শিশু সাহিত্যিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর। ১৯৫৫ সালে জন্ম; এর পর থেকে টেলিভিশন থেকে শুরু করে সাহিত্য ভুবনে তার দৃপ্ত পদচারণা। মা প্রখ্যাত কথাসাহিত্যক রাবেয়া খাতুন এবং বাবা চিত্রনির্মাতা ফজলুল হক। বিবিসি বাংলা এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকারে তুলে নিয়ে এসেছে এই সফল ব্যক্তিত্বের কথা।
মাত্র চার বছর বয়সে অভিনয় করেছিলেন ছোটদের জন্যে দেশের প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্রে। ছিলেন মূখ্য চরিত্রেও। যেটি নির্মাণ করেছিলেন তার পিতা চিত্রনির্মাতা ফজলুল হক। তবে এরপর আর ক্যামেরার সামনে না দাঁড়ালেও বর্তমানে তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
চলচ্চিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার বাবা যখন চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে যান হয়তো আমাকেই প্রথম তার চোখে পড়েছিলো। তাছাড়া আমারও মা ছিলেন একজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক।
প্রথমবারের মতো ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার বাবা এ চলচ্চিত্রটি তৈরি করার আগে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রও তৈরি করেছেন। যেগুলোতে আমি অভিনয় করেছে। তাতে করে সিনেমার শুটিংয়ে যে অনেক ক্যামেরা আলো-এগুলো আমাকে মোটেও বিচলিত করতে পারেনি। তাছাড়া ওই সময়ে যারা চলচ্চিত্রে নামকরা খ্যাতিমান শিল্পী ছিলেন তাদের আমাদের বাসায় আসা যাওয়া ছিলো। তাদের সঙ্গেই আবার এফডিসিতে এক ফ্লোরে কাজ করতে গিয়ে বাড়তি কিছু মনে হয়নি। বিশেষ করে যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো কাল ক্লাসে গেলে শিক্ষকরা ব্যাপারটা কিভাবে নেবেন। কারণ শুটিং এর জন্য তো স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
তখন তিনি ক্লাস ফোরে পড়েন। তার বাবার পরিচালনায় দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও এর পর আর ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো হয়নি।
শতাধিক গ্রন্থ রয়েছে গুণী এ ব্যক্তির। লেখালেখির হাতে খড়িটাও বেশ আগের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: আমি একবার প্লেনে করে দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। ফেরার পর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলো প্লেনে কি হলো? না হলো? এতো বন্ধু জিজ্ঞেস করলো যে, একটা সময় মনে হলো ব্যাপারটা আমি লিখে ফেলি। কচিকাচার আসরের দাদাভাইকে আমরা আগে থেকে চিনতাম। লেখাটা তার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। দাদাভাইও লেখাটা ছাপিয়ে দিলেন। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। এছাড়া নানা শিশু সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম আমি। স্বাধীনতার পর কচিকাচার মেলার যে কেন্দ্রীয় কমিটি হলো সেটার আহবায়ক ছিলাম আমি। চাঁদেরহাট‘র জন্ম নেয়া প্রথম বছরেই সেটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম আমি। ছোটদের পত্রিকা কচি ও কাঁচা এবং টাপুরটুপুর এগুলো বের হতে দেখেছি আমি। এজন্যই হয়তো ছোটদের কাজের ব্যাপারে দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। ছোটদের জন্যই আমি লিখতে পছন্দ করি আর একটা বড় ব্যাপার টেলিভিশনে যখন কাজ করেছি; বিশেষ করে বাংলাদেশ টেলিভিশনে, আমরা কিন্তু ছোটদের জন্যই কাজ করেছি। ছোটদেরকে নিয়ে নানা রকম অনুষ্ঠান-নাটক করেছি, মূলত সবই ছোটদেরকে কেন্দ্র করেই। এটা হয়তো করতে করতেই হয়ে গেছে। এই যে ছোটদের জন্যই থাকবো ছোটদের জন্যই কাজ করবো।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন: এটা ওই একই গল্প! যখন টেলিভিশন আসে ছোটদের নিয়ে কাজ করেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রচুর অনুষ্ঠান ছোটদের জন্য করেছি। আমি, আলী ইমাম, লুৎফর রহমান রিটন ছোটদের অনুষ্ঠান মানেই আমরা। এটা বলতে দ্বিধা নেই, শুরুতেই টেলিভিশনের সঙ্গে কাজ করছি। বাংলাদেশে এ ধরণের সৌভাগ্য খুব কম মানুষের হয়। যে প্রতিষ্ঠানে জীবনের প্রথম দিন থেকে কাজ করেছি, এখনও সেখানেই কাজ করে যাচ্ছি। আপনি বলতে পারেন আমার শিক্ষাটা কোথায়? আমি টেলিভিশনের কথা বলতে পারি এবং টেলিভিশনের ওপর আমি কয়েকটি বইও লিখেছি।
আমার সমবয়সীদের এবং আমার বড় যারা তাদেরকেও আমি স্বপ্নটা দেখাতে চেয়েছি-দেখো জীবনটা কতো সুন্দর এবং আমাদের যা আছে এতটুকু নিয়েই আমরা এগিয়ে যাবো। আর একটা জিনিস আমি শিখে ফেলেছিলাম আগে থেকেই সেটা হচ্ছে: যে যে প্রফেশনের তার কাছে কিন্তু কোন কিছুতেই না নেই। আমাকে যা দেবে সেখান থেকে একটা ভালো কাজ বের হবে এবং সততা, আন্তরিকতা এগুলোর কিন্তু কোন বিকল্প নেই। এই জিনিসটা যেমন আমি শিখেছি। আমি যখন কোন অনুষ্ঠান করেছি, বই লিখেছি সব কিছুতেই তার প্রতিফলন রয়েছে।
যতোদূর জানি ৬৯ সালে যখন গণ আন্দোলন হয়, গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে আমার বাবা যখন একজন শিল্পী চলচ্চিত্র নির্মাতা, তিনি তখন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ এই স্লোগানকে ভিত্তি করে বাংলাদেশে বাঙালি খাবার পিঠার কোনো দোকান হতে পারে এটা কেউ ভাবেনি, ভুনা খিচুড়ি, কলিজা একেবারেই বাংলাদেশের খাবার ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা এগুলো নিয়ে একটা দোকান করেছিলেন। এটা উদ্বোধন করেছিলেন সেই সময়ে কবি শামসুর রাহমান এবং বেগম সুফিয়া কামাল। একটা দোকান যে দু’জন কবি উদ্বোধন করতে পারে সেটা ছিলো এক নতুন ব্যাপার। আর দোকানের সামনে বিরাট করে লেখা ছিলো ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’। সেই দোকানটাই পরবর্তীতে পৈত্রিকসূত্রে আমার কাছে এসেছে। সেই দোকানটা এখনও রয়েছে। পরে দেখলাম দেশি-পান সুপারি আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার, আমরা কেনো পান-সুপারির দোকান করবো না। পান-সুপারির দোকান মূলত চালায় আমার স্ত্রী কণা রেজা। অনেকগুলো দোকান এখন হয়েছে এবং বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে সেখানে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। আমি একটা আইসক্রিমের দোকানও করেছি। দেশি পোষাক নিয়ে ভাবছি।
সুতরাং বাংলাদেশকে কিভাবে মানুষের কাছে আনা যায় সে চেষ্টা আমরা নানাভাবে করে যাচ্ছি। আর খাবার জিনিসটা এমন যে জিনিস যেটা সবার প্রিয়।পছন্দের এবং বাঙালির খাবারের জন্য ঐতিহ্য রয়েছে। আমার বোন কেকা ফেরদৌসির কথা সবাই জানে। খাবার রান্না শেখানোর জন্য অনেক চেষ্টা সে করে যাচ্ছে। এবং টেলিভিশনে রান্নার অনুষ্ঠানকে সে নতুনভাবে এনেছে সেই সঙ্গে সারা পৃথিবীতে রান্নার অনুষ্ঠানকে অনেক বেশি জনপ্রিয় করার জন্য নানা ভাবে কাজ করছে।
খাবারের কথা থেকে অনেক গুলো কথা চলে আসলো। অনেকে মনে করেন যে, আমি যে টেলিভিশনে কাজ করি তার সঙ্গে এগুলোর কোন মিল নেই। একটা মানুষের জীবনে অনেক রকম কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সে কতটুকু গ্রহণ করবে সেটা তার ব্যাপার।
নানামুখি কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: একটা সময় ছিলো এগুলো জীবনের তাগিদ আর এখন শখ করলেও দোষের কিছু নেই; যদি সে শখ থেকে ভালো কিছু হয়, তাহলে অসুবিধা কোথায়?
এখানে আমি একটা ছোট্ট গল্প বলতে চাই সেটি হলো; অনেকেই বলেন যে বাঙালিরা এক সঙ্গে ব্যবসা করতে পারে না। ৭৮ সাল থেকে আমরা ছয় জন বন্ধু এখন আট জন হয়েছি এক সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছি। আমাদের বাবা মা কেউ জমিদার ছিলো না। পৈত্রিকসূত্রে আমরা কেউ অনেক বেশি ধনী ছিলাম না। একে বারে নিজেদের প্রচেষ্টায় কি কি করা যায় এসব চিন্তা করতে করতে আজকের এ জায়গায় এসেছি। একসময় আমাদের সব বন্ধুরা একসময় বসে ঠিক করলাম একটা টেলিভিশন করা যেতে পারে। যেহেতু আমি টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত, আমার সঙ্গে শাইখ সিরাজ টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত, মুকিত মজুমদার বাবু টেলিভিশনে সঙ্গে জড়িত সুতরাং সরকার যদি অনুমতি দেয় একটা টেলিভিশন করতে দোষ কোথায়? ইমপ্রেস গ্রুপ; আমাদের গ্রুপটার নাম। এবং আমরা সবাই মিলে একটা টেলিভিশন করার চেষ্টা করি। যেহেতু আমি টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত; আমি-শাইখ সিরাজ এখন এই যে চ্যানেল আই এটা আমরা করেছি।
আপনারা জানেন ‘তৃতীয় মাত্রা’ নামে আমাদের একটা অনুষ্ঠান আছে; একটা সময় যখন দু’দল অর্থাৎ বিরোধী দল পার্লামেন্টে যাচ্ছিলো না, তখন তারা চ্যানেল আইয়ে আসছিলো। এটা খুবই প্রশংসনীয় ছিলো। আমরা দেশের মানুষকে বলতে চাই। তরুণ প্রজন্মকে বলতে চাই: আমাদের খুব সুন্দর একটা দেশ রয়েছে।