১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। দৌড়ে আব্বা-আম্মার ঘরে গেলাম। সবাই হতচকিত। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আব্বা টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন খবর জানার জন্য। শব্দটা এত কাছ থেকে আসছিল যে কান পাতা যাচ্ছিল না। আমরা থাকতাম আসাদগেট নিউকলোনিতে। ৩২ নম্বর এর খুব কাছে।
এর মধ্যে আম্মা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘শব্দটা কি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আসছে? ওনাকে কি মেরে ফেললো? তুমি রেডিও ধরো।’ আম্মার এই কথার পর আব্বা সম্বিত ফিরে পেয়ে রেডিও অন করলেন।
অপকর্মের সদম্ভ ঘোষণা
ভেসে এল মেজর ডালিম এর কন্ঠস্বর। তাদের অপকর্মের কথা জোর গলায় ঘোষণা করছে। আমার বয়স তখন ১০ বছর – কিন্তু সব ঘটনা স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আব্বা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এর আগে আমি কখনও আব্বাকে কাদঁতে দেখিনি । আম্মাও কাদঁছেন। আমিও বুঝে, না বুঝে কাঁদতে থাকলাম। আমার তখন রাজনীতি বোঝার বয়স নয়, বুঝতামও না। কিন্ত পারিবারিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্ভব টান বা ভালবাসা তৈরি হয়েছিল, যা এখনও অটুট।
বেজে উঠলো লাল টেলিফোন
আব্বা শামসউল হুদা সেসময় ছিলেন প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার (প্রধান তথ্য কর্মকর্তা)। তিনি পাগলের মত কাঁদছেন, আর বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর জানার চেষ্টা করছেন।
আমাদের বাসায় তখন একটা ‘লাল ফোন’ ছিল, যেটা দিয়ে শুধু হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা যেতো। সেটার নাম্বারও ছিল তিন ডিজিটের। সেই ফোনটা সকাল ১১ টার দিকে বেজে উঠল। ওই পাশ থেকে একজন আব্বাকে বললো রেডি হয়ে নিতে, কারণ তাকে নিতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।
এই কথা শুনে আম্মার অবস্থা হলো আরো শোচনীয়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়েছে। তাঁর আশেপাশে যারা ছিল তাঁদেরও এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। আম্মা চিৎকার করে আব্বাকে বলতে থাকলেন, ‘ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে, ওরা জানে তুমি বঙ্গবন্ধুর লোক। তুমি যেওনা রঞ্জনার আব্বা।’
আব্বাকে নিয়ে গেলো ওরা
কিন্ত না যেয়ে তো উপায় নেই। আব্বা রেডি হয়ে নিলেন। বেলা ১২ টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি জীপ এসে আব্বাকে নিয়ে গেল। সারা কলোনির মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। চরম একটা অনিশ্চিত ও ভীতিজনক অবস্থা।
এরপর প্রায় দেড়দিন চলে গেল, আব্বার কোন খবর পেলাম না। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে পাগল হওয়ার অবস্থা। বাবেলের বয়স ১ বছর – ওর দিকেও আম্মার চোখ নেই। বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ। ভয়ে অনেক আত্মীয়-স্বজন খোঁজ খবরও নিচ্ছেন না।
যে দৃশ্য কোনদিনও ভুলবো না
ঠিক এরকম একটি অবস্থায় প্রথম দিনটি চলে গেল। ১৬ আগষ্ট সকালবেলায় দেখলাম আমাদের বিল্ডিং এর নীচতলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের একজন নেতা থাকতেন, উনি মিষ্টি বিতরণ করছেন। হাসিহাসি মুখে সেই মিষ্টি খাচ্ছে কেউ কেউ।
সেসময় জাসদের পত্রিকা ‘গণকন্ঠ’র একজন সাংবাদিক আনোয়ার সাহেব থাকতেন কলোনিতে। উনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশশুদ্ধ হত্যা করার কাজটি কত ভাল হয়েছে, সে বিষয়ে উচুঁ গলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর তার চারপাশের লোকজন এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানারকম টিপ্পনি কাটছে।
আমি অবাক হয়ে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তখনও ভেবেছি, এখনও ভাবি; যে মানুষটি এই দেশকে স্বাধীন করলেন, তাঁকে এইভাবে মারা হল! তারপর আবার মিষ্টিও খাচ্ছে কেউ কেউ। এরকম একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে কেন, কারা সমর্থন করছে? আমার সেই সময়ের শিশুমনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এর উত্তর আজো পাইনি। যতবার ১৫ আগষ্ট আসে, ততবার সবকিছু ছাপিয়ে শুধু ওই দৃশ্যটিই আমার চোখে ভেসে ওঠে ।
অত:পর আব্বার ফিরে আসা
১৭ আগষ্ট দুপুরে সেই লাল টেলিফোন আবার বেজে উঠলো। ওই পাশে আব্বার কন্ঠস্বর। যাক তাহলে ওরা আব্বাকে মেরে ফেলেনি। আম্মার যে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তা আবার ধারার মত নামতে শুরু করল। শুধু বলতে থাকলেন, ‘তুমি কী খাইছো? ওরা তোমাকে মারে নাইতো? তুমি কখন আসবা?’
আব্বা জানালেন, তিনি বঙ্গভবনে আছে। সান্ত্বনা দিয়ে আমাদের চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, কাজ শেষ হলে ওরাই বাসায় দিয়ে যাবে।
রাত ১২টার দিকে আব্বা বাসায় ফিরে এলেন। কিন্ত আব্বাকে অসম্ভব ক্লান্ত, অসহায় আর বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। আব্বার ওই চেহারাটা আমি কোনদিন ভুলবো না।
ইতিহাসের কালো অধ্যায়
সেই ১০ বছর বয়সে আমি যা বুঝিনি, পরবর্তী সময়ে এর অনেকটাই আমি বুঝেছি। বুঝেছি, ইতিহাসে কালো অধ্যায় একবার যোগ হলে, তা বারবার ফিরে আসে। সেদিন সামরিক বাহিনীর সেই কুৎসিত কাজকে যারা সমর্থন করেছিল, তারা নিজেরাই একদিন সেই কুৎসিত কাজের বলি হলো।
বারবার সামরিক অভ্যুথানে ক্ষতবিক্ষত হল দেশ ও দেশের মানুষ। আমি এখনও বিশ্বাস করি এবং সারাজীবন বিশ্বাস করে যাবো– ১৫ আগষ্টের সেই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশকেই পরাজিত করেছে এবং এর জের আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।
ব্যক্তিগত আরেকটা অভিজ্ঞতা বলি।
গত বছর অামি প্রায় মৃত্যুমুখে চলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে এই আগস্ট মাসেই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন কয়েকজন মানুষ। দেবদূত হয়ে এসেছেন ওই চিকিৎসকদল। আর ঠিক আমার বয়সী রাসেলকে মাত্র ১০ বছর বয়সেই মেরে ফেলেছে মানুষরূপী কয়েকজন যম। রাসেল বেঁচে থাকলে অাজ অামার মতোই বড় হতো সে। তাকে, তার মাকে, তার বাবাকে, তার ভাই-ভাবীদের যারা মেরে ফেলেছে তারা কি মানুষ!