চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমাদের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও বাচসাস’র ৫০ বছর

১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়াশিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারীচরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন। নওয়াব পরিবারের উদ্যোগে ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। এর প্রযোজনায় অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত নির্মাণ করেন নির্বাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস। খাজা আজমল, খাজা আদিল, খাজা আকমল, খাজা শাহেদ, খাজা নসরুল্লাহ, শৈলেন রায় বা টোনা বাবু ছিলেন এই চলচ্চিত্রের অভিনেতা। তবে এতে নারীচরিত্রে নারীরাই অংশ নেয়। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন লোলিটা বা বুড়ি নামের এক বাইজী। চারুবালা, দেববালা বা দেবী নামের আরও দুই বাইজী এতে অভিনয় করেন। হরিমতি নামে একজন অভিনেত্রীও এতে অভিনয় করেন।

১৯৩১ সালে এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ঢাকার মুকুল হলে অধুনা আজাদ হল। এর প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৮৮৮-১৯৮০। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৩৬-১৯৪২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়েদ-উল হক দুঃখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬) প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন হিমাদ্রী চৌধুরী ছদ্মনামে। কলকাতায় চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশী কোনও মুসলিম পরিচালকের হাতে নির্মিত এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। উদয়ন চৌধুরী ছদ্মনামে ইসমাইল মোহাম্মদ নির্মাণ করেন মানুষের ভগবান ১৯৪৭ চলচ্চিত্রটিও। 

দেশভাগের পরে এরা ঢাকায় ফিরে আসেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ সৃষ্টি করেন। রাজধানী ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রযোজনা পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান এবং স্টুডিও নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে নাজীর আহমদ ১৯২৫-১৯৯০ ইন আওয়ার মিডস্ট নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম তথ্যচিত্র হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরের বছর বছর সরকারি প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য জনসংযোগ বিভাগের অধীনে চলচ্চিত্র ইউনিট ১৯৫৩ গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে এখান থেকে নাজীর আহমদের পরিচালনায় নির্মিত হয় প্রামাণ্য চিত্র সালামত। নাজীর আহমদ একাধারে অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বেতারকর্মী ও লেখক। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রহমান ছিলেন তার সহোদর। ১৯৫৫ সালে নাজীর আহমদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি এবং স্টুডিও চালু হয়। তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালক হন। তার কাহিনী থেকে ফতেহ লোহানী নির্মাণ করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র আসিয়া ১৯৬০।

নবারুণ ১৯৬০ নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র। নতুন দিগন্ত নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন নাজীর আহমদ। ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় ইকবাল ফিল্মস এবং কো অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেড। ইকবাল ফিল্মস এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ মোদাব্বের, মহিউদ্দিন, শহীদুল আলম, আবদুল জব্বার খান, কাজী নুরুজ্জামান প্রমুখ। ড. আবদুস সাদেক, দলিল আহমদ, আজিজুল হক, দুদু মিয়া, কবি জসীমউদ্দীন, কাজী খালেক, সারওয়ার হোসেন প্রমুখ ছিলেন কো অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেডের সঙ্গে। দলিল আহমেদের পুত্র বুলবুল আহমেদ এবং দুদু মিয়ার পুত্র আলমগীর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। 

১৯৫৪ সালে ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে এই ভূখণ্ডের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ এর কাজ শুরু করেন আবদুল জব্বার খান। কো অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্সের ব্যানারে স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্রের আপ্যায়ন এর কাজ শুরু করেন সারোয়ার হোসেন। ১৯৫৫ সালে জুন মাসে তেজগাঁওয়ে সরকারি ফিল্ম স্টুডিও চালু হয়। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তি পায়। পরিচালক নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা পিয়ারী, জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু পরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সালে এদেশে কোনও চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিস্ফুটনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেন।

১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি, মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড়, এহতেশামের এদেশ তোমার আমার এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর দশকে নির্মিত ৫টি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন। অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শুদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। বেবী ইসলামের তানহাও উর্দু ভাষার নির্মিত। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। 

স্বাধীনতার পরে আবির্ভূত চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯) উল্লেখযোগ্য। তার নির্মিত চলচ্চিত্র হলো ধীরে বহে মেঘনা ১৯৭৩, সূর্য কন্যা ১৯৭৬, সীমানা পেরিয়ে ১৯৭৭, রূপালী সৈকতে ১৯৭৯, মোহনা ১৯৮২,পরিণীতা ১৯৮৪ ও মহানায়ক ১৯৮৫। স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে এদেশে ৮টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর মধ্যে নজরুল ইসলামের স্বরলিপি, অশোক ঘোষের নাচের পুতুল, আলমগীর কুমকুমের স্মৃতিটুকু থাক এবং খান আতাউর রহমানের সুখ দুঃখ সামাজিক চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ সালে আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা, জহিরুল হকের রংবাজ, সুভাষ দত্তের বলাকা মন, ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশেষ মানে উন্নীত করে। এই সুস্থ ও সৃজনশীল ধারায় ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয় নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল। ১৯৭৫ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার লাঠিয়াল, খান আতার সুজন সখী এই ধারারই প্রবাহ। ১৯৭৬ সালে ছয়টি চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ধারণাকেই পাল্টে দেয়। যেমন রাজেন তরফদারের পালঙ্ক, হারুনর রশীদের মেঘের অনেক রঙ, আলমগীর কবিরের সূর্য কন্যা, কবীর আনোয়ারের সুপ্রভাত, আবদুস সামাদের সূর্যগ্রহণণএবং আমজাদ হোসেনের নয়নমনি। ১৯৭৭ সালে আলমগীর কবিরের সীমানা পেরিয়ে, সুভাষ দত্তের বসুন্ধরা পরিচ্ছন্নতা ও সুস্থতার দাবিদার। ১৯৭৮ সালে আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে এবং আবদুল্লাহ আল মামুনের সারেং বৌ শিল্পসফল চলচ্চিত্র হিসেবে নন্দিত।

স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে। মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ নির্মাণ সূর্য দীঘল বাড়ি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দেয়। আলমগীর কবিরের রূপালী সৈকতেও এই সময়ের উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র। সত্তর দশক ও আশির শুরুতে সময়ে নির্মিত চলচ্চিত্র জহিরুল হকের রংবাজ ১৯৭৬, প্রাণসজনী ১৯৮২, রুহুল আমিনের বেইমান ১৯৭৪, অশোক ঘোষের নাচের পুতুল ১৯৭১, সিবি জামানের শুভরাত্রি ১৯৮৫, বেবী ইসলামের চরিত্রহীন ১৯৭৫, নজরুল ইসলামের স্বরলিপি ১৯৭১, আবদুল রতিফ বাচ্চুর যাদুর বাঁশি ১৯৭৭, আবদুল্লাহ আল মামুনের সখি তুমি কার ১৯৮০, এখনই সময় ১৯৮০, সৈয়দ হাসান ইমামের লাল সবুজের পালা ১৯৮০ প্রভৃতি। 

১৯৮০ সালে আমজাদ হোসেনের কসাই, দিলীপ সোমের স্মৃতি তুমি বেদনা দর্শক প্রিয়তা লাভ করতে সমর্থ হয়। ১৯৮১ সালে আমজাদ হোসেনের জন্ম থেকে জ্বলছি চলচ্চিত্রের সুস্থ মেজাজ বজায় রাখে। ১৯৮২ সালে চাষী নজরুল ইসলামের দেবদাস, মোস্তফা আনোয়ারের কাজল লতা, আবদুস সামাদ খোকনের বড় বাড়ীর মেয়ে, মতিন রহমানের লাল কাজল, আলমগীর কবিরের মোহনা সকল অর্থে সুস্থধারার সামাজিক চলচ্চিত্র। ১৯৮৩ সালে সিবি জামানের পুরস্কার ও এজে মিন্টুর মান সম্মান, সুভাষ দত্তের নাজমা চলচ্চিত্র চলনসই।

১৯৮৪ সালে আখতারুজ্জামানের প্রিন্সেস টিনা খান, কাজী হায়াৎ এর রাজবাড়ি, কামাল আহমেদের গৃহলক্ষ্মী, সুভাষ দত্তের সকাল সন্ধ্যা, চাষী নজরুল ইসলামের চন্দ্রনাথ, আমজাদ হোসেনের সখিনার যুদ্ধ ও ভাত দে। ১৯৮৫ সালে শক্তি সামন্ত ও সৈয়দ হাসান ইমামের অবিচার, শেখ নিয়ামত আলীর দহন, রাজ্জাকের সৎ ভাই ও শহিদুল আমিনের রামের সুমতি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। আশির দশকের শেষার্ধে সুভাষ দত্তের ফুলশয্যা ১৯৮৬, আলমগীর কবিরের পরিণীতা ১৯৮৬, চাষী নজরুল ইসলামের শুভদা, বুলবুল আহমেদের রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত ১৯৮৭, নারায়ণ ঘোষ মিতার হারানো সুর ১৯৮৭, আফতাব খান টুলুর দায়ী কে ১৯৮৭, কবীর আনোয়ারের তোলপাড় ১৯৮৮, মহিউদ্দিন ফারুকের বিরাজ বৌ ১৯৮৮ এবং নব্বই দশকের প্রথমার্ধে সৈয়দ সালাহ্উদ্দিন জাকীর আয়না বিবির পালা ১৯৯১, এহতেশামের চাঁদনী ১৯৯১ প্রভৃতি চলচ্চিত্র আলোচিত হয়েছে।

চাষী নজরুল ইসলামের হাসন রাজা, তানভীর মোকাম্মেলের লালন ২০০৪, মোরশেদুল ইসলামের দুখাই, লালসালু, আখতারুজ্জামানের পোকামাকড়ের ঘরবসতি, তারেক মাসুদের মাটির ময়না ২০০২, কাজী মোরশেদের ঘানি ২০০৮ উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সামজিক বিষয়কে অবলম্বন করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ কুশলতায় বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলা চলচ্চিত্রের বিকাশের এই ধারার সাথে সাথে এই দেশে বিকশিত হয়েছে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাও। 

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হলেন চিত্রালীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ, আহমেদ জামান চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, সিনেমা সম্পাদক এবং বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রেসিডেন্ট এর পরিচালক ফজলুল হক, আলমগীর কবির, গোলাম সারওয়ার, খোন্দকার সাহাদৎ হোসেনসহ অন্যরা। ১৯৬৮ সালের ৫ এপ্রিল চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের এক সভায় গঠিত হয় পাকিস্তান চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি সংক্ষেপে পিসিজেএ। ওবায়েদ উল হক সভাপতি এবং এস এম পারভেজ, আজিজ মিসির, ফজল শাহাবুদ্দিন ও আলমগীর কবিরকে সদস্য করে পাঁচ সদস্যের এডহক কমিটি গঠন করা হয়। ১৯ জন সদস্যকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মর্যাদা দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে এই সমিতির নামকরণ হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি সংক্ষেপে বিসিজেএ। এই বছরের ৫ এপ্রিল বাচসাস ৫০ বছরে পদার্পণ করেছে। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ৪৬৮ জন। বাচসাসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার সক্ষমতা এবং কাজের পরিবেশ তৈরি করা। পাশাপাশি চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে ভালো সিনেমাকে উৎসাহ দেয়া। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালকে একটা ইউনিট ধরে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। তখনও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তিত না হওয়ায় সিনেমায় ও সমাজে দারুণ সাড়া জাগায় বাচসাস পুরস্কার। টানা ১৯৮৮ পর্যন্ত চলেছে এই পুরস্কার। সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে আবার ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত চলেছে এই পুরস্কার। 

২০১২-২০১৪ মেয়াদে আগের মেয়াদের অসমাপ্ত তিন বছরের পুরস্কারসহ মোট পাঁচ বছরের পুরস্কার ২০০৯-১৩ প্রদান করে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনে বর্তমান কমিটি। রাজ্জাক, কবরী, তিন বোন সুচন্দা, ববিতা, চম্পা থেকে মৌসুমী, ওমর সানি, পপি, ফেরদৌস, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, মাহীসহ একঝাঁক তারকায় রঙিন হয় মঞ্চ। শিল্পী ও কলাকুশলীদের সঙ্গে বাচসাস সংগঠনের সদস্যদের সাংবাদিকতার কৃতী পদক দেয়া হয়। ২০১৩-২০১৫ সময়ে জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে থমকে যায় পুরস্কার। শুরু থেকেই বাচসাস-এ প্রবীণ ও নবীনের মিলনমেলা হয়ে আসছে। ১৯৬৮ সালের প্রতিষ্ঠিত এডহক কমিটির তরুণ সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও চিত্রালীর নবীন লিখিয়ে আহমেদ জামান চৌধুরী। তখন এডহক কমিটির ৫ সদস্যের অন্যতম ছিলেন তার সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ।

পরবর্তীতে আহমেদ জামান চৌধুরী বাচসাসের সভাপতি হন। চিত্রালীতে তারই শিষ্য এবং তরুণ সাংবাদিক আবদুর রহমান হন সাধারণ সম্পাদক। সময়ের পরিক্রমায় প্রবীণ আবদুর রহমান বাচসাসের বর্তমান সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক তারুণ্য দীপ্ত ইকবাল করিম নিশান। বাচসাস দশ বছর নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত না করায় নতুন প্রজন্মরে সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। বর্তমান কমিটি পত্রিকা, অনলাইন, টিভি চ্যানেলসহ নানা মাধ্যমে কর্মরত ১৪২ জনকে এবং আগের কমিটির প্রস্তাবিত ৩৪ জনকে অনুমোদন দিলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সূচনা হয়েছে। তাদের অনেকেই এবারের নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছেন। 

পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি সাংগঠনিক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে বাচসাস। সদস্যদের পরিবার নিয়ে আয়োজিত হয় পরিবার দিবস। গুরুতর অসুস্থ সদস্যদের আর্থিক অনুদান দেয়া হয়। প্রয়াতদের জন্য শোকসভা এবং গ্রন্থ প্রকাশনাও করে বাচসাস। প্রয়াত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের স্মরণে করা হয় স্মরণসভা। আরো থাকে সদস্যদের ইফতার। গুণীজন, গুণী সদস্য সম্মাননা, চলচ্চিত্রের নানা বিষয়ে গোলটেবিল, আড্ডারও আয়োজন করা হয়।

২০১৪ সালে তথ্যমন্ত্রীর কাছে সাক্ষাতে সদস্যদের জন্য কল্যাণ ফান্ড ও এফডিসিতে সমিতির জন্য অফিস প্রদানের আবেদন করা হয়েছে। বাচসাসের জন্য স্থায়ী অফিসের প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি বাচসাস প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করবে। ২১ জুলাই ২০১৭ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত নেতৃত্ব উড়াবেন বাচসাস ৫০ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তীর সেই পতাকা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)