৪ ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্মিলিত মঞ্চ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন এগেইনেস্ট ক্যান্সার (ইউআইসিসি) এর উদ্যোগে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৬ সাল থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে এ দিবসটির ভূমিকা রয়েছে।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে “We can I can” বাংলায় ভাবার্থ, আমরাই পারি, আমিই পারি ক্যান্সার রুখতে। ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রত্যেক মানুষ যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে পারে। ক্যান্সারের মত মরণব্যাধি সৃষ্টির যেসব ঝুঁকি রয়েছে, সেসব ঝুঁকি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। পাশাপাশি পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের ক্যান্সারের ঝুঁকিমুক্ত জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
ব্যক্তিগত আলাপানে ক্যান্সারের কারণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা উল্লেখ এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। সর্বোপরি সম্মিলিতভাবে ক্যান্সার প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি গ্রহণকে উৎসাহিত করতে কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে।
ক্যান্সারের ঝুঁকিমুক্ত থাকতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে বেছে নিতে হবে। স্বাস্থ্যকর জীবন বলতে এমন জীবন, যেখানে ক্যান্সারসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের বাহ্যিক কোন ঝুঁকি থাকবে না। যেমন: ক্যান্সার রোগের জন্য প্রধানতম দায়ী: পরোক্ষ ধূমপানসহ ধূমপান ও তামাক সেবন, মাদকদ্রব্য সেবন, কোমল পানীয় ও জুস নামক অস্বাস্থ্যকার পানীয় ও ফাস্টফুড খাবারের অভ্যাস। এসব আসক্তি বা বদঅভ্যাস সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে।
নেতিবাচক খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন (তামাক, মাদক, কোমল পানীয়-জুসসহ অস্বাস্থ্যকর পানীয় ও ফাস্টফুড বর্জন এবং শাকসব্জি ও ফলমূল বেশি খাওয়া), শারীরিক পরিশ্রম (ব্যায়াম, নিয়মিত হাঁটা, সাইক্লিং), বায়দূষণ রোধ, মুটিয়ে যাওয়া রোধ করার মাধ্যমে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
শুধু ধূমপান ও তামাক সেবনের কারণে ২০১০ সালে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন বা মুটিয়ে যাওয়া, অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম ও পুষ্টিঘাটতির কারণে প্রায় এক চতুর্থাংশ (প্রায় ২০ লক্ষ) ক্যান্সারজনিত মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার ঝুঁকিও কমিয়ে আনা সম্ভব।
অন্যদিকে প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত হলে কোলোরেক্টাল ও সার্ভিকাল ক্যান্সার নিরাময় এবং ব্রেস্ট, কোলন, রেক্টাম, সারভিক্স ও ফুসফুস ক্যান্সার (প্রধানত দীর্ঘদিন ধূমপানের কারণে হয়) মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু ক্যান্সারের চিকিৎসা জটিল, ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় প্রতিরোধই উত্তম।
তাজা শাক-সব্জি ও দেশী ফলমূল পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। এটা ঠিক, ফলমূল ও শাকসজ্বি উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং প্রক্রিয়াজাত করণে ফরমালিন, কার্বাইড ইত্যাদি ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ক্যান্সারসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার ক্রয় করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় এখন অর্গানিক খাবার পাওয়া যায়।
রাসায়নিক কীটনাশক ও সারসহ ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার না করে স্থানীয় প্রাণ ও পরিবেশ উপযোগী ফসল উৎপাদনে স্থানীয় কৃষকদের সংগঠিত করার মাধ্যমে ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’ পরিচালনা করছে ‘উন্নয়নে বিকল্প নীতি গবেষণা’ (উবিনীগ)। পাশাপাশি কৃষকদের মাধ্যমে অর্গানিক পদ্ধতিতে খাদ্যশস্য (চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি) উৎপাদন করছে, যা ঢাকায় মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে (প্রিয়াংকা কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন) বিক্রি হয়। অর্গানিক শাকসবজি ও ফসল উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে সংগঠিত তরুণদের একটি ইতিবাচক উদ্যোগ ‘প্রাকৃতিক কৃষি’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরা তাদের অর্গানিক খাবারের নাম, বিক্রির সময় ও তারিখ পর্যন্ত জানিয়ে দেয়। প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র নামে ঢাকার লালমাটিয়ার এ ব্লকে (আড়ং এর পেছনে পানির ট্যাংকসংলগ্ন) প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত বিষমুক্ত খাদ্যশস্য বিক্রি করে।
এদের কাছ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগকে উৎসাহিত করা দরকার। ক্ষেত্রবিশেষে দাম বেশি মনে হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় নিলে সেটা গৌণ হয়ে যাবে। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর-এ বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত মোড়কজাত খাদ্যদ্রব্যের চাইতে কম দামে ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্যশস্য পাওয়া যায় এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের অধিকাংশ শাকসবজি ও দেশী ফলমূলে রাসায়নিক কম ব্যবহার হলেও এর কোন প্রচারণা নাই। কিন্তু মোড়কজাত ক্ষতিকর খাবারের প্রচারণা সর্বত্র বিদ্যমান। মূলত, দেশি-বিদেশী কোম্পানিগুলোর প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের প্রভাবে কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক্স, ফাস্ট ফুড, মোড়কজাত জুস ইত্যাদি অতিরিক্ত মিস্টিজাতীয় পানীয় এবং ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত লবননির্ভর জাঙ্ক ফুড ও ফ্রোজেন ফুড এর প্রতি আসক্তি বাড়ছে।
প্রক্রিয়াজাতকৃত এসব মোড়কজাত খাবারও ক্যান্সারসহ নানা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। তবে ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে বিড়ি, সিগারেট, সাদাপাতা, হুক্কার তামাক, জর্দা, গুল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেলের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১০-এ বলা হয়েছে, বিড়ি-সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের ধোঁয়ায় নিকোটিন, ডিডিটি, কার্বন মনোক্সাইড, টার বা আলকাত্রা, আর্সেনিক, মিথানল, ন্যাপথালিন, বেনজোপাইরিন, সায়ানাইড, এমোনিয়া, অক্সিডেন্টসহ ৭০০০ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। যার মধ্যে ৭০টি সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টির সাথে জড়িত।
শুধু ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রায়শই শুনে থাকি, ‘আমি একা, একজন মানুষ কী করতে পারি’? এটা আসলে দায় এড়ানোর কৌশলমাত্র। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অসীম ক্ষমতা রয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এসব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব কিন্তু একজনই দেন। একজন ব্যক্তিই মূলত অন্যদের সংগঠিত, উদ্বুদ্ধ করে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যান। ক্যান্সারের মত মরণব্যাধি নিয়ন্ত্রণেও এ বছরের প্রতিপাদ্যে সেরকম নেতৃত্বকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ক্যান্সার। আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্র (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার-আইএআরসি) এর ‘গ্লোবাল ক্যান্সার ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার্স’-এর সর্বশেষ সংস্করণে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে নতুন করে ১ কোটি ৪১ লক্ষাধিক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
এর ৮০ লক্ষই উন্নয়নশীল দেশে পৃথিবীর ৮২ভাগ মানুষ এসব দেশের নাগরিক। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গড়ে প্রতিদিন ২২ হাজার ও প্রতিবছর ৮২ লক্ষ মানুষ ক্যান্সারে মারা যায়। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই মৃত্যুসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ আগামী ১৪ বছরে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুসংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ বাড়বে!
ক্যান্সার প্রতিরোধে শরীরের ওজন ও মুটিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এজন্য কোমল পানীয়, জুস, এনার্জি ড্রিংক্স, ফাস্টফুড ইত্যাদি ক্ষতিকর পানীয় ও খাবারের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত খেলাধুলা করতে হবে, হাঁটা ও সাইকেল চালাতে হবে। কিন্তু ঢাকায় পর্যাপ্ত খেলার মাঠ-পার্ক না থাকায় মানুষ খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না। যেসব পার্ক-মাঠ আছে সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও ব্যবহার উপযোগী থাকছে না।
ঢাকায় মানুষ কর্মস্থলে আসা-যাওযার সময় হাটতে পারে। কিন্তু ফুটপাতগুলো উচু-নিচু, ভবন তৈরির জিনিসপত্র ফুটপাতে রাখা ও প্রাইভেট গাড়ির পার্কিংয়ের কারণে মানুষের হাঁটার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। ঢাকায় মাত্র ৪ভাগ মানুষ প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করলেও ৭০ভাগ রাস্তার সুবিধা তারা গ্রহণ করে। বিপরীত দিকে ৬০ভাগ মানুষ হেটে যাতায়াত করলেও ৫ভাগ সুবিধাও পায় না। এই বৈষম্য মানুষকে হাঁটতে নিরুৎসাহিত করে। ঢাকার রাস্তাগুলো সাইকেল চালানোরও উপযোগী নয়।
অথচ সাইকেলের জন্য আলাদা লেন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদান করা হলে মানুষ সাইকেল চালাতে উৎসাহী হবে। এতে করে শুধু ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণই নয়, মানুষের স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে। যাতায়াত ব্যয় ও জ্বালানি ব্যয় কমবে। যাতায়াত সংকট ও যানজট কমবে। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লক্ষাধিক ক্যান্সার রোগী রয়েছে। প্রতিবছর ৩ লক্ষ মানুষের নতুন করে ক্যান্সার সনাক্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ নানারকম ক্যান্সারে মারা যায়।
বাংলাদেশে পুরুষের ফুসফুস ক্যান্সার ও মহিলাদের জরায়ু মুখের ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের সংখ্যা সর্বাধিক। এছাড়া চর্বনযোগ্য তামাক সেবনের কারণে মুখ ও মুখগহ্বর ক্যান্সারও অনেক। ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা খুব জটিল ও ব্যয়বহুল হলেও দেশে এ রোগের চিকিৎসা অপ্রতুল। যারা বিত্তবান, তারা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন। কিন্তু দরিদ্ররা সম্পত্তি বিক্রি করে অপ্রতুল চিকিৎসা নিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীকে বাঁচাতে পারেন না।
যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তাদের পরিবারের অনেক অর্থ এ রোগের চিকিৎসায় ব্যয় হয়। অন্যদিকে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে সরকারকেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এজন্য ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার চাইতে এ রোগ প্রতিরোধকে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)