কিছু কিছু পরিবর্তন আনতে হয় বৃহত্তর খাতিরে। কিছু মানুষকে এগিয়ে এসে ধরতে হয় হাল। যদি নেতাগুলো মানুষ না হয়, আর মানুষগুলো হয় নেতা, তাহলে হয়তো ক্ষণিকের জন্য বদলে যাবে আমাদের চেতনা। শস্যদানার মতো ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে বেঁচে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের বীরগাঁথা। হাতের উপর নড়বে চড়বে হাতের উপরই ফুলের গন্ধ ছড়াবে আমাদের জিরো পয়েন্ট ‘৭১। কতদিন থাকবে এভাবে জানি না। হয়তো থাকবে কিছুদিন কিংবা একেবারেই থাকতে হবে না। যদিও জানি একাত্তর কখনো হারাবে না এবং সেই বিশ্বাস নিয়ে আজো বেঁচে আছি।
প্রয়োজন হলে প্রাকৃতিক নিয়মে এটোম বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একদিন শস্যদানার আকৃতি থেকে পুনরায় জীবন্ত লাভা হয়ে বেরিয়ে আসবে আমাদের একাত্তর। সবাই বলবে ঐ দেখ একাত্তর আসছে। তাতেই ভস্ম হবে রঙ করা মুখ, চর্বিসর্বস্ব ভুঁড়ি আর খিচিমিচি করা চানাচুর বিক্রেতাদের হাঁকডাক।
তখন সুশীলদের টক-ঝাল-মিষ্টিও আগের মত বিক্রি হবে না বাক্সগুলোতে। একাত্তরের চেতনা সান্তাক্লজের মতো হাতে হাতে তুলে দেবে লাল-সবুজ পতাকা। দুষ্টুরা পালাবে। ভুল আর গুল পর্বের অন্তিম সমাপ্তি আসবে। মিনমিনে বাংলাদেশি কিংবা বাংলাদেশ বিদ্বেষীদের শেষ অস্তিত্ব পালিয়ে যেতেই আবারো হলুদ সূর্য উঠবে পূর্ব দিগন্তে।
যে একাত্তর চেনে না, একাত্তরকে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে এক ঘণ্টা কথা বলতে পারে না, আপাতত তাকে বাংলাদেশি না হলেও চলবে। তিনি দেশহীন।
কেন একাত্তরের কথা বলছি? বলছি এই জন্য যে, সবকিছুর একটা কেন্দ্রবিন্দু থাকে। যাকে জিরো পয়েন্ট বলে। যেমন বড় বড় শহরগুলোতে জিরো পয়েন্ট বলে একটা জায়গা থাকে। আমাদের শরীরেও আছে একটা জিরো পয়েন্ট। ঘরের মধ্যেও পাবেন একটা জিরো পয়েন্ট। বাংলাদেশের জিরো পয়েন্ট হলো ১৯৭১ অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
অনেক আগে থেকে শুরু করা আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত, আমাদের অভীষ্ট, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের কিংবদন্তী সব একাত্তরের দিকে ধাবিত হয়েছিল। আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছিলাম একাত্তরের দিকে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা পৌঁছাতে পারেনি, তবু তাদের যাত্রা ছিল। আমরা ভাগ্যবান, আমরা আসতে পেরেছিলাম আমদের জিরো পয়েন্টে। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত তথা বাঙালির সংস্কৃতিতে যে শক্তি, আমরা সেই শক্তি দিয়েই একাত্তরে লড়াই করেছি এবং সেখান থেকে প্রাপ্য ফলাফল দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে যাচ্ছি। আমাদের সব অতীত এসে একাত্তরে মিশেছে এবং একাত্তর থেকেই আমাদের ভবিষ্যৎ শুরু। ‘৭১ হলো বাঙালিদের জিরো পয়েন্ট। চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। একাত্তরই আমাদের সকল সহা সকল বহা। বিপদে আপদে তাই একাত্তরের কাছেই আমাদের বার বার ফিরে যেতে হবে।
যদি কেউ একাত্তরের আওয়াজ শুনতে না পান, যদি জয় জয় শব্দে ঘুম না ভাঙ্গে, যদি একাত্তরের প্রয়োজনে রাজপথে নেমে আসতে পিছুটান আসে, তাহলে চোখ কান সজাগ করুন, বলছি- জেগে উঠুন সময় থাকতে। মনে রাখবেন, পথে না এলে পথ যাবে না ঘরে। যে মানুষ সবকিছু পাবার আশায় হাত গুটিয়ে বসে থাকে, সে নিজের গড়া কিছুই পায় না হাতে। আপনারা যখন চায়ের আসরে বলেন ‘ঐ যে একাত্তরের কথা বলছে’, কিংবা বলেন ‘সেই একই কথা আর কত শুনবো একাত্তর একাত্তর’। মনে রাখবেন আমরা সাথে সাথেই বুঝে ফেলি আপনি কোথাকার কে? কতটুকই রঙ মাখা সামাজিক ইঁদুর আপনি। আপনার ঐ শাড়ি-চুড়ি, কোট-টাই সবকিছুই তখন দুর্গন্ধ ছড়ায়। আপনি তখন কেউ না হয়ে পড়েন।
সবকিছু কেন অন্যকে বলতে হবে। নিজের অংশীদারিত্ব না থাকলে কি করে ‘আমার’ কথাটি বলবেন। কি করে বলবেন ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘আমার বাংলাদেশ’।
মনে করেন আপনার তলদেশ থেকে যদি বাংলাদেশ নামটি সরিয়ে নেওয়া হয় তখন আপনি কোথায় যাবেন। আপনি তখন ভাসমান। যদি বাংলাদেশি হন, তবে একাত্তরের কথা বলেন। কম করে হলেও, এক নিঃশ্বাসে এক ঘণ্টা। সেটা যদি না পারেন তবে বুড়িগঙ্গায় ডুবে মরেন। হা, এই দুর্গন্ধই আপনার পুরষ্কার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)