লোকটা কি ইচ্ছা করে অমন দাঁড়িয়ে আছে? ঠেস দিয়ে? আচ্ছা! বুঝলাম বাবা! গাড়িতে অনেক ভিড়! কিন্তু অমনভাবে নিজের শরীরের নিম্নাংশ নারীদের শরীরের সঙ্গে লাগিয়ে রাখবে সে কি কথা! বলতে গেলে শুনিয়ে দিবে “কারও তো সমস্যা হয় না, আপনার হচ্ছে কেন?” কিংবা “ভিড় বাসে ওরকম একটু আধটু হবেই। না মানলে উঠবেন না।” এইসব ক্ষেত্রে আমি কোমর বেঁধে ঝগড়া করি। লোক গজগজ করে আমার কাছ থেকে ভাগে ঠিকই! কিন্তু আবার অন্য কোন মহিলা সিটের সামনে ইচ্ছে করে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জানি না ওতেই তার কি তৃপ্তি!
মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসে এক লোক প্রত্যেক সকাল বেলায় বাসে ওঠে। মেয়েদের সিটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে স্বমেহনের তৃপ্তি পেতে। দুইদিন ধরে ঝাড়ি দিয়েছি, কলার চেপেছি। তৃতীয় দিন বাসে উঠার পর আমাকে দেখে বাস থেকে নেমে গেছে। নেক্সট বাসে সুযোগ নিবে হয়তো!
আরেক বৃদ্ধ লোক একদিন ব্যাগ হাতে করে যাচ্ছে। তিনি, আমি এবং আরেক আপু ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে আছি। এই বয়স্ক লোকটিকে দেখলাম ইচ্ছে করে আপুর শরীরে ব্যাগ লাগাচ্ছে। আমি বললাম, “এদিকে আসেন আপনি।” আমি আপুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। লোকটা গোঁজ হয়ে থাকল।
আরেকদিন ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে আছি পেছন থেকে একদম দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে হাতের স্পর্শ পেলাম। হাত দুমড়ে চেপে বললাম, “দাঁড়াতে কষ্ট হলে নেমে যান! নাইলে হাত আর অবশিষ্ট থাকবে না!”
পাশে বসে কনুই দিয়ে বুকে ধাক্কা দেওয়া, ইচ্ছে করে ছড়িয়ে বসে কোমরের সঙ্গে ঘষাঘষি, পায়ের সঙ্গে পা লাগান, ইচ্ছে করে হুমড়ি খেয়ে পড়া, মেয়ে নামতে গেলে বুকের সামনে হাত প্রসারিত করে রাখা! বাসে চড়া মেয়েরা এগুলোর কোনটার মুখোমুখি হয়নি বলতে পারেন?
আমাদের নারীদের সারা শরীর এতো বেশী সেক্স অবজেক্টের মতো! বাসে যে যেমন পারে ছুঁয়ে, টিপে নিয়ে নিজের রাতের কাজটা সকালে করার বন্দোবস্ত করেন। কয়েক মিটার লম্বা দীর্ঘ এক বাসে চলতে থাকে কত পাশবিক উল্লাস! কোন কোন মেয়েরা চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে গন্তব্য পৌছাতে পারলে বাঁচে, কোন মেয়ে চিৎকার করে চেঁচায়! কিন্তু এটাই কি সমাধান?
বাদ দেই! মানুষকে শিক্ষিত হবে! মানসিক দিক থেকে উন্নত হতে হবে! এইসব তত্ত্বে বলা জিনিস। এমন সাবজেক্টিভ কিছু করতে হবে, যাতে ওই লম্পটগুলোর শিক্ষা হয়ে যায়!
আমি ফেসবুকে বলেছিলাম, এইরকম নোংরামি যারা করে তাদের ছবি তুলে রাখতে। একটি ক্লিক, একটি প্রতিবাদ।
আমার এক বান্ধবীকে এক হেল্পার নোংরা খিস্তি খেউড় করেছিল। ধর্ষকের দৃষ্টি দেওয়া সেই হেল্পারের ছবি তুলে এনেছিল। হেল্পার ছিল হিমাচল বাস সার্ভিসের! বাসের নাম্বার জানা, ছবি আছে! কিন্তু অভিযোগ করবে কার কাছে? হিমাচল বাস সার্ভিস, বিআরটিসি? কার কাছে? সত্যতা প্রমাণ করবে কি করে?
নারীদের বাসভেদে ৪ থেকে ১১টা মহিলা সিটে পুরুষেরা বসে থাকে! বলতে গেলে বলে “মহিলা পুরুষের সিটে বসে আছে কেন?” শিক্ষিত ব্যক্তিরা এই কথা বলে। আমাকে এখনও চিৎকার দিয়ে জানাতে হয় “পুরুষের সিট বলে কোন কথা নেই, ওটা জনসাধারণের সিট। আর নারীদের জন্য এইগুলা সংরক্ষিত।”
আইন আছে, প্রয়োগ নেই! অর্ধেক লোকের জানা নেই! আইন হোক! প্রতিদিন বাসে ঘটা করে আমাদের সাথে এই নোংরামি বন্ধের জন্যই কোন কঠোর আইনের ব্যবস্থা করা হোক। ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা আশা করতেই পারি, বাসে বাসে কোন একটা সিস্টেম থাকবে। কিংবা কোন অ্যাপ থাকবে স্মার্টফোনে, কিংবা থাকবে কোন হেল্পলাইন! সেই হেল্পলাইনের আন্ডারে, প্রতি স্টপ পরপর থাকবে অভিযোগ দেখার জন্য বিআরটিসি নিয়োজিত আইনের লোক। সেই সময় মেয়েরা অভিযোগ করবে, সাহায্য চাইবে। বাসে বাসে আইনের ব্যাপারগুলো বড় করে ঝুলানো থাকবে। যাতে লোকে বোঝে, জানে। তর্ক ছাড়া জায়গা ছেড়ে দেয়। ধরা পড়া অপরাধীর ছবি ছেপে দেওয়া হবে বাস সার্ভিসে। এবং লম্পটকে ওই বাস সার্ভিসে পরবর্তীতে আর যাতে না উঠায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
দুঃখের বিষয় হল, বাসগুলো আজকাল হয়ে উঠেছে বিকৃত রুচির কিছু মানুষরূপী পশুর আখড়া! কঠোর আইন ছাড়া এই ব্যবস্থা নির্মূল করা প্রচণ্ড কষ্টকর। বাংলাদেশে রোজ লাখ লাখ মেয়ে যাত্রার জন্য নির্ভর করে বাসগুলোর উপর। প্রতিদিন হাজার হাজার মেয়ে বিভিন্নভাবে হেনস্থা হচ্ছে এই বাসযাত্রী বা বাসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। এর বিরুদ্ধে বিআরটিসি আর দেশের সমস্ত বাস সার্ভিস একাট্টা না হলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে!
নারী দিবসে ‘নারী তুমি মহান’ বলে মুখে ফেনা তুলে লাভ নেই, তার চাইতে নারীদের ‘নিরাপদ সড়ক পরিভ্রমণ’ নিশ্চিত করাটা অনেক বেশী জরুরী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)