নিজের ফেসবুকে দেওয়া শেষ পোস্টে পাসপোর্ট হাতে থাকা একটা ছবি দিয়ে তার মুখটা চিরদিনের জন্য আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই সাথে রেখেছেন তাকে ভুলে না যাওয়ার আহ্বান। যে আহ্বানে সাড়া দিয়ে শোক-শ্রদ্ধায় আজ আমরা বলতেই পারি… ‘আমরা তোমাকে ভুলব না।’
হ্যাঁ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের দেয়া শেষ ফেসবুক পোস্টের কথাই বলছি। গত ২ জানুয়ারি নিজের ফেসবুকে দেয়া পোস্টে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বসে থাকা একটি ছবি দিয়ে তিনি লিখেন… “আমাকে যেন ভুলে না যাও… তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।”
বাংলাদেশের এই কিংবদন্তী শিল্পী আজ আর আমাদের মাঝে নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর আফতাবনগরে নিজ বাসায় মারা যান আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এর আগে ভোর সোয়া ৪টার দিকে হার্ট অ্যাটাকের পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
এর আগে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি বুলবুলের হার্টে আটটি ব্লক ধরা পড়ে। তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে পেরে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, রাষ্ট্রপতির পুরস্কার, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড ও শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
দীর্ঘ চার দশকের ক্যারিয়ারে তিনশ’রও বেশি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে গেছেন বুলবুল। একই সঙ্গে সুর দিয়েছেন ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’র মতো দেশাত্মবোধক গানে।
গানের অ্যালবাম তৈরির পাশাপাশি অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য অসংখ্য শ্রোতানন্দিত ও জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি।
১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে বুলবুল চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। তিনি অসংখ্য গানে সুর করেছেন। এর বেশিরভাগই তার নিজের তৈরি। জনপ্রিয় এসব গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, জেমসসহ দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীরা।
বুলবুলের জনপ্রিয় অসংখ্য গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেললাইনের ধারে, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি’, ‘ও আমার মন কান্দে, ও আমার প্রাণ কান্দে’, ‘আইলো দারুণ ফাগুনরে’, ‘আমার একদিকে পৃথিবী একদিকে ভালোবাসা’, আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে যেন পেয়েছি’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয়’, ‘কত মানুষ ভবের বাজারে’, ‘তুই ছাড়া কে আছে আমার জগৎ সংসারে’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘স্বামী আর স্ত্রী বানায় যে জন মিস্ত্রি’, ‘আমার জানের জান আমার আব্বাজান’, ‘ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে’, ‘এই বুকে বইছে যমুনা’, ‘সাগরের মতোই গভীর’, ‘আকাশের মতোই অসীম’, ‘প্রেম কখনো মধুর, কখনো সে বেদনাবিধুর’, ‘আমার সুখেরও কলসী ভাইঙা গেছে লাগবে না আর জোড়া’, ‘পৃথিবীর জন্ম যেদিন থেকে, তোমার আমার প্রেম সেদিন থেকে’।
‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘কী আমার পরিচয়’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়’, ‘বিধি তুমি বলে দাও আমি কার’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা’, ‘তুমি আমার এমনই একজন’, ‘যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন’, ‘তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ, জীবনে বসন্ত এসেছে’, ‘ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন, ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী আমার হৃদয় একটা আয়না’, ‘ফুল নেব না অশ্রু নেব’।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জন্ম ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি। ১৯৭০’র দশকের শেষ সময় থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সঙ্গীতশিল্পে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)