চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আমাদের কথা ভাবে না কেউ

কী আছে আমাদের? আমাদের জন্য কি ভাত-কাপড়ের বন্দোবস্ত আছে? আমাদের শিক্ষা জীবন শেষে জুতার চামড়া না ক্ষয়ে চাকরির ব্যবস্থা আছে? আমাদের নিরাপদ সড়ক আছে? আমদের, নাকি এদেশ আমাদের না? নাকি শুধু কতিপয় দলীয় ক্ষমতাধারীদের?

আমরা কিছু বলতে পারি না, আমরা কিছু চাইতে পারি না। দাবি-দাওয়া অধিকার সেতো বইয়ের পাতায় লেখা কল্পকাহিনী যেন। আমরা দেশের হরিজন, অচ্ছুৎ অংশ। আমাদের তাই অবহেলা উপেক্ষায় রাখা। ফিরে চায় না কেউ আমাদের পানে। আমাদের মৌলিক অধিকারে কোন অধিকার নেই। আমাদের জন্য নেই কেউ, নেই কিছু। দেশের হর্তাকর্তা বিধাতা ব্যক্তিদের কাছে আমরা জঙ্গি, নাস্তিক, রাজাকার সদায়, তাই কারণে অকারণে আমাদের ধরে নিয়ে পুরে দেয় চৌদ্দ শিকের মাঝে। দোষ হয়ত একটা গোলাপী পোশাক কিম্বা চাকরির অধিকারের আন্দোলন। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধানুযায়ী পড়তে চাইবার দাবিতে কথা বলেছিলাম কভু, কিংবা নিরাপদ সড়ক চেয়েছিলাম।

অসি অপেক্ষা মসি ভয়ে ভীত বেশি। পত্রিকার পাতায় হোক আর সোস্যাল মিডিয়াতে হোক কোন দাবির কথা লেখা হলেই গন্ধ শুঁকে খুঁজে নেয় আমাদের বারেবারে। আমাদের জীবন এই দেশে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাতি, ফুঁ দিয়ে নেভাতে সদা তৎপর একদল মানবেতাবাদী।

আমাদের জীবনের কতটুকু মুল্য বলুন? আমরা মারা পড়ি রোজ, বাসের লাইনে, চাকরির লাইনে, চিকিৎসার লাইনে, বাজারের লাইনে, দিনে দিনে বেড়ে যাওয়া মুল্য বৃদ্ধির চাপে, রোজ মরি। আমাদের মত হরিজন সম্প্রদায়ের দুটি ছেলে মেয়ে গত মাসে মারা পরে ফিটনেসহীন বাসের বেপরোয়া চালানোর ফলে। আমাদের মত রোজ মরতে থাকা পরিবারের ছেলে মেয়েরা ফুঁসে ওঠে, চোখের সামনে পিষে মরে যাওয়া বন্ধুদের শোকে। তিন/চারটা দিন তারা পথে আন্দোলন করে শুধু মাত্র নিরাপদ সড়কের দাবীতে। না তারা কেউ সরকার পতনের ডাক দেয়নি। তারা হরতাল ডাকেনি, তারা শুধু চেয়েছে বন্ধু হত্যার বিচার, তারা চেয়েছিল চালকের যথাযথ বয়স ও তার গাড়ি চালানোর অনুমতি দানের, রাস্তায় চলাচল করা যানবাহনের সঠিক কাগজপত্র। এই দেশে যা হয়নি, বা হবে ভাবিনি। আমাদের ছোট ছোট স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা করে দেখিয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ইমার্জেন্সি লাইন, যা স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও আমরা পাইনি। তিনটা দিন ছিল। রিক্সা এক লাইনে, নিয়ম মেনে সবার গাড়ি চালনা। এ যেন ছিল কল্পনার রাজ্য। হ্যাঁ আসলেই কল্পনা ছিল যার মেয়াদ ছিল চারদিন। আমাদের সন্তানেরা দেখিয়ে দিয়েছিল সমাজের নিয়ম তৈরীকারিরা কতটা অনিয়ম করে। সবাই ফিটনেস ছাড়া, তাদের কারো যানবাহনের নেই ফিটনেস পেপার, নেই লাইসেন্স। কতটা লজ্জা দিয়েছিল তাদের বাচ্চাগুলি। কিন্তু কারো কি লজ্জা লেগেছিল সে হোক মন্ত্রী বা আমাদের পাশের বাড়ির আবুল সাহেব। সবাই চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছে।

এ যেন এক উল্টো রাজার দেশের গল্প, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের নিয়ম না মানার ও নিয়মভাঙ্গার গল্পশোনা চলে তিন চার দিন ধরে। জনদুর্ভোগ হলেও আমজনতা মেনে নিয়ে ছিল। এই শিশু কিশোরদের চলা আন্দোলনের আগুনে আলুপোড়া খাওয়ার মানুষের অভাব হয়নি, ক্ষমতাসীন দল চাইছিল এমন কিছু ঘটুক, এদিকে আধমরা বিএনপি আন্দোলনের ফায়দা নেবার জন্য ছাত্রদের আন্দোলনে ঢুকে গেল বেশভূষা বদলে। ভাঙ্গাভাঙ্গি জ্বালাও পোড়াও শুরু হতেই ছাত্রলীগ হেলমেট পরে মাঠে নামলো পুলিশের সহযোগী হয়ে, কেউ কেউ তো পুলিশের কাঁধে হাত রেখে টিয়ার গ্যাস কোথায় মারতে হবে দেখিয়েও দিল, তাদের কেউ কেউ লুঙ্গি কাছা মেরে লাঠি সোটা নিয়ে আন্দোলনরত শিশু কিশোরদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল প্রবল বিক্রমে পুলিশে হাত শক্ত করতে। হাত কাঁপেনি এই বেধড়ক পিটানোতে। এই পিটানো থেকে রেহাই পায়নি কেউ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে যারাই ক্যামেরায় এই অন্যায় চিত্র ধারণ করেছে, সবাই মার খেয়েছে, তাদের ক্যামেরা ও ফোন ভেঙ্গে ফেলেছে। অপরাধের চিহ্ন রাখতে চাইনি গুণবান কর্তাব্যক্তিরা। এই অন্যায় অনিয়ম নিয়ে যারাই কথা বলেছে তারাই একে একে ধরা পড়ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে, অদ্ভুত সব অজুহাতে।

পিটানি চলছে রোজ, একটা ছাত্র ছাত্রীকে আইনের ছত্রছায়ায় ধরা হচ্ছে, এই আইনি পিটানিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে এক একটা পরিবার। কেউ ভাবছে না আমাদের রোজ রোজ শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে। আমরা মরছি কেন রোজ কারো দেখার বা ভাবার সময় নেই। একদিকে চলছে ক্ষমতার দাপটে অন্যায়, অন্যদিকে চলছে অন্যায়ের প্রতিবাদকারীকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার। কে দেখবে আমাদের? কে পাশে দাঁড়াবে? যাদের দাঁড়ানোর কথা তারা তো আজ ক্ষমতার পাওয়ারফুল রঙ্গিন গ্লাস চোখে পরে আছে, আমাদের দুর্দশা দেখবে কি করে! শুনবে কি আমাদের আর্তনাদ, ক্ষমতার রক মিউজিকে শুনছেন এয়ারফোন লাগিয়ে, যা ভেদ করে পৌঁছে না আমাদের কান্না, ক্ষোভ চিৎকার।

আমাদের সামান্য অধিকার নিয়ে কথা বলাতে তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। আমাদের চলাফেরা, লেখাপড়া, কথা বলায় রেশন করে দিতে চলেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি আমাদের মগে কারফিউ চালাতে চাইছে। মূক ও বধির হয়ে থাকার জন্য চলছে অহর্নিশি পেষণ। আমাদের জন্য নয় দেশের সংবিধান, আমাদের জন্য নয় মৌলিক অধিকার, আমাদের জন্য নয় সরকার রাষ্ট্র, তাদের বুঝি আমাদের ভোটের আর প্রয়োজন নেই। একারনে আমাদের শত্রু জ্ঞান করে সর্বদা মূল্যায়ন চলে, আমাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে হরিজনসম,অচ্ছুৎ, এই রাষ্ট্রে তাই আমাদের জন্য ভাবে না কেউ। আমরা কি চাইছি তা শুনবে কেউ ভাবাও এখন অলীক স্বপ্ন বুঝি!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)