবিতা আছে ‘এখনো ৭১’ নামে। কেন ২০১৩ সালে এসে এ ধরণের একটা আন্দোলন আবার ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ অর্জন করলো। সেখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনঃউত্থাপন। যেহেতু কবিতাটা আমার চলচ্চিত্রের মূল বক্তব্যের সাথে মিলে গেল, আমরাও ছবিতে সেটাই তো বলতে চাইছি যে একাত্তরের চেতনা আগেও বহমান ছিল, এখনো বহমান এবং ভবিষ্যতেও বহমান থাকবে। একাত্তরকে ফিরে দেখার চেষ্টা বর্তমানকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্যই প্রয়োজন, এটা শুধুমাত্র অতীত অন্বেষণ নয়। তাই এ কবিতার বক্তব্যের সাথে চলচ্চিত্রের বক্তব্য মিলে যাওয়াতে শিরোনাম ঐ কবিতা থেকেই নেওয়া, নিজে থেকে তৈরি করিনি।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে ‘সত্য’ ঘটনাকে অবলম্বন করে অভিনয়ের/ফিকশনের জায়গা তৈরি করা, এটা অনেকেই করেছেন, করছেন। একটা কারণ হতে পারে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার একটা চিন্তা মাথায় থাকে নির্মাতার বা নির্মাতার পছন্দসই স্টাইলও হতে পারে। তো এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা পছন্দ করি না। কারণ যে কথা বললে যে এটা সত্যি বেশিরভাগ দর্শক কাহিনিচিত্র দেখতে বেশি পছন্দ করে তাই এটা কিছুটা যুক্ত করলে হয়তো দর্শকের সংখ্যা বাড়লো। কিন্তু এটার নেতিবাচক দিকও আছে। নেতিবাচক দিক হল, প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের শক্তি হল এটা বাস্তবতা ধারণ করে এবং তার যথোপযুক্ত পুনঃউপস্থাপন করে। এ শক্তিকে খাটো করে দেখার কিছু নাই। আর যে পুনঃনির্মাণের কথা আমরা বলছি, এ পুনঃনির্মাণ যথোপযুক্তভাবে না করতে পারলে কিন্তু সেই ইমপেক্টটা তৈরি করে না। এই পুনঃনির্মাণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন কিন্তু খুব সহজসাধ্য বিষয় নয়, তাই আমার মনে হয় একান্তই যদি প্রয়োজন না পড়ে তাহলে এটা না করাটাই ভালো। বাস্তবতা এবং পুনঃউৎপাদন এ দু’টোর মধ্যে একটা সংঘর্ষ তৈরি হয় সবসময়। তাই প্রয়োজন না থাকলে এ সংঘর্ষ তৈরির প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি না।
আপনারা যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছেন সে সময়টায় প্রামাণ্যচলচ্চিত্রের প্রচার এবং প্রসার আর আজকের অবস্থার মধ্যে কী কী পার্থক্য আছে বলে মনে হয় আপনার?
আমরা যখন তিরিশের বয়সে বা তার একটু কম তখন আমাদের দেশে সরকারী প্রচারধর্মী বা শিক্ষামূলক চলচ্চিত্রকেই প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এখন বেশ কয়েক বছরের চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা সে জায়গা থেকে সরে এসেছি। আজ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে বিষয় বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা প্রসঙ্গ আসছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে, আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র যেখানে ফিল্ম সংক্রান্ত কোর্স চালু আছে সেখানে পড়ানো হচ্ছে। সুতরাং এক ধরণের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, এখন এ আগ্রহ যদি বজায় থাকে আর প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের এ ধারাকে শিল্প এবং জনগণের জীবনের সাথে যদি সম্পৃক্ত করতে পারি তাহলে আমার মনে হয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র আরও বিস্তৃত পরিসরে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
প্রামাণ্যচলচ্চিত্রের ভাষা বা ধরণ নিয়ে যদি কথা বলি, ভাষা বা নির্মাণের দিক দিয়ে কী কী পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়?
ভাষা এবং ধরণ দু’টো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, এক হল বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তু কী ভাষা বা শৈলী হবে নির্মাণের তা নির্ধারণ করে দেয়। আরেকটা হল প্রযুক্তি। প্রযুক্তি যেহেতু দৃশ্য ও শব্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবং পুনঃউপস্থাপনের ক্ষেত্রে একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। সুতরাং প্রযুক্তির কারণেও আমাদের চলচ্চিত্রের ভাষার পরিবর্তন ঘটছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রশ্নটা হচ্ছে প্রযুক্তি শুধুমাত্র সহায়ক হিসেবে দেখছি না কি এর সহায়তায় নতুন মাত্রা যোগ করার চেষ্টা করছি কি না চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। সেদিক থেকে ইদানীং নতুন বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে যেগুলো চলচ্চিত্রের ভাষায় নতুন ডায়মেনশন যুক্ত করছে, সেদিক থেকে এটা আশাবাদযুক্ত।
পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিকশন বা কাহিনিচিত্র নির্মাণ না করলে ‘চলচ্চিত্র নির্মাতা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যায় না দর্শকদের মধ্যে বা অনেক ক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র সমঝদার ব্যক্তিবিশেষের মধ্যেও এ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা কাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন, কিন্তু উল্টোটা সাধারণত দেখা যায় না। এ ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়?
যেহেতু প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ধারাটা আমাদের দেশে এখনো তেমনভাবে চলচ্চিত্রের ধারা হিসেবে স্বীকৃত না, স্বীকৃত না হওয়ার কারণেই কিন্তু এ ঘটনাটা ঘটছে। এটা থেকে সহজে উত্তরণ সম্ভব না। যারা মনে করছেন একটা-দু’টো কাহিনিচিত্র বানালে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাদের যে সামাজিক স্বীকৃতি সেটা আসবে, তা হয়তো আসবে। কারণ কাহিনিচিত্র বেশি মানুষ দেখেন। কিন্তু আমার মনে হয় এটা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার ব্যক্তিগত ব্যাপার যে তিনি কোন ফরম্যাটে কাজ করবেন। তিনি দুটো ধারাতেই কাজ করতে পারেন, আবার যেকোন একটা ধারাতে তিনি কাজ করতে পারেন। তবে হ্যাঁ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে কাজ করলে এই সামাজিক স্বীকৃতির বিষয়টা একটু কঠিনই আমাদের দেশে। এটাকে মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে। চলচ্চিত্র মাধ্যমে একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে কেউ কাজ করতে চাইলে তার কাজের জন্য যে ধারা সবচে এপ্রোপ্রিয়েট বা যথাযথ তাকে সেই ধারাটাই বেছে নিতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আমার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা কাজের ধরণ তার সাথে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র যায়, আমি মনে করি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র শক্তিশালী একটা মাধ্যম এবং এজন্য আমি এ ধারাতে কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের দর্শক সাধারণত শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র বোদ্ধারাই, ‘সাধারণ’ মানুষ সাধারণত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দেখেন না। তো এটার কারণ কি এই যে আমাদের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে ‘গাম্ভীর্য’ একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এজন্য এটা হয়? আমরা যদি ‘হালকা’ বা ভাবগম্ভীরতা কম এরকমভাবে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারি তবে সাধারণ মানুষের কাছেও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র গৃহীত হবে বলে কি আপনার মনে হয়?
প্রত্যেক দেশেই কোন ধরণের চলচ্চিত্র নির্মিত হবে সেটা নির্ভর করে সে দেশের আর্থসামাজিক পরিবেশের উপর। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, যুৎসইভাবে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করতে হলে সেটা সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নির্ভর হতে হবে। সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নির্ভর হলে এটা যদি ভালো চলচ্চিত্র হয়, এটা কিন্তু যেকোন মানুষের কাছে যেতে পারে। তবে একটা জিনিস ঠিক গোড়া থেকেই এমন একটা চলচ্চিত্রের ধারা এর মধ্যে কিছুটা গাম্ভীর্য আসেই, কারণ যখন একটা রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে হয় তখন খুব হালকা চালে বিনোদনমুখী হওয়ার সুযোগ কম। কথার কথা একজন জনপ্রিয় গায়ককে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকে হয়তো অন্যভাবে নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু যদি একটা ধারা হিসেবে কথা বলি তবে পৃথিবীর সব দেশেই সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই এ চলচ্চিত্রের উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই কিছুটা গাম্ভীর্য আসবেই। আর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ঐ অর্থে কিছুটা অগ্রসর দর্শকের জন্যই আসলে। যে দর্শক চলচ্চিত্রের মধ্যে তথাকথিত বিনোদন খুঁজবেন না কিন্তু ভাবনার, তথ্যের জায়গাটা খুঁজবেন। সুতরাং একেবারে কাহিনিচিত্রের মতো প্রামাণ্য চলচ্চিত্র কখনো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এটা আমার মনে হয় না। এর প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না।
কাহিনিচিত্রের মতো প্রামাণ্যচিত্রকে প্রেক্ষাগৃহে রিলিজ দেয়ার রেওয়াজ আমাদের নেই। তো কাহিনিচিত্রের মতো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এই উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় কী না, ‘প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হলে রিলিজ দেওয়া’ প্রসঙ্গে আপনি কী ভাবেন?
আমার মনে হয় যেখানেই দর্শক আছে সেখানেই যাওয়ার সুযোগ আছে। প্রশ্নটা হচ্ছে– যেহেতু এটা অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে যে হলগুলোতে কেবল কাহিনিচিত্রই প্রদর্শিত হবে। সুতরাং যে কোন ছবিই যখন হলে মুক্তি পাচ্ছে ধরেই নেওয়া হচ্ছে সেটা কাহিনিচিত্র এবং দু’জন দর্শক হলেও এসে দেখবেন। এখন প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এ ধরণের ঘটনা তেমন ঘটে নি। একবারই ঘটেছিল ‘মুক্তির গান’ যখন তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছিলেন তখন, তাও খুব সীমিত আকারে। হল মালিক তো আর অন্য কিছু চান না, হল মালিক দেখতে চান কত টিকেট বিক্রি হল। তাই এটা দেখতে হবে আসলে, কেউ যদি এরকম উদ্যোগ নিয়ে দেখেন, টিকেট বিক্রির সংখ্যা যদি গ্রহণীয় পর্যায়ে থাকে। তবে এটা হল মালিকদের কোন আপত্তি ঘটার কারণ নেই কোন। আমার মনে হয় একটা অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে– কাহিনিচিত্র হলমুখী হবে, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হলমুখী হবে এ চর্চা চালু হয়নি। এখন যদি বেশি পরিমাণে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, একটা দু’টো চলচ্চিত্র যদি হলে রিলিজ পায়। তাহলে হয়তো এমন হতে পারে যে কিছু কিছু হল মালিক অতোটা রিজার্ভেশন শো নাও করতে পারেন। আমার মনে হয়, যে কোন স্ক্রিনেই হোক পৌঁছোতে হবে, সেটা মুঠোফোন হোক, হল হোক, ল্যাপটপ হোক বা ফেস্টিভ্যাল হোক। এখানে রিজার্ভেশনের কোন কারণ আমি দেখি না।
এখন আমাদের দেশের অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং চলচ্চিত্র-কর্মীরা দেশের বাইরের চলচ্চিত্র উৎসব, কর্মশালা, পিচিং সেশন, ফিল্ম-ল্যাব, বিভিন্ন ধরণের অনুদান এসবের সাথে যুক্ত হচ্ছেন এবং অংশগ্রহণ করছেন এ ব্যাপারটিকে আপনি কী ভাবে দেখেন?
এ ব্যাপারগুলো আন্তর্জাতিকভাবে এখন চলছে। এটা তো ইতিবাচক অবশ্য বা একটা সহায়তা পাওয়া যায়। এটা তো খারাপ কিছু না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে যে এই সমস্ত সুবিধাগুলো বেশিরভাগ আসছে উন্নত দেশগুলো থেকে। আমাদের দেশ সম্পর্কে উন্নত দেশগুলোর স্টেরিওটাইপ ধারণা রয়েছে। এবং ওরা আমাদের সেই বিষয়গুলোই দেখতে চায় যেগুলো ওদের কাছে আমাদের দেশ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক মনে হয়। আমাদের কাছে এটা কতটা প্রাসঙ্গিক তা ওদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। আমি তিনবার এ ধরণের ফান্ড এর কাজে অংশ নিয়েছিলাম, এর মধ্যে একবার স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট পর্যন্ত ফান্ড পেয়েছি এরপর আর পায়নি। সেই একই কারণে, ওদের আমাদের সম্পর্কে যে বিধিবদ্ধ ধারণা রয়েছে সেই বিষয়গুলোই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য যা তাদের কাছে অনেক বেশি চমকপ্রদ।
আমাদের এটাই মাথায় রাখতে হবে– আমরা যেন আমাদের পছন্দের গল্প আমাদের মতো করে বলতে পারি, আমাদের গল্প তাদের মতো করে বলার ক্ষেত্রে আমাদের পায়ের নিচের মাটিটা যেন আমরা শক্ত রাখতে শিখি।
আমাদের দেশের সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রেও কি অনেক সময় এই ব্যাপারটা ঘটে যে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়, এজেন্ডা বা গল্প প্রাধান্য পায় অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে? একটু ভিন্ন গল্প বা ভাবনা অতোটা প্রাধান্য পাচ্ছে না?
কিছুটা যে হয় না, তা না। যে সরকারই অনুদান দিচ্ছে সেই সরকারই তাদের নিজস্ব পলিটিক্যাল এজেন্ডাকে বাস্তবায়নের জন্য কিছুটা ইচ্ছে তো প্রকাশ করবেই। আমি নির্মাতা হিসেবে তো স্বাধীন, আমি সেখানে অংশগ্রহণ করবো কি করবো না। আমি চারবার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অনুদান সিলেকশন কমিটিতে যুক্ত ছিলাম, আমার অভিজ্ঞতা বলে– যতটা বলা হচ্ছে ততোটা নয়। খুব আকর্ষণীয় প্রস্তাবনা যদি আসে, তবে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। ৬০ ভাগ আকর্ষণীয় প্রস্তাবই প্রাধান্য পায়, ৪০ ভাগ হয়তো কিছু এজেন্ডা বা বিষয়কে মাথায় রেখে নির্বাচিত হয়।
আপনার দর্শক কারা? আপনার কী মনে হয়?
আমার দর্শক খুব সীমিত। আমার মনে হয় মধ্যবিত্ত সমাজের রাজনীতি ও সমাজসচেতন মানুষই আমার দর্শক। আমার ছবির সংখ্যাও তো বেশি না, আর আমি ব্যাপক দর্শকের কাছে পৌঁছোতেও পারিনি। তবে যে বিষয় আমি নির্বাচন করেছি, করছি এতে এই মধ্যবিত্ত রাজনীতি-সমাজ সচেতন মানুষই আমার ছবি দেখেন বলে আমি মনে করি।
এই দর্শক আজ থেকে পাঁচ বা দশ বছর আগের তুলনায় কমেছে না বেড়েছে?
বেড়েছে, নিশ্চয়। আনুপাতিক হারে কতটা বেড়েছে তা জানি না। তবে এটা সব ধরণের কাজের মধ্য দিয়ে বেড়েছে। ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বেড়েছে, নানা রকম উদ্যোগ, চলচ্চিত্র নিয়ে তরুণদের আগ্রহ বেড়েছে – এসমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই দর্শক বেড়েছে। সেটা শুধু আমার চলচ্চিত্র বা আমাদের চলচ্চিত্রের দর্শক নয়। সার্বিকভাবেই দর্শকের সংখ্যা বেড়েছে। সামগ্রিকভাবেই মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে চলচ্চিত্রের প্রতি।