আমরা নিজের দেশকে সবাই ভালোবাসি। কিন্তু নিজের দেশকে ভালোবাসতে গিযে অবচেতনে অনেক সময় আরেক দেশকে খাটো করে ফেলি। আমাদের মধ্যে অনেক সময় আরেক দেশের প্রতি ঘৃণা কাজ করে। আর একবার ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দিলে, তার শেষটা কখনও ভালো হয় না।
সম্প্রতি এক আড্ডার অভিজ্ঞতার আলোকে এই কথাটিই বারবার মনে হচ্ছিল৷ যে কোনও বাঙালি বাড়ির আড্ডায় যেমনটা হয়, এই আড্ডাতেও তেমনই দিনকাল রাজনীতি, ক্রিকেট, পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে সকলের মতামত উঠে আসছিল৷ আড্ডাধীরারা সকলেই মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত এবং সচেতন।
বর্তমান সরকার অনেক বেশি দামে ভারত থেকে ডিজেল আমদানি করছে, ভারতের স্বার্থে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দুই কৃতি বোলার তাসকিন ও সানির বোলিং অ্যাকশনে ত্রুটি খুঁজে পাওয়া এবং তাদের ক্রিকেট থেকে সাময়িকভাবে নিষেধাঙ্গার সঙ্গেও ভারতের হাত আছে-এমন বিস্ফোরক সব মন্তব্য শুনছিলাম। এসব মন্তব্য শুনতে শুনতে এখন অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কেবল যে এই আড্ডায় এমনটা হল, তা নয়। বস্তুত বহু দিনের চেনা মানুষ এবং মতবাদ হঠাৎই দেশপ্রেমের পরীক্ষায় কেমন যেন বদলে যাচ্ছেন।
বাসের সহযাত্রী, অফিসসহকর্মী, লোকাল ট্রেনের রোজকার চেনা মানুষ, আজন্ম দেখা আত্মীয় বা পাড়ার দোকানি সকলের মধ্যেই এক অচেনা আর আগ্রাসী দেশপ্রেমিককে হঠাৎ আবিষ্কার করছি। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারি না, নিজের দেশকে ভালোবাসতে হলে, বা ভালো প্রমাণ করতে হলে অন্যের দেশকে কেন খাটো করতে হবে? কেন গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত পরমতসহিষ্ণুতাকে বিসর্জন দিয়ে একটা ‘শত্রু’ খাড়া না করলে, নিজেদের দেশপ্রেম প্রমাণ হবে না?
এই সব প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। নিরক্ষর, ‘দিন-আনি-দিন-খাই’ মানুষের এত সব পোশাকি বিষয় নিয়ে ভাবনার সময় কম। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে এই ধারণা ক্রমশই দৃঢ়মূল হচ্ছে যে, আমাদের যাবতীয় অকল্যাণ ও সর্বনাশের মূলে রয়েছে এই প্রতিবেশি রাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাব! মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের দেশে একটা রাষ্ট্রীয় ‘শত্রু’ থাকা যেমন ভীষণ প্রয়োজন, ‘বীর’-এর একটা মনমতো ছবি থাকাও ততটাই দরকারি। আপাতত বীরের কোন স্পষ্ট ছবি নেই, তবে কখনও সেনা, কখনও ধর্মীয় ভাবধারাপুষ্ট কোন গোষ্ঠী এই বীরের আসন নেয়।
দেশ আর রাষ্ট্রকে যদি সংজ্ঞায় বাঁধি, তা হলে বলা যেতে পারে, দেশ হল একটা বিশেষ নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, যেখানকার মানুষেরা ঐতিহাসিক ভাবে একই রাষ্ট্র-কাঠামোয় বাস করে৷ আর রাষ্ট্র হল একটি আবশ্যিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এটি একটি সরকার দ্বারা পরিচালিত শুধু নয়, সেই সরকার ওই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে আইনগত বল প্রয়োগের অধিকার ভোগ করে।
এই সব সংজ্ঞা আর তার ব্যাখ্যা আমরা সকলেই জানি৷ কিন্তু সোজাসুজি যখন দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হয়, তখন আমরা, অধিকাংশ জনই ঘুরে দাঁড়িয়ে খুবই সংকীর্ণভাবে অন্যদেশের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে নিজের দেশপ্রেমের পরিচয় দিই। একইসঙ্গে আমরা খুব সহজেই অন্যের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলি। আমরা কেউ দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারি না, ‘আমার দেশ’… ‘আমি ভালোবাসি কি না তার কৈফিয়ত কেন অন্য কাউকে দেব?’
কোন রকম যুক্তিবুদ্ধিবিবেচনা ছাড়া আমরা সহজেই অন্য কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে ‘দেশের শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলি। কারণ এটা অনেক সহজ কাজ। অনেক নিরাপদ। কারণ এতে রাষ্ট্রীয় রোষ স্পর্শ করতে পারে না। রাষ্ট্রও এ ব্যাপারে ভীষণ উদার!
আসলে আমাদের দেশে এক ধরনের ঘৃণার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যা হচ্ছে। দলের প্রতি ঘৃণা, দেশের প্রতিও ঘৃণা। আর যুক্তি-প্রতিযুক্তির কোনও জায়গা নেই ঘৃণার রাজনীতিতে। ঘৃণা ছড়ানোর জন্য তাৎক্ষণিক একটা আবেগ ছাড়া আর কিছু লাগে না। সমাজের একেবারে ভেতরে ঘৃণার রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়া খুব সহজ কাজ রাজনৈতিক দলের পক্ষে। আমাদের দেশের এক শ্রেণির রাজনৈতিক দল অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ঘৃণার রাজনীতি চর্চা করেছে। তাতে যে কেবল মূল সমস্যা সমাধান করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকা যায়, তাই নয়, ব্যক্তির নিজের কাছে নিজের একটা ‘আইডেনটিটি’ তৈরি হয়। মনে হয়, এই তো আমি নিজের বাইরে বেরিয়ে এসে দেশের কথা, দশের কথা ভাবছি৷ আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তির একটা বোধ তৈরি হয়৷ এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষত: শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে।
বংশ পরম্পরায় যে ঘৃণা আমরা চারিয়ে দিয়ে যাই পরের প্রজন্মে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ঘৃণা বোধ হয় ভারতের প্রতি ৷ ভারত সাম্রাজ্যবাদী, শোষক, ‘হিন্দুরাষ্ট্র’, এই দেশটি নানাভাবে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে, অন্যায়ভাবে অধিক সুবিধা আদায় করছে-এমনি নানা অভিযোগ দেশটির বিরুদ্ধে। এই সব অভিযোগ যে কোনটাই সত্য নয়-তাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু আমরা একবারও হিসেব করি দেখি না, ভারত ন্যায়-অন্যায় যা কিছু করুক না কেন তা করছে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতিতেই। যদি তারা অন্যায় কিছু করে সেটা প্রতিরোধের দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি তাদের অন্যায় আবদার না মানে, ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে তৎপর হয়, তাহলে ভারতের পক্ষে কী সম্ভব আমাদের দেশকে শোষণ করা, তাদের অন্যায় নীতি চাপিয়ে দেওয়া?
কিন্তু আমরা প্রথমত অভিযোগগুলো আমলযোগ্য কি-না সেটা তলিয়ে দেখি না, দ্বিতীয়ত, এসব অভিযোগ সত্য হলে তার দায় যে সরকারের-এই সত্যটি ভুলে যাই। আমরা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ না হয়ে সব ক্ষোভ-রোষ ঝাড়ি প্রতিবেশি এই দেশটির উপর। এ ব্যাপারে ডান-বামের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
ধর্ম এ ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর। আমরা বড় বেশি ধর্মমুখী একই সঙ্গে অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠছি। শত্রু নির্বাচন করার কাজে ধর্মই এখন প্রধান ভূমিকা পালন করছে। আমরা একাত্তরে ভারতের অবদান মনে রাখি না। ভারত থেকে সস্তায় চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রতি বছর দেশের হাজার মানুষ মানুষ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকছেন সেটা আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে নেই। আমরা ধর্মীয়বিদ্বেষ আর ঘৃণাকেই একমাত্র সত্য বলে জানি।
এটা অবশ্য আমাদের দেশের মানুষের রাজনৈতিক ভণ্ডামিও বটে। লেখক হুমায়ূন আজাদ যথার্থই লিখেছিলেন, আমাদের যতোটা মিল আছে ভারতীয় সংস্কৃতি ও অন্য বহু কিছুর সঙ্গে, আছে যতোটা নৈকট্য, ততোটা আর কারো সঙ্গে নেই।
রাজনীতিতে ভারতবিদ্বেষ প্রবল হলেও-হয়তো এটা কপটতা- দেশ জুরেই তো দেখি ভারতকে। পথে বেরোলেই ভারতীয় টাটা সুজুকি, বাজারে গেলেই ভারতীয় চাল ডাল পেঁয়াজ রসুন আচার মরিচ, পুন্য অর্জন করতে গেলেই দেখি ভারতীয় গোমাতাকে, বৃক্ক হৃদপিণ্ড ঠিক করতে গেলেই ছুটছি দিল্লি চেন্নাইয়ে, আর দিনরাত প্রমোদে মেতে আছই ভারতীয় ঔপগ্রাহিক প্রচণ্ড নৃত্যে ও গীতে- পড়ে আছি তরুণীদের দেহের বাঁকে। ধার্মিকেরাও ওই তরুণীদের দেহের ডাকে নিরন্তর কাঁপছে।
আমরা বাস করছি প্রচণ্ড রাজনীতিক ভণ্ডামোর মধ্যে; মুখে ভারতবিদ্বেষ আর পেটের ভেতরে, মাংসের ভেতরে, ভারত (আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, হুমায়ুন আজাদ)।
তারপরও ভারতের প্রতি প্রবল ঘৃণা আমরা নিজেরা বহন করছি৷ উত্তরাধিকার দিয়ে যাচ্ছি উত্তর প্রজন্মকে৷ ঘৃণার এই পরম্পরা হয়তো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ-ভাগ হওয়ার সময়ই তৈরি হয়েছে কিন্তু এতগুলি বছরের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা বা শিক্ষার প্রসার কিছুই আমাদের স্পর্শ করতে পারেনি৷ প্রশ্ন জাগে, এই কূপমণ্ডূকতা কি দেশপ্রেমের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)